ভিয়েতনাম কেন গুরুত্বপূর্ণ ভারতবর্ষের জন্য? কেন এই দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক করার দিকে জোড় দেওয়া হচ্ছে?
আপনারা কী জানেন ১৯৬০ এর দিকে কলকাতার রাস্তায় একটি স্লোগান প্রায়ই শোনা যেত “মেরা নাম, তুমহারা নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম”. সেসময় ভিয়েতনাম আমেরিকার মত শক্তিশালী দেশের সাথে লড়াই করছিল। আমেরিকার বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট দল ভিয়েতকং এর এই লড়াইকে ভারতের মত সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলো সমর্থন করছিল। শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয় ভারতের সব রাজ্যে এই ছোট্ট এশিয়ান দেশটির প্রতি সমর্থক দেখা যাচ্ছিল কারন ছোট্ট এই দেশটি আমেরিকার মত সুপার পাওয়ারের অবস্থা খারাপ করে দিয়েছিল। ১৯৭২ সালে ভারত ও ভিয়েতনামের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের আগে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ও ভিয়েতনামের লিডার হো চি মিনের মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল। আসলে জওহরলাল নেহেরুর নন অ্যালায়েন্সমেন্ট মুভমেন্টের জন্য ভিয়েতনাম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই মুভমেন্টের লক্ষ্য ছিল সুপার পাওয়ারদের প্রভাব থেকে বেড়িয়ে এসে একটি নিরপেক্ষ জোট গঠন। ভারত ও ভিয়েতনামের কুটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পরে আবারও ভারত ও ভিয়েতনাম জোটবদ্ধ হয়েছে একটি কমন সমস্যার কারনে তা হচ্ছে চীন। চীনের অ্যাগ্রেসিভ বিদেশনীতি ও মিলিটারি পলিসির কারনে আজ এশিয়া জুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দক্ষিন সাগরে স্পার্টলি দ্বীপ নিয়ে ভিয়েতনামের সাথে বিবাদই হোক কিংবা গালওয়ান ভ্যালি ভারতের সাথে সংঘর্ষ সব কীছু নিয়েই বর্তমানে ভারত ভিয়েতনাম সম্পর্ক মজবুত দরকার আরও একবার। যার জন্য সম্প্রতি ভিয়েতনাম সফরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং ২০৩০ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারত ভিয়েতনাম যৌথ জোট গঠনের চুক্তি সই করেছে। এই প্রথম ভারত ও ভিয়েতনামের মধ্যে এধরণের লজিস্টিক চুক্তি হল। যাতে উভয় উভয়ের মিলিটারি বেসে প্রবেশাধিকার পাবে। ভারতের জন্য এই চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারন ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি ও ইন্দো প্যাসিফিক নীতির জন্য ভিয়েতনাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকে এই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, পাশাপাশি কেন ভিয়েতনাম ভারতের মধ্যে মজবুত কুটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারে যা জিও পলিটিক্যালি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত ও ভিয়েতনামের সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক বন্ধন প্রায় ২০০০ বছর পুরোনো। বলা হয় দ্বিতীয় শতকে দুজন ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুক মহাজাভাকা ও কল্যানাকুরিয়ারে ভিয়েতনামে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ঘটান। ১৩ ও ১৪ শতকে যোগী ব্রাহ্মনের মত অনেক হিন্দু সাধুও ভিয়েতনামে যান। যাতে ভারতীয় রাজাদের প্রভাবও ভিয়েতনামে বাড়তে থাকে। আজও ভিয়েতনামের শিল্প ও আর্কিটেকচারে এর প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু ভারত ও ভিয়েতনামের এই সম্পর্ক শুধু সাংস্কৃতিক ছিল না। কুড়ি শতকে ভিয়েতনামমের শান্তি পক্রিয়ায় ভারতের একটি বড় ভূমিকা ছিল। ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন হোক বা আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াই কিংবা উত্তর ও দক্ষিন ভিয়েতনামের পুনরায় এক হয়ে যাওয়া। সময় সময়ে ভারত ভিয়েতনামকে সমর্থন করেছে।
