ইউক্রেনকে কেন আমেরিকার হাতের পুতুল বলে?
রাজেশ রায়: রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রতিনিয়ত চরম থেকে চরম পর্যায়ে চলে গেছে। যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত। বেলারুশে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করার ব্যাপারে একটি শান্তি আলোচনার আয়োজন হয়েছিল। রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধি দল সেখানে বৈঠকে বসেনও কিন্তু বৈঠক ব্যার্থ হয়ে যায়। যতদূর জানা গেছে এই বৈঠকে ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির জেলেনেস্কির নির্দেশে ইউক্রেনের প্রতিনিধি দল দাবি করে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ও ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকেভ ছেড়ে রাশিয়া কে চলে যেতে হবে এবং সাথে সাথে ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করেছিল সেটা ফিরিয়ে দিতে হবে। রাশিয়া ক্রিমিয়া ফিরিয়ে দিতে রাজি নয় সাথে সাথে রাশিয়ার এটাও দাবি ছিল ইউক্রেন যাতে ন্যাটোতে যোগ না দেয়। উভয়পক্ষেরই অনড় মনোভাবের কারনে শেষ পর্যন্ত শান্তি আলোচনা ব্যাহত হয়। রাশিয়ার আরও দাবি বর্তমান যে ইউক্রেন সরকার আছে তা অ্যান্টি রাশিয়ান এবং আমেরিকার হাতের পুতুল।
খারকিভের কারাজিন ন্যাশানাল ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ সোসিওলজির বিল্ডিং যাগে ইস্কান্দার এম ব্যালিস্টিক মিসাইল অ্যাটাক হয়েছে। এখানে ইউক্রেন সেনা লুকিয়ে রাশিয়ান গ্রাউন্ড ফোর্সের উপর অ্যাটাক করছিল। খারকিভে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর অ্যামো ডিপো সহ ইউক্রেনের মেইন ব্যাটেল ট্যাঙ্ক টি-৮৪ অপলোট তৈরির কারখানা ধ্বংস করে দিয়েছে রাশিয়া। তাছাড়া খারকিভের ইউক্রেন সেনার গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি সেন্টার উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়া কিয়েভ ও খারকেভে মূলত তাদের ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক মিসাইল ও মাল্টিপেল রকেট লঞ্চার দিয়ে অ্যাটাক করছে৷ এছাড়া খোরসান, ওডেসা, মনিরুপোল সহ আরও অনেক শহরেও রাশিয়ান সেনা রয়েছে এসব জায়গায় মূলত রাশিয়ান নেভি তাদের ক্যালিবার ক্রুজ মিসাইল অ্যাটাক করছে। রাশিয়ান এয়ারফোর্স এর সুখোই ৩৪ বোম্বার কিয়েভ শহরে বোম্বিং শুরু করেছে। খারকেভের প্রশাসনিক ভবন উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া ক্যালিবার ক্রুজ মিসাইল দিয়ে জানা গেছে এই ভবনের ভেতর প্রচুর ইউক্রেনীয় সেনা লুকিয়ে ছিল।
ইউক্রেন সেনাবাহিনীর উত্তর কম্যান্ডের প্রধান বেস ধ্বংস করে দিয়েছে রাশিয়া। এখান থেকে পুরো উত্তর কম্যান্ড সহ অনেক প্রদেশকে নিয়ন্ত্রণ করত ইউক্রেন। ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক মিসাইলে এটা উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া। গত ছয়দিনে প্রায় ৪৫০+ ব্যলেস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল হামলা করেছে রাশিয়া ইউক্রেনে। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ বিমান ইউক্রেনের অ্যান্টোনেভ এএন-২২৫ মারিয়া ধ্বংস করে দিয়েছে রাশিয়া। কিয়েভের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বিমানটি ছিল। রাশিয়ান ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক মিসাইল আক্রমনে এটা ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা। এর সাথে ইউক্রেনের আরও কীছু গুরুত্বপূর্ণ বিমান ধ্বংস হয়ে গেছে। আজারবাইজান বায়ুসেনার কিছু মিগ-২৯ যুদ্ধ বিমান ওভারহলিং এর জন্য ইউক্রেনে ছিল সেগুলোও ধ্বংস হয়ে গেছে সাথে সাথে ইউক্রেনের ইভানো ফ্রাঙ্কভিস্ক এয়ারবেসে থাকা ইউক্রেন বায়ুসেনার কিছু মিগ-২৯ গ্রাউন্ডেড অবস্থাতেই রাশিয়ান ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক মিসাইলের আঘাতে নষ্ট হয়ে গেছে। এই ছয়দিনে রাশিয়ান আক্রমনে ইউক্রেনের প্রায় ১৪০০+ গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি স্থাপনা, ৩৮ টি এস-৩০০ ও বাক -এম১ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম, ৫৬ টি রেডার, ৫০০+ ট্যাঙ্ক, ৬৬ টি মাল্টিপল রকেট লঞ্চার, ৬ টি বায়রাখাতার টিবি-২ ড্রোন, ১২৩ টি আর্টিলারি ও ৪৫ + এয়ারক্রাফট ধ্বংস হয়ে গেছে। অসংখ্য ইউক্রেন সেনা প্রান হারিয়েছে ও গ্রেফতার হয়েছে। ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধাস্ত্র কমে আসছে ইউক্রেনের। এটাও শোনা যাচ্ছে রাশিয়ান সেনা ইউক্রেনে সেনার ছদ্মবেশে কিয়েভে প্রবেশ করছে।
ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে সাধারণ জনগন রাশিয়ান সেনাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে বটে কিন্তু বেশীদিন এভাবে চলবে না। ন্যাটো ও আমেরিকা প্রচুর অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে ইউক্রেনকে কিন্তু সেই অস্ত্র চালানোর মত দক্ষ লোকের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে ইউক্রেনে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি জেলে বন্দী থাকা আসামীদের ছেড়ে দিয়ে এই শর্তে যে ইউক্রেনের হয়ে যুদ্ধ করতে হবে। ইউক্রেনে জাপোরোজাহি প্রদেশের ভাসিলিয়েভকা শহর, খোরাসন শহরের দক্ষিণ ভাগ পুরোপুরি রাশিয়ান নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে।
এর মধ্যেই রাশিয়ার ভয়ে পিছিয়ে এসেছে ন্যাটো। ন্যাটো প্রথমে জানিয়েছিল তারা এয়ার সাপোর্ট দেবে ইউক্রেন কে অর্থাৎ যুদ্ধবিমান দেবে। পোল্যান্ড ২৮ টি মিগ ২৯, বুলগেরিয়া ১৬ টি মিগ ২৯ সহ ১৪ টি সুখোই ২৫ ও স্লোভাকিয়া ১২ টি মিগ ২৯ সহ ৭০ টি এয়ারক্রাফট দেবার কথা ঘোষনা করেছিল। তারপরই আমেরিকান ইনটেলিজেন্স এজেন্সি সিআইএ জানিয়েছে ন্যাটো এমন করলে রাশিয়া পরমানু হামলা করতে পারে, যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করবে। এরপরেই পিছিয়ে আসে ন্যাটো। এরপর ন্যাটো জানিয়েছে তারা কোন ফাইটার জেট দেবেনা ইউক্রেনকে। ইউক্রেনের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দখলের দাবি করেছে রাশিয়া। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নজরদারি সংস্থাকে রাশিয়া জানিয়েছে, জাপোরিজ্জিয়া শহরের কাছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে ডিনিপার নদীর তীরে এটি অবস্থিত। এইভাবে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে ইউক্রেন অনেক ভুগতে পারে। যুদ্ধের মধ্যেই সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছে ভারতীয় ছাত্র ছাত্রীরা। ইউক্রেনে বহু ভারতীয় স্টুডেন্ট আটকে আছে। তাদের কে উদ্ধার করার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অপারেশন গঙ্গা শুরু করেছে যাতে বিমানে করে স্টুডেন্টদের নিয়ে আসা হচ্ছে ইউক্রেনের পাশ্ববর্তী দেশ গুলো থেকে।
