পৃথিবী

পরমানু বোমা তৈরির তথ্য চুরি করেছিল পাকিস্তান

নিজস্ব সংবাদদাতা: আবদুল কাদির খান পরিচিত পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক হিসাবে। তবে একসময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী এই কাদির খানের দিন মোটেই ভালো ভাবে কাটেনি শেষ বয়সে। ৮৪ বছর বয়স্ক এই পরমাণু বিজ্ঞানী পাকিস্থানে কার্যত গৃহবন্দি হয়ে এক অত্যন্ত নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেছেন। একা যেখানে ইচ্ছা চলাফেরার স্বাধীনতা তো পাননি এমনকি নিজের কন্যার সাথে সময় অব্দি কাটাতে পারেননি তিনি। ২০০৪ সালে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পরমাণু গবেষণার খবর বিভিন্ন দেশে হাতবদলের অভিযোগ ওঠার পর থেকেই আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছে তাকে। ২০০৯ সাল থেকে গৃহবন্দি করা হয়।

ঠিক কি অভিযোগ উঠেছিল কাদের খানের বিরুদ্ধে? ২০০৪ সালে তিনি নিজেই টিভিতে পাকিস্তানের পারমানবিক রহস্য অন্য দেশের কাছে বিক্রি করার কথা স্বীকার করেছিলেন। জানা যায় পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক কাদের খান পরমাণু বোমার মূল উপাদান ইউরেনিয়াম তৈরীর জন্য ডিজাইন থেকে শুরু করে হার্ডওয়ার এমনকি উপকরণ অব্দি সমস্ত সরবরাহ করেছিলেন ইরান, লিবিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মতো বিভিন্ন দেশে। তথ্য সামনে আসতেই গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের নির্দেশে গৃহবন্দি করা হয় তাকে।

প্রথম পরমাণু বোমা বানানোর জন্য ভারত যখন ১৯৯৭-৯৮ সালে নড়াচড়া শুরু করে তখনই সক্রিয় হয়ে ওঠেন পাকিস্তানের আবদুল কাদির খান। সেই সময় ভারত পরমাণু বোমা তৈরিতে সক্ষম হলে তার জবাব দেওয়ার জন্য রীতিমতো লেগে পড়ে উঠেছিল পাকিস্তান। ভারতের জবাব হিসেবে ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান ও ঘোষনা করে যে নিজেদের শক্তির পরিচয় দিতে শীঘ্রই কয়েকটি পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটাবে পাকিস্তান। উপমহাদেশে শান্তি বজায় রাখতে  পাকিস্তানকে বিস্ফোরণ না ঘটানোর জন্য সেই সময় বিভিন্নভাবে চাপ দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কাজ না হওয়ায় শতাধিক এফ-১৬ জঙ্গী বিমানসহ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও আর্থিক অনুদানের ও টোপ দেয় আমেরিকা। কিন্তু কিছুতেই গলেনি বরফ। শেষ পর্যন্ত ভারতের পরমাণু পরীক্ষার মাত্র দু সপ্তাহ পরই পাকিস্তান ১৯৯৮ সালের ২৮ মে একসঙ্গে ৫টি ও পরে ৩০ মে আরও ১টি অর্থাৎ মোট ৬ টি বিস্ফোরণ ঘটায় বেলুচিস্তানের চাগাই পর্বতে। পরবর্তীকালে জানা যাই পাকিস্তানের এই পরমাণু বোমা বানানোর পেছনে কাজ করেছে  ড. আবদুল কাদের খানের মাথা।

