দক্ষিণ চীন সাগরে আমেরিকার অনুপস্থিতির কারনে বিরাট সুবিধা নিচ্ছে চীন
রাজেশ রায়: এই মহূর্তে বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে বড় বিতর্কিত বিষয় রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ, যা গোটা ইউরোপকে এক ভয়ানক অস্থিরতায় দার করিয়েছে। এই রাজনৈতিক সংকট বিশ্বে একটি বড় পাওয়ার গ্যাপিং তৈরি করছে যা ভবিষ্যতে আরও বড় যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। পাওয়ার গ্যাপিং বলতে বোঝায় একটি বড় শক্তি সরে গেলে সেই শূন্যস্থান পূরনের জনন্য অন্য কোন শক্তির চেষ্টা করা। এই মহূর্তে আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুপার পাওয়ার তা সে অর্থনৈতিক দিক দিয়েই হোক বা সামরিক দিক দিয়েই। আর আমেরিকার মত সামরিক দিক দিয়ে এত বিশাল না হলেও অর্থনৈতিক দিয়ে প্রায় আমেরিকা কে টেক্কা দেবার ক্ষমতা রাখে চীন। দেখুন খাতায় কলমে রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি হলেও রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ এবং বর্তমানে ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধের জেড়ে প্রচুর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে রাশিয়া বিশ্বে পুরো একঘরে হয়ে পড়েছে। ঠিক এই জায়গায়ই উত্থান হচ্ছে চীনের। বিশেষজ্ঞদের ধারনা অনুসারে বিশ্বে পরবর্তী যুদ্ধের ময়দান হতে পারে দক্ষিণ চীন সাগর। আর এখানেই সেই পাওয়ার গ্যাপিং তৈরি হয়েছে কারন আমেরিকা এই মহূর্তে রাশিয়া-ইউক্রেন ঝামেলার জেড়ে ইউরোপে ব্যাস্ত আছে। দক্ষিণ চীন সাগরে আগের মত এতটা অ্যাক্টিভ নেই আমেরিকা ঠিক এই সুযোগটাই নিয়েছে চীন। শুধু তাই নয় প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকে আমেরিকা তার বিশ্বজুড়ে সামরিক আধিপত্য থেকে খানিকটা সরে এসে নিজের অর্থনৈতিক দিকে ক্রমশ নজর দিতে শুরু করেছে, কারন দীর্ঘদিন আফগানিস্তান ও মধ্য প্রাচ্যে যুদ্ধ করার পর আমেরিকা একটু সরে এসেছে ঠিক এই কারনেই পাওয়ার গ্যাপিং তৈরি হয়েছে। যার জেরে দক্ষিণ চীন সাগর জুড়ে নিজের সামরিক ক্ষমতা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি করছে চীন।
যে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে এত ঝামেলা তার কারন সম্পর্কে একটু জানা যাক। ম্যাপে দক্ষিণ চীন সাগরের যদি অবস্থান দেখেন বুঝবেন এটি একটি মার্জিনাল সী বা একটি বড় মহাসাগরের ছোট একটি ভাগ। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট একটি ভাগ। চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই এবং ফিলিপিন্সের অধিকার রয়েছে এখানে। মালাক্কা প্রনালী হয়ে ভারত মহাসাগরের সাথে এবং ফরমোসা প্রনালী হয়ে পূর্ব চীন সাগরের সাথে যুক্ত দক্ষিণ চীন সাগরের সাথে। এশিয়ান দেশ গুলোর অর্থনীতির বড় অংশ নির্ভর করে এই দক্ষিণ চীন সাগরের উপর। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দশটি দেশ ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম কে একসাথে এশিয়ান দেশ বলা হয়। বিশ্বের মোট সমুদ্র বানিজ্যের তিনভাগের একভাগ নির্ভর করে দক্ষিণ চীন সাগরের উপর। প্রতিবছর তিন ট্রিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয় এখান দিয়ে। দক্ষিণ চীন সাগরে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, মাছ, অন্যান্য খনিজসম্পদের ভান্ডার আছে যা এই এলাকায় থাকা প্রতিটি দেশেরই অধিকার আছে। ঐতিহাসিক ভাবে দক্ষিণ সাগরে আমেরিকা এশিয়ান দেশ গুলো বিগত ৪০ বছর ধরে প্রচুর সাহায্য