ভারত সেই অল্প সংখ্যক দেশের মধ্যে ছিল যাদের উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিন ভিয়েতনাম উভয়ের সাথেই ভাল সম্পর্ক ছিল। ভিয়েতনামের লিডার হো চি মিন ভারতের লিডারদের সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্তত ৬০ টি প্রতিবেদন, চিঠি, কবিতা লিখেছিলেন। ধীরে ধীরে ভারত ও ভিয়েতনামের মধ্যে স্ট্রাটেজিক জোট গঠন শুরু হয়, এটার সূত্রপাত হয় যখন ভিয়েতনাম ১৯৮৬ সালে ওপেন ডোর নীতি এবং ১৯৯৪ সালে ভারত লুক ইস্ট নীতি শুরু করে। ১৯৯৫ সালে ভিয়েতনাম আসিয়ান বা অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনসে যুক্ত হয়, এরপর উভয় দেশের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। গুরুত্বপূর্ণ জিওস্ট্রাটেজিক অবস্থান ও মজবুত সামরিক বাহিনীর জন্য আজ দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় ভিয়েতনাম একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ১৯৯০ থেকে ভারত পূর্ব দিকের প্রতিবেশী দেশ গুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দেয়। লুক ইস্ট নীতি অনুযায়ী দক্ষিন পূর্ব এশিয়ান দেশ গুলোর সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করাই ভারতের প্রধান লক্ষ্য ছিল। আসলে ভারত এসময় তার সফ্ট ডিপ্লোমেটিক পাওয়ার কে ব্যবহার করে দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে নিজের প্রভাব বাড়াচ্ছিল। চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গঠনই ভারতের প্রধান লক্ষ্য ছিল। আর এজন্য ভিয়েতনাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এনার্জি সিকিউরিটির ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের বিশাল অফসোর অয়েল ভারতের জন্য খুবই উপযোগী। এছাড়া ভিয়েতনাম সর্বদা ভারতের বন্ধু হিসাবে পাশে ছিল তা সে জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ হোক কিংবা জাতিসংঘের রিফর্মেশন হোক। এছাড়াও পূর্ব এশিয়া সামিট, এশিয়ান বৈঠক, এশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের বৈঠক ও মেকং গঙ্গা সহযোগিতার মতন ব্যাপারে ভিয়েতনাম ভারতকে সাহায্য করেছে।
২০০৭ সালে ৬ জুলাই ভারত ভিয়েতনামের সাথে স্ট্রাটেজিক চুক্তি করে, এই প্রথম ভারতবর্ষ কোন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ান দেশের সাথে এমন চুক্তি করে। ২০১৪ আসতে আসতে ভারতের লুক ইস্ট নীতি বদলে অ্যাক্ট ইস্ট নীতি হয়ে যায় এবং ভারত ইন্দো প্যাসিফিক এলাকায় নিজের আরও প্রভাব বিস্তার করতে সচেষ্ট হয়। ঐতিহাসিক কারনেই আজ ভারত ভিয়েতনাম প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, উন্নয়ন, ট্রেনিং ও স্টার্টআপ সংস্থা তৈরি সহ বিভিন্ন সেক্টরে যৌথ ভাবে কাজ করে। ডিফেন্স প্রোটোকল ২০০০ অনুযায়ী ভারত ভিয়েতনামের পাইলটদের ট্রেনিং, সেনাবাহিনীকে অ্যান্টি টেরোরিজম ট্রেনিং, ভিয়েতনামের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার রিপিয়ার সহ উভয় যৌথভাবে কোস্ট গার্ড এক্সারসাইজ করে। ২০১৬ তে এই সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। ভারত ভিয়েতনামকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের লাইন অফ ক্রেডিট দেয় যা ভারতের কোন দেশকে দেওয়া সবচেয়ে বড় লোন। তাহলে বুঝতেই পারছেন ভারত ও ভিয়েতনামের সম্পর্ক কেমন!