ইউক্রেনের পাশ্ববর্তী পোল্যান্ড, যারা ভারতীয় স্টুডেন্টদের বিনা ভিসায় প্রবেশাধিকার দিয়েছে, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, মলডোবা থেকে বিদ্যার্থীদের নিয়ে আসা হচ্ছে। ভারতীয় বায়ুসেনা এই অপারেশনে অংশ নিয়েছে। ভারতীয় বায়ুসেনার সি-১৭ গ্লোবমাস্টার বিমান স্টুডেন্টদের নিয়ে আসছে। স্টুডেন্ট সহ প্রায় ২০,০০০ ভারতীয় ইউক্রেনে আটকে আছে যাদের মধ্যে পূর্ব ইউক্রেনের খারকেভ, ক্রমিয়া, সামি শহরে প্রায় ৪০০০ ভারতীয় স্টুডেন্ট আছে যাদের উদ্ধার করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গতকালকের তথ্য অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত অপারেশন গঙ্গায় প্রায় ১৭,০০০ ভারতীয়কে দেশে নিরাপদে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এর মধ্যেই সবচেয়ে খারাপ খবর অত্যন্ত দুঃখ জনক ব্যাপার খারকেভে হেভি শেলিং এর কারনে এক ভারতীয় ছাত্র প্রান হারিয়েছে। নভীন নামের এই ছাত্রের বাড়ি কর্নাটকে, সে খাবার কিনতে রাস্তায় বেড়িয়েছিল তখনই প্রান হারায়। এই মহূর্তে গোটা পূর্ব ইউক্রেন সহ রাজধানী কিয়েভ প্রায় ধ্বংস স্তূপ পরিনত হয়েছে। প্রায় ৭ মিলিয়ন বা ৭০ লক্ষ ইউক্রেন বাসী ঘর ছাড়া এবং জাতিসংঘ জানিয়েছে ১২ মিলিয়ন বা ১ কোটি ২০ লাখ ইউক্রেন বাসীর জন্য সাহায্য দরকার।
ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদেবার জন্য আর্জি জানিয়েছে। ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি এর একটি চিঠিও দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে ইতিমধ্যে এটা গ্রহনও করে নিয়েছে, এখন ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করার পক্রিয়া চলছে। ১৯৯৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তৈরি হয় নেদারল্যান্ডসে। প্রথমে ২৮ টি দেশ সদস্য ছিল কিন্তু ২০২০ সালে ব্রিটেন বেড়িয়ে যায় এখান থেকে সেই জন্য এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে ২৭ টি দেশ রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এখন প্রধান কার্যালয় বেলজিয়ামে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে ক্রমান্বয়ে সাহায্য করে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাঠিয়েছে। তাছাড়া ইউক্রেনের প্রায় ৮,৩৬,০০০ রিফিউজিদের আশ্রয় দিয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢুকলে ইউক্রেন প্রচুর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পাবে।
রাশিয়ার ইউক্রেনে এই যুদ্ধ শুরু করাতে ইতিমধ্যেই বিশ্বে প্রায় একঘরে হয়ে পড়েছে রাশিয়া। ইতিমধ্যেই প্রচুর স্যাংশান বা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে রাশিয়া। এই মহূর্তে উত্তর কোরিয়া ও ইরানের পর রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ নিষেধাজ্ঞা যুক্ত দেশ:–