করছে। ২০১৭ তে আমেরিকা একাই এই ১০ টি এশিয়ান দেশে প্রায় ৩৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আমেরিকান নেভির যুদ্ধজাহাজ এখানে সবসময় মোতায়েন থাকে এইজন্য এশিয়ান দেশ গুলোকে কোনওদিন প্রতিরক্ষার উপরে তেমন ভাবতে হয় নি। কিন্তু বর্তমানে চীন এখানে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ চাইছে। চীন তাদের নাইন ড্যাশলাইন থিয়োরি নিয়ে এসেছে অর্থাৎ গোটা দক্ষিণ চীন সাগর জুড়ে নয়টি কাল্পনিক রেখা টেনে তার মধ্যের সমস্ত এলাকা চীন নিজেদের দাবি করছে এবং এই রেখার আশেপাশের দ্বীপ নিজেদের বলছে চীন যাকে দি গ্রেট ওয়াল অফ স্যান্ড ও বলা হয়। যেমন স্পারটলি দ্বীপ, প্যারাসেল দ্বীপ, প্রতাশ দ্বীপ এগুলো চীন নিজেদের বলে দাবি করেছে। চীন দাবি করে দ্বিতীয় শতকে শুরু হওয়া হ্যান সাম্রাজ্যে দক্ষিণ চীন সাগর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
চীন সরাসরি এখনো যুদ্ধে না গিয়ে একটা বড় গেম প্ল্যান সাজিয়েছে। আমেরিকার উপর এতদিন নির্ভরশীল ছিল এশিয়ান দেশগুলো কিন্তু ধীরে ধীরে চীন এশিয়ান দেশ গুলোতে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। এই মহূর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কে টপকে চীন এশিয়ান দেশ গুলোতে তৃতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী, প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। এতে বিপদে পড়েছে এশিয়ান দেশ গুলো কারন এই মহূর্তে এশিয়ান দেশ গুলো প্রতিরক্ষার জন্য আমেরিকার উপর এবং আর্থিক ভাবে চীনের উপর নির্ভরশীল, সুতরাং তারা যাবে তো যাবে কোথায়? সুতরাং বুঝতেই পারছেন চীনের পরিকল্পনা কী?? কিন্তু এই পরিকল্পনা কিন্তু রাতারাতি হয় নি চীন প্রথমে নিজের অর্থনীতি শক্তিশালী করেছে তারপর নিজেকে সামরিক দিকে শক্তিশালী করছে। আর দক্ষিণ চীন সাগরেরে মত সোনার খনি চীন কখওনই ছাড়বে না।
চীন ইতিমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগর জুড়ে নিজের সামরিক ক্ষমতা যথেষ্ট মজবুত করেছে এবং এখনও করেই যাচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগর জুড়ে চীনের আগ্রাসনের ব্যাপারে একটু বলি
** চীন পুরো দক্ষিণ চীন সাগর জুড়ে প্রচুর কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করছে।
** এই সমস্ত দ্বীপে চীন রানওয়ে ও হ্যাঙ্গার তৈরি করে তাদের যুদ্ধ বিমান মোতায়েন রেখেছে।
** সমস্ত দ্বীপে সারভিলেন্স রেডার, কমিউনিকেশন সিস্টেম ও এয়ারডিফেন্স সিস্টেম এবং মিসাইল লঞ্চ সিস্টেম রয়েছে।
** চীন তাদের কোস্ট গার্ড বা উপকূল রক্ষী বাহিনীকে এখানে মোতায়েন রেখেছে।
** এমনকী এটাও শোনা গেছে চীন স্থানীয় জেলেদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এখানে রেখেছে।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে দক্ষিণ চীন সাগর চীন সহজে ছাড়বে না। এতদিন আমেরিকা নিজেদের নেভির জোরে এই এলাকা আন্তর্জাতিক বানিজ্য জাহাজ গুলোর জন্য নিরাপদ রেখেছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে। এদিকে এশিয়ান দেশ গুলো চীনের উপর অর্থনৈতিক নির্ভরতার জন্য আমেরিকা ও চীনের মধ্যে শুরু হওয়া ট্রেড ওয়ারের মধ্যে কোন পক্ষেই না গিয়ে তৃতীয় কোন নিরপেক্ষ শক্তিকে এই এলাকায় চাইছে আর সেটা ভারতের থেকে বড় কেউ হতেই পারে না। কারন দক্ষিণ চীন সাগর পুরো চীনের অধীনে চলে গেলে এশিয়ান দেশ গুলোর পর সবচেয়ে বেশী ক্ষতি কোন দেশের হয় তা হচ্ছে ভারত। কারন দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে মালাক্কা