তবে ভারত ও ভিয়েতনামকে এক কাছে আনার জন্য দায়ী চীন। দক্ষিন চীন সাগর চীন নিজেদের বলে দাবি করেছে যার জন্য প্রায় চাইনিজ নেভি ও উপকূল রক্ষী বাহিনী ভিয়েতনামের ফিশিং বোট এবং অয়েল এক্সপ্লোরেশন জাহজকে বিরক্ত করে। এসবের কারনে আজ ইন্দো প্যাসিফিক এলাকা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। ভারতের ৫৫ শতাংশ বানিজ্য দক্ষিন চীন সাগর দিয়েই হয়। তাই মালাক্কা প্রনালী অবধি দক্ষিন চীন সাগরে চীনের আধিপত্য ভারতের জন্য বিপদ কারন এরকম হলে চাইনিজ নেভি আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে এসে যাবে যা ভারতের জন্য হুমকী এবং এর ফলে ভারত মহাসাগরে ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সুতরাং এই এলাকার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা অন্য দেশ গুলোর পাশাপাশি ভারতেরও কর্তব্য। এজন্য ভারতীয় নেভি এখানে মিলান বা মাল্টি ন্যাশানাল নেভাল এক্সারসাইজ করে। এতে বিভিন্ন দেশ অংশ নেয় এবং ইন্দো প্যাসিফিক এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যুক্ত থাকে। এবছরও ১১ তম মিলান এক্সারসাইজে ২৬ টি যুদ্ধ জাহাজ, ২১ টি বিমান, একটি সাবমেরিন সহ ৪৬ টি বন্ধু দেশ অংশ নিয়েছিল। ২০১৫ সালে ভিয়েতনাম ভারতকে তাদের না তাং বন্দরকে ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়। ভারত ভিয়েতনামের ৫০০ জন সেনাকে সাবমেরিন ট্রেনিং দেয় এবং ভিয়েতনাম কে মিডিয়াম রেঞ্জের ক্রুজ মিসাইল ও ছোট যুদ্ধ জাহাজ সরবরাহ করে।
২০১৯ এ ভারতের এল এন্ড টি ভিয়েতনামের উপকূল রক্ষর বাহিনীর জন্য ১২ টি হাই স্পিড পেট্রোল ভেসেল তৈরি করে। ২০২০ তে দক্ষিন চীন সাগরে ভারত ও ভিয়েতনাম নেভি একটি এক্সারসাইজ করে। ভারত ভিয়েতনামের ডিফেন্স সেক্টরকে ব্যাপক অত্যাধুনিক করছে। সম্প্রতি চীন কম্বোডিয়ার রিম নেভাল বেসকে আপগ্রেড করছে, চীন জানিয়েছে এটা তাদের ব্যবহারের জন্য নয় কিন্তু চীনের কথাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করার কারন নেই কারন শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের সাথে কী হয়েছে তা সবাই জানে। এই রিম নেভাল বেসের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটি গল্ফ অফ থাইল্যান্ডে অবস্থিত এবং এর খুব কাছেই চীনের তৈরি দারা সাকোর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অবস্থিত। একে কাউন্টার করার জন্যই ভারত ও ভিয়েতনামের মধ্যে লজিস্টিক চুক্তি হয়েছে যাতে ভারতীয় নেভি ভিয়েতনামের নেভাল বেস ব্যবহার করতে পারবে রিফিউলিং সহ অন্যান্য সাপ্লাইয়ের জন্য। ভারতের দেওয়া ৫০০ মিলিয়ন ডালরের লাইন অফ ক্রেডিট ব্যবহার করে ভিয়েতনাম ভারত থেকে অস্ত্র কিনতে পারবে, এতে ভারতের মেক ইন ইন্ডিয়া প্রজেক্ট ও আগে এগোবে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং ভিয়েতনাম সফরে ভিয়েতনাম মিলিটারির এয়ারফোর্স অফসার ট্রেনিং স্কুলে একটি আইটি ল্যাবরেটরি তৈরিতে অর্থায়ন করবে বলে জানিয়েছে। ডিফেন্স ও সিকিউরিটি ছাড়া ভারত ও ভিয়েতনামের মধ্যে মজবুত বানিজ্যক সম্পর্কও রয়েছে যেখানে ২০০০ সালে ভারত ও ভিয়েতনামের মধ্যে বানিজ্য ছিল ২০০ মিলিয়ন ডলারের সেখানে ২০২০-২১ এ উভয় দেশের মধ্যে বানিজ্য পৌঁছেছে ১৪.৪ বিলিয়ন ডলারে। টেক্সটাইল থেকে শুরু করে আইটি সেক্টর, রিয়েল এস্টেট, কৃষিকাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সোলার এনার্জি সেক্টরে অনেক ভারতীয় সংস্থা ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করেছে। টাটা কফি, এইচসিএল, ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, উইপ্রো, গোদরেজ, টেক মাহিন্দ্রার মত বড় বড় ভারতীয় কোম্পানি ভিয়েতনামে রয়েছে। ভারত ভিয়েতনামের টপ ৩০ বিনিয়োগকারী দেশের মধ্যে রয়েছে। বানিজ্য, প্রতিরক্ষা, টেকনোলজি সব মিলিয়ে ভারত ও ভিয়েতনামের জোট যথেষ্ট মজবুত। ভবিষ্যতে ব্রাহ্মসের মত মিসাইল এবং আকাশ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম ও ভিয়েতনামকে বিক্রি করতে পারে ভারত। আজ ভিয়েতনাম তাদের মিলিটারি বেস ভারতকে ব্যবহার করতে দিচ্ছে, কিন্তু অতীতে কিন্তু ভিয়েতনাম এমন করে নি যা প্রমান করে ভারতের কুটনৈতিক ক্ষমতা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভিয়েতনাম ছাড়াও আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুরের সাথেও ভারতের এমন চুক্তি আছে।