** ফিফা রাশিয়া কে ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ থেকে বেড় করে দিয়েছে।
** বিশ্ব রাগবি সংস্থা রাশিয়া ও বেলারুশকে সমস্ত আন্তর্জাতিক রাগবি ইভেন্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ করেছে।
** আন্তর্জাতিক জুডো ফেডারেশনের সম্মানীয় প্রধান পদ থেকে রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে নিষ্কাশিত করা হয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিন নিজে একজন ব্ল্যাক বেল্ট প্রাপ্ত জুডো খেলোয়াড়।
** ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ান মিডিয়া স্পুটনিক ও আরটি কে নিষিদ্ধ করেছে।
** জার্মানির লজিস্টিক সাপ্লাই জায়েন্ট ডিএইচএল রাশিয়া ও বেলারুশে ডেলিভারি দেবেনা বলে জানিয়েছে।
** ইউরোপে রাশিয়ান অলিগার্চদের প্রাইভেট জেট, ইয়ট ও বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট সিজ করা হচ্ছে।
** অ্যাপেল তাদের কোন প্রোডাক্ট রাশিয়াতে বিক্রি করবে না বলে জানিয়েছে।
** আমেরিকান অ্যাভিয়েশন জায়েন্ট বোয়িং রাশিয়ান এয়ারলাইন্সকে সাপোর্ট দেবে না বলে জানিয়েছে।
** রাশিয়া- তুর্কী গ্যাস পাইপলাইন থেকে বেরিয়ে গেল ইটালির অয়েল জায়েন্ট ইনি।
** হলিউড তাদের কোন সিনেনা রাশিয়াতে রিলিজ করবে না বলে জানিয়েছে।
** আন্তর্জাতিক টেনিস ফেডারেশন রাশিয়া ও বেলারুশকে টেনিস থেকে নিষিদ্ধ করেছে।
** ফ্রান্সের কন্টেইনার শিপিং গ্রুপ সিএমএ সিজিএম রাশিয়ান বন্দরে যাবে না বলে জানিয়েছে।
** বিশ্ব অ্যাথলেটিক সংস্থা রাশিয়ান অ্যাথলেটিকসদের নিষিদ্ধ করেছে।
** অ্যাডিডাস রাশিয়ান ফুটবলের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
** ন্যাটো সদস্য ভুক্ত ২৭ টি দেশ সহ আমেরিকা তাদের এয়ারস্পেস রাশিয়ার জন্য বন্ধ করে দিয়েছে।
** রাশিয়ার নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস লাইন প্রজেক্ট আপাতত বন্ধ করে রেখেছে জার্মানি।
** ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা ও ব্রিটেন সুইফট নেটওয়ার্ক থেকে রাশিয়ান ব্যাঙ্ক গুলোকে বের করে দিয়েছে।
** রাশিয়া এই মহূর্তে তার ৬৩০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ব্যবহার করতে পারবে না। এই অর্থ দিয়ে রাশিয়া শুধু সমমূল্যের রুবেল কিনতে পারবে।
** রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে ডলারে ট্রানজেকশন করা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
** রাশিয়ার সেমিকন্ডাক্টর, লেজার, নেভিগেশন, টেলিকমিউনিকেশন, সেন্সর, অ্যাভিয়েশন ও মেরিটাইম টেকনোলজির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
** রাশিয়ার ১৩ বড় কোম্পানি যার মধ্যে রয়েছে এনার্জি জায়েন্ট গ্যাজপ্রোম সেবার ব্যাঙ্ককে আমেরিকাতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
** ব্রিটেন রাশিয়ার সেবার ব্যাঙ্ক সহ বড় বড় ব্যাঙ্ককে নিষিদ্ধ করেছে এবং ব্রিটেনে তাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে।
** নিউজিল্যান্ড রাশিয়ার সাথে সমস্ত বানিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
** অস্ট্রেলিয়া রাশিয়ান অয়েল গ্যাস নেবে না বলে জানিয়েছে।
এসব কারনে রাশিয়ান অর্থনীতি পুরো ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। রাশিয়ান রুবেল ডলারের বীপরীতে ৩০ শতাংশ কমে গেছে যা রেকর্ড। এই মহূর্তে ১ টাকা = ১.৪৯ রাশিয়ান রুবেল যা সত্যি করেই একটা রেকর্ড।