প্রনালী দিয়ে ভারত মহাসাগরে সহজেই প্রবেশ করতে পারবে চীনা নৌসেনা। তাছাড়া মালাক্কা প্রনালী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভারতের কাছে এখান দিয়ে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয় ভারতের। শুধু ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা দিয়ে ভারতের বছরে ৫৫ শতাংশ বানিজ্য হয় এবং দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে বছরে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয় ভারতের। সুতরাং নিজেদের সামুদ্রিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য ভারত এগিয়ে বসতে বাধ্য। সবচেয়ে বড় কথা এই মহূর্তে এশিয়ান দেশ গুলো সহ ভারতের একার পক্ষে চীনের বিশাল নেভাল ফোর্স কে আটকানো অসম্ভব। যার জন্য একটাই পন্থা সেটা হচ্ছে সমস্ত দেশ এক হয়ে চীনের বিরুদ্ধে জোট গঠন করা। দক্ষিণ চীন সাগর জুড়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি সামরিক জোট গঠন সময়ের অপেক্ষা। ইতিমধ্যে এই দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেছে ভারত।
ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মধ্যে একটি জোট গঠন হয়েছে যাকে কোয়াড বলা হয়। কিন্তু এশিয়ান দেশগুলোকে নিয়েও কোয়াডের মতন একটি জোট গঠন দরকার চীনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনতন্ত্রিক দেশ ভারত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জন্য সম্পূর্ণ নতুন স্ট্রাটেজি তৈরি করেছে যার অন্যতম হচ্ছে অ্যাক্ট ইস্ট ও এক্সটেন্ডেড নেবারহুড নীতি। ভারত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলোর সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে এবং জাতিসংঘে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে নির্দিষ্ট আইন তৈরির জন্য আবেদনও করেছে যার সরাসরি বিরোধিতা করেছে চীন। গত দুদশক ধরেই দক্ষিণ চীন সাগরে নিজেদের উপস্থিত নিয়মিত বজায় রাখছে। ভারত তার ক্রমবর্ধমান নৌ সক্ষমতা প্রদর্শন এবং স্থানীয় দেশগুলির আস্থা অর্জনের জন্য ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো তার নৌবাহিনীকে দক্ষিন চীন সাগরে মোতায়েন করেছিল।
ভিয়েতনামের ক্যাম রাহন বে, ফিলিপাইনের সোবিক উপসাগর, জাপানের সাসেবো, দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান, রাশিয়ার ভ্লাদিভোস্টক এবং মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্লিং সহ বেশ কয়কেটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে ভারতীয় নৌসেনার জাহাজগুলি নিয়মিত যাতায়াত করে। সম্প্রতি নিজেদের নেভাল পাওয়ার বোঝাতে ভারতীয় নৌবাহিনী তার যুদ্ধজাহাজ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর সহ আরও পূর্ব দিকে মোতায়েন করা শুরু করেছে। গত বছর, একটি গাইডেড-মিসাইল ডেস্ট্রয়ার এবং একটি মিসাইল ফ্রিগেট সহ চারটি জাহাজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ চীন সাগর এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েন করা হয়েছিল। পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্য ভারতীয় নৌসেনা এই এলাকায় বিভিন্ন দেশের নৌসেনার সাথে নিয়মিত এক্সারসাইজ না সামুদ্রিক মহড়া অনুশীলন করে। ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম এবং সিঙ্গাপুরের মতো বেশ কয়েকটি স্থানীয় দেশের সাথে যৌথভাবে ভারত সামুদ্রিক মহড়া করে। তাছাড়াও থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপিন্সের মত দেশের নৌবাহিনী ভারতীয় নেভির সাথে যৌথভাবে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে ১৯৯৫ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হওয়া মিলান এক্সারসাইজে অংশ নেয়। ভারত এবছর দক্ষিণ কোরিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে নেভাল এক্সারসাইজের জন্য। নিকোবরের ক্যাম্পবেল উপসাগরে ভারত ২০১২ সালে ডীপ ওয়াটার ফেসিলিটি তৈরি করেছে যা দক্ষিণ চীন সাগর সহ আন্দামান নিকোবরের কাছে চীনের গতিবিধির উপর নজর রাখতে সাহায্য করে। এই অঞ্চলে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হচ্ছে সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুর ভারতের সাথে ২০০৩ সালে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি এবং ২০০৭ সালে যৌথ সামরিক অনুশীলন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছর হওয়া ভারত ও সিঙ্গাপুর নৌবাহিনীর মধ্যে সিঙ্গাপুর ইন্ডিয়া মেরিটাইম দ্বিপাক্ষিক নেভাল এক্সারসাইজ (সিমবেক্স) হয় যা এই অঞ্চলে ভারতের নৌ বাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি তে সাহায্য করে।
তবে বর্তমানে ইউরোপে যুদ্ধের ফলে এবং আমেরিকার কিছুটা পিছিয়ে আসার কারনে ভারত এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সত্যি কথা বলতে কী বিশাল চাইনিজ নেভির ফ্লীট কে আটকানোর মত যথেষ্ট যুদ্ধজাহাজ এখনও পর্যন্ত ভারতের কাছে যথেষ্ট পরিমানে নেই। যে ভাবে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা নেভির প্রভাব বাড়ছে তাতে পূর্ব ভারত মহাসাগর নিয়ে আমাদের যথেষ্ট ভাবতে হবে। চীনকে সরাসরি যুদ্ধের জন্য না উসকিয়ে নিজেদের সামরিক ক্ষমতা বাড়িয়ে এবং এশিয়ান দেশগুলোর সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে একটি স্থায়ী সমাধান করা দরকার। দক্ষিণ চীন সাগরে ভারত নিজেদের ক্রমাগত অবস্থান বাড়ানো সত্বেও চীনের সমুদ্রিক আগ্রাসনের ভারতকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
দক্ষিণ চীন সাগরে সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে কৌশলগত ভাবে চীনকে কাউন্টার করতে ভারতের নির্দিষ্ট কীছু পদক্ষেপ দরকার:—
১) বিশাল চাইনিজ নেভাল ফ্লীটের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলে কোন দেশরই একা চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সামরিক সক্ষমতা নেই এই কথা মাথায় রেখে স্থানীয় দেশগুলির সাথে একটি জোট শক্তি তৈরি করা দরকার যা চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং দক্ষিণ চীন সাগর সহ ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব বিস্তার রোধ করবে।
২) আরও একটা ব্যাপার মাথায় রাখা দরকার শুধু নিয়ম মাফিক বছরে নিয়মিত নেভাল এক্সারসাইজ করে সামরিক জোট গঠন সম্ভব নয়। এরজন্য প্রতিরক্ষা সহ দেশগুলোতে অর্থনৈতিক ভাবে বিনিয়োগ ও দরকার। যেমন এখন সমস্ত এশিয়ান দেশগুলো নিজেদের সামরিক ক্ষমতা উনয়নে নজর দিয়েছে। ঠিক এই জায়গাটার সুযোগ নিতে হবে ভারতকে। ভারতের উচিত নিজেদের আধুনিক অস্ত্র ও টেকনোলজি বিক্রি করা এই দেশগুলোকে। ভারতকে নিজেদের নিরাপত্তা ও স্টাট্রেজিক সম্পর্কের কথাও মাথায় রাখতে হবে। তবে ভারত এই ব্যাপারে কিন্ত বর্তমানে কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে ভারত প্রায় ৩৭৬ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ফিলিপিন্সকে ব্রাহ্মস মিসাইল বিক্রি করেছে এবং ভবিষ্যতে ভিয়েতনাম সহ আরও কিছু দেশ ব্রাহ্মস ক্রয় করতে পারে।