এই ড. আবদুল কাদের খানের পরমাণু বোমা বানানোর পরিকল্পনা এতোটাই রোমহর্ষক যে তা হার মানায় হলিউডের বড়ো বড়ো থ্রিলারকেও। বিজ্ঞানী ডাক্তার আব্দুল কাদের খানের ওপর বিস্তারিত তথ্য নিয়ে বই লিখেছেন আমেরিকার প্রখ্যাত বিজ্ঞানী রবার্ট এস. নরিস। কিভাবে পরমাণু বোমা তৈরি নকশা চুরি করে পাকিস্তানে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি সেই ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উল্লেখিত রয়েছে তার লেখায়। তার জীবনের বেশ কিছু অধ্যায়ের কথা উল্লেখ পেয়েছে এস নরিসের লেখায়।  জন্ম ভারতের ভূপালে হলেও দেশভাগের পর  ১৯৫২ সালে পিতা-মাতা সহ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে আসেন তিনি। পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার জন্য পাকিস্তান থেকে তিনি পাড়ি দেন জার্মানির বার্লিনে। সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর মেটালার্জিতে মাস্টার্স করেন নেদারল্যান্ড থেকে। পরে বেলজিয়াম থেকে ওই একই বিষয়ের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি পান তিনি। ১৯৬৪ সালে ইউরোপে পড়াশুনোকালিনই নেদারল্যান্ডের নাগরিক হেন্ডরিনা রিটারিংকের সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। ১৯৭২ সালে স্ত্রী নেদারল্যান্ডের নাগরিক হওয়ায় সুবাদেই নেদারল্যান্ড এবং ব্রিটেনের যৌথ পরিচালনায় আণবিক বোমা তৈরির মূল উপাদান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কারখানা ইউরেনকো’ এবং পরবর্তীকালে নেদারল্যান্ডের আলমেলোতে প্রবেশের সুযোগ পান তিনি। ডাচ ভাষায় দক্ষ হওয়ায় সেখানে তার মূল কাজ ছিল বোমা তৈরির যাবতীয় ডকুমেন্ট জার্মান ভাষা থেকে ডাচ ভাষায় অনুবাদ করা। এরই মধ্যে ১৯৭৪ সালের মে মাসে ভারত রাজস্থানের পোখরানে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালালে ড: খানের মনে পাকিস্তানের জন্য নিজস্ব পারমাণবিক বোমা তৈরির সুপ্ত ইচ্ছা প্রকাশ পায়। কোনো রকম বিলম্ব না করে সেই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তিনি তার পরিকল্পনার কথা চিঠিতে লিখে জানান। ভুট্টো একটি সুসংবাদের অপেক্ষায় ছিলেন। ফলে এর তিন মাসের মধ্যেই ডাক্তার খানের সাথে গোপন বৈঠক ডেকে তাকে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে উৎসাহ দেন তিনি। পরিকল্পনা মতো স্ত্রী ও দুই কন্যাকে সাথে নিয়ে তিনি নেদারল্যান্ড থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরীর প্রচুর অমূল্য নকশা এবং সরঞ্জাম সাপ্লাই এর তালিকা চুরি করে পাকিস্তানে পালিয়ে আসেন। পরে নেদারল্যান্ড সরকার ইন্টারপোলের সাহায্য নিয়ে বহু চেষ্টা করেও  ড. আবদুল কাদের খানকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। ইতিমধ্যেই ড. খান পাকিস্তান সরকারের পূর্ণ সহযোগিতায় খান রিচার্স লেবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে আণবিক বোমা বানানোর কাজে হাত দেন এবং সফলতার সাথে পারমাণবিক বোমা বানান। পরে ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচীর অধীনে হাতাফ, গৌরী, আবদালী, শাহীন প্রভৃতি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরী করে বিদেশে তিনি চোরের তকমা পেলেও পাকিস্তান থেকে তিনি পেয়েছিলেন বীরের সম্মান। কিন্তু, বেশিদিন টেকেনি তার এই বীর সম্মান। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো সেই সময় পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক ডাক্তার আব্দুল কাদেরের বিরুদ্ধে আমেরিকা অভিযোগ এনেছিল যে তিনি পরমাণু বোমা বানানোর যাবতীয় নকশা উত্তর কোরিয়ার লিবিয়া ও ইরানের পাচার করেছেন।

পশ্চিমী দেশগুলি চাপ বাড়ালে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০৪ সালে গৃহবন্দী করেন তাকে। কিন্তু তারপরেই আব্দুল কাদের টেলিভিশনে সকলের সামনে পরমাণু বোমা বিষয়ক গোপন তথ্য অন্যান্য দেশের কাছে ফাঁস করার কথাটি স্বীকার করে নিলে পারভেজ মোশাররফ তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা ঘোষণা করে নজর বন্দী করেন। তবে একদিন জাতীয় টেলিভিশনে সবার সামনে অভিযোগ স্বীকার করা এবং পরের দিনই সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান প্রধানের তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার এই ঘটনাটা পশ্চিমী দেশগুলির কাছে নাটক বলে মনে হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সেই সময় ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছিল পারভেজ মুশাররফের ওপর যাতে ডাক্তার কাদের খানকে আন্তর্জাতিক আদালতে সমর্পণ করেন তিনি। কিন্তু তাতে পারভেজ মোশাররফ কোনোরকম সাড়াশব্দ না দেওয়ায় অনেকেই মনে করেন পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের মুখে পড়ে কোনরকমে অবস্থা সামাল দিতে ডক্টর কাদের খানকে নিজেই সাজানো বিচার করেছেন তিনি। 

পারভেজ মোশাররফের ভূমিকা নিয়েও সেই সময় উঠেছিল নানা প্রশ্ন। তদন্ত সংস্থাকে তিনি ডক্টর খানকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি অব্দি দেননি তিনি। সেই সময় অনেকের সন্দেহ গিয়ে পড়েছিল আদপে মোশারফের ওপরেই। সেই সময় ড. কাদের খান ভুগছিলেন প্রোস্টেট ক্যান্সারে। দীর্ঘ পাঁচ বছর নজর বন্দী অবস্থায় নিঃসঙ্গ জীবন কাটানোর পরে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারীর প্রথম দিকে মুক্তি পান তিনি। পাকিস্তানের হাইকোর্ট কাদের খান সম্পর্কিত মামলায় রায় দেন যে তার বিরুদ্ধে ইরান উত্তর কোরিয়া লিবিয়ায় পরমাণু বোমা সম্পর্কে তথ্য পাচারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এমনকি আদালতের আদেশে সেই সময় মুক্তিও পান তিনি। ম্যাক কেলম্যান এর ‘এ কিউ খান’ সেই সম্পর্কে উঠে এসেছে বেশ কিছু কথা। তিনি তাঁর বইতে লিখেছেন ডাক্তার খান নয় বরং পরমাণু বোমার অস্ত্রোপাচার দলের সাথে যুক্ত ছিলেন সেই সময়ের পাকিস্তানের সামরিক প্রধান পারভেজ মোশাররফ এবং উচ্চপদস্থ বেশ কিছু সেনা। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করলে ডাক্তার খানকে বলির পাঁঠা বানিয়ে বলপূর্বক তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য আদায় করে নেওয়া হয়। এ বিষয়ে প্রথম থেকেই পশ্চিমী দেশগুলোর সন্দেহ থাকলেও থাকলেও পারভেজ মোশারফ এর সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো হওয়ায় এই বিষয়ে আর বেশি চাপ সৃষ্টি করা হয়নি। পাকিস্তান থেকে পারভেজ মোশাররফ সরকার বিদায় নিলে এই বক