আমেরিকা ও ন্যাটো অফিসিয়ালি রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষনা করেনি কিন্তু অস্ত্র সাহায্য পাঠাচ্ছে এবং সবচেয়ে বড় কথা তারা রাশিয়ার উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞার চেন তৈরি করে রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে যার কথা উপরে আগেই জানিয়েছি। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অনেক রাশিয়ান ব্যাঙ্ককে সুইফট নেটওয়ার্ক থেকে বার করে দেওয়া। সুইফট বা সোশাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টারব্যাঙ্ক ফাইন্যানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ১৯৭৩ সালে তৈরি হওয়া একটি মাধ্যম যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্তরে আর্থিক লেনদেন হয়। এই নেটওয়ার্কক থেকে রাশিয়া কে বের করে দেবার অর্থ রাশিয়ান অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব আসা। রাশিয়াকে সুইফটের বিকল্প কোনও কিছু খুঁজে বার করতেই হবে যা তদের লেনদেনে সাহায্যে করবে। আর এক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ভারত এই মহূর্তে বিশ্বের প্রথম সারির আর্থিক ভাবে শক্তিশালী দেশ গুলোর মধ্যে অন্যতম এবং ভারতের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক বহুদিনের। সুইফটের একটা বিকল্প হতে পারে ইউপিআই বা ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস যা তৈরি করেছে এনপিসিআই বা ন্যাশানাল পেমেন্ট করপোরেশন অফ ইণ্ডিয়া।
সুইফট তৈরি হয়েছিল টেলেক্স নামে একটি সিস্টেম কে রিপ্লেস করবার জন্য। সুইফট মূলত একটি বেলজিয়াম সংস্থা যার মাধ্যমে গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রায় ১১,০০০ ব্যাঙ্ক যুক্ত আছে। সুইফট বিশ্বজুড়ে পেমেন্টস ম্যাসেজ ট্রান্সফার করে। সুইফট তৈরির পেছনে ছিল আমেরিকা ও ইউরোপীয়ান ব্যাঙ্কগুলি। বিশ্বজুড়ে ৩৫০০ ব্যাঙ্কের আওতায় আছে সুইফট যা নিয়ন্ত্রণ করে জি-১০ দেশ গুলোর সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এবং ইউরোপীন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্ক অফ বেলজিয়ামের সবচেয়ে বেশী শেয়ার আছে সুইফটে। এছাড়াও ইউরোপীয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড, জাপান ব্যাঙ্ক, আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম সুইফটের গুরুত্বপূর্ণ ভাগ। সুইফট বেলজিয়াম আইন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কে ফলো করে। অর্থাৎ স্পষ্ট বুঝতে পারছেন সুইফটের উপর পশ্চিমি দেশগুলোর প্রচুর প্রভাব রয়েছে। আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে সুইফটের সবচেয়ে বড় ডাটা সেন্টার রয়েছে। সুতরাং এখানে আমেরিকার একটি বড় প্রভাব রয়েছে।