৩) চীন ইতিমধ্যে এই এলাকা জুড়ে তার একটি নতুন কুটনৈতিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করছে কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতের অবস্থান এই অঞ্চলে ততটা শক্ত নয় এখনও। ভারতের বৈদেশিক নীতিতে এখনও ইউরোপ, আমেরিকা যতটা প্রাধান্য পায় ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল ততটা পায় না। এর অন্যতম প্রধান কারন হচ্ছে অনেক সময় এই সব এলাকায় নিযুক্ত কুটনৈতিক অফিসারদের এইসব অঞ্চল সম্পর্কে সাধারন জ্ঞান থাকে না যার জন্য এদের দ্বারা ভালোর থেকে খারাপ বেশী হয়। সেইজন্য কুটনৈতিক ভাবে এই এলাকায় ভারতের প্রভাব বিস্তার দরকার যা ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে ভারত সরকার।
৪) দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলো অর্থনৈতিক কারনে চীনের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ভারতের উচিত ঠিক এইখানে তাদেরও কাজ করা। তাই সময় এসেছে ভারতীয় প্রাইভেট কোম্পানি গুলোর জন্য বিশেষ কিছু প্যাকেজ তৈরি করার যার দ্বারা সংস্থা গুলি দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। ভারতের উচিত সংস্থা গুলির জন্য বিশেষ কিছু কর ছাড় দেওয়া এবং লোন দেবার ব্যাবস্থা করা যাতে দক্ষিণ চীন সাগর এলাকায় ভারতের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়, একমাত্র এভাবেই চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে। কারন চীনের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের থেকে তাদের অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জ করা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের। কারন একবিংশ শতাব্দীতে দুটি পরমানু শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে সাধারণত সরাসরি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের থেকে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সবচেয়ে বেশী কার্যকারী।
৫) এখন পর্যন্ত, এই ফ্রন্টে আঞ্চলিক দেশগুলির প্রতি ভারতীয় সমর্থন কম এবং যা আছে তা প্রধানত মৌখিক। এখন সময় এসেছে ভারতের একটি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহন করার বিশেষত আন্তর্জাতিক আদালত এবং অন্যান্য আইনি প্রতিষ্ঠানে চীনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের চেষ্টা করা আঞ্চলিক দেশগুলিকে সমর্থন করা।
৬) চীনের তুলনায় এই অঞ্চলের খুব কম শিক্ষার্থীই ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এটাই সেই সময় যখন ভারতের উচিত স্কলারশিপ এবং অন্যান্য ধরণের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার। এর জন্য নয়াদিল্লিকে তার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে আরও ভারতীয় বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে হবে।
৭) চীনের তুলনায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে ভারতের জনসংযোগ ক্ষমতা অনেকটাই কম। কিভাবে এশিয়ান৷ দেশগুলোতে ভারত নিজের সাংস্কৃতিক ও সামজিক দিকটি বৃদ্ধি করবে সেই ব্যাপারে ভাবতে হবে।
৮) খুব কম ভারতীয়ই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ভ্রমনে যায়। ভারতীয়দের ক্ষেত্রে বিদেশ ভ্রমন মূলত ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যেই আবদ্ধ প্রধানত। সুতরাং ভারত সরকার কে নির্দিষ্ট দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভ্রমনের জন্য বিশেষ কিছু প্যাকেজের কথা ভাবা দরকার যাতে এই এলাকায় ভারতীয় জনসংযোগ বাড়ে।