আমেরিকার পর রাশিয়া হচ্ছে সুইফটের সবচেয়ে বড় ব্যাবহারকারক। রাশিয়ার প্রায় অর্ধেক বা ৩০০ অর্থনৈতিক সংস্থান সুইফটে যুক্ত। সুইফট কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার একটা উদাহরণ দিই ২০১২ সালে ইরানকে যখন সুইফট থেকে বের করে দেওয়া হয় ইরান তার বৈদেশিক বাণিজ্য ও তেল রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশ হারিয়েছিল। ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ক্রিমিয়া দখল করে তখনও রাশিয়াকে সুইফট থেকে বের করবার কথা হচ্ছিল তখন রাশিয়া সিস্টেম ফর ট্রান্সফার অফ ফাইন্যান্সিয়াল মেসেজ নামে একটা সিস্টেম তৈরি করেছিল। কিন্ত এই সিস্টেম এতটা কার্যকর হয়নি কারন ২০২০ সাল পর্যন্ত এই সিস্টেমে মাত্র ২৩ দেশের ৪০০ টি সংস্থা যুক্ত হয়েছে। চীনও তাদের নিজস্ব সিআইপিএস বা ক্রস বর্ডার ইন্টারব্যাঙ্ক পেমেন্ট সিস্টেম তৈরি করেছে যদি এটা কাজ করে তাহলে বিশ্বজুড়ে ডলারের আধিপত্য কমবে। কিন্তু এটা এখনও সুইফটের বিকল্প হতে পারবে না কারন সুইফটে ট্রানজাকশন হয় মূলত ডলারের মাধ্যমে তার বিকল্প চাইনিজ মুদ্রা ইউয়ান হতে পারে না। এখন প্রশ্ন আসে সুইফটের বিকল্প কে হতে পারে? এখানেই আসে ভারতের নাম।
ভারতের ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমে রেজোলিউশন তৈরি করে দিয়েছে ইউপিআই। ২০১২ সালে ইরানকে যখন সুইফট থেকে বের করে দেওয়া হয় তখন ভারত অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কারন ভারত ইরান থেকে অনেক তেল কিনত। তাই ভারত একটি বিকল্প পেমেন্ট সিস্টেম ইউপিআই তৈরি করেছে। ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরের পেনাও এর সাথে ইউপিআই এর সংযুক্ত করন হয় যার ফলে ইনস্ট্যান্ট পেমেন্ট অনেক সোজা হয়ে যায়। ইউপিআইএর মাধ্যমে পেমেন্ট করার ফলে ট্রানজাকশন চার্জ ৫ শতাংশ থেকে কমে ২ শতাংশ হয়ে যায়। ইউপিআই সুইফটের থেকে পেমেন্টে কম সময় লাগায় এবং এটি ইউজার ফ্রেন্ডলি। একটু কিছু ইনোভেশন করে সুইফটের বিকল্প হিসাবে ইউপিআই কে ব্যবহার করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের অবস্থান খুব শক্ত ও নিরপেক্ষ। তাছাড়া সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে ভারত খুব বড় নাম সুতরাং যে কোন দেশ অনেক সহজেই ভারতীয় সিস্টেম কে ব্যবহার করতে পারে। অনেক দেশের সাথেই আলোচনা চলছে ভারতের ইউপিআই প্রযুক্তি রপ্তানির জন্য। ভারত রাশিয়ার অন্যতম বড় অস্ত্র ক্রেতা সুতরাং সুইফটের বদলে ইউপিআই খুব একটা ভাল অপশন রাশিয়া ও ভারত উভয়ের জন্যই।
তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের এই যুদ্ধে রাশিয়ার একটি রননীতি খুব আশ্চর্যজনক। একটু ভাল করে লক্ষ করলে দেখবেন রাশিয়া সব পুরোনো অস্ত্র নিয়ে এসেছে ইউক্রেনে। যেমন ধরুন রাশিয়ার প্রধান ব্যাটেল ট্যাঙ্ক টি-৯০ থাকতেও, এমনকী উন্নত টি-১৪ আর্মাটা থাকতেও রাশিয়া নিয়ে এসেছে পুরোনো টি-৭২ ট্যাঙ্ক, এস-৪০০, এস-৫০০ এর মতন এয়ারডিফেন্স সিস্টেম থাকতেও রাশিয়া বাক এয়ারডিফেন্স সিস্টেম নিয়ে এসেছে। এস ইউ ৩৪, টিইউ ৯৫ এর মতন বোম্বার থাকতেও রাশিয়া পুরোনো এসইউ ২৭ নিয়ে যুদ্ধে এসেছে। আবার অ্যাডভান্সড এস ইউ ৩৫, এস ইউ ৩০ এর মতন যুদ্ধবিমান থাকতেও রাশিয়া মিগ ২৯, সুখোই ২৭ এর মতন বিমান ব্যবহার করছে। যেমন ধরুন এম আই ২৮ এর মতন হেলিকপ্টার থাকতেও ব্যবহার করছে কে ৫২ অ্যালিগেটরের মতন হেলিকপ্টার। যার একটাই অর্থ দাঁড়ায় মনে হয় রাশিয়া ইউক্রেন কে কোন শক্ত প্রতিপক্ষ হিসাবে ধরছেই না অথবা রাশিয়া পুরোনো জিনিস সব শেষ করে দিচ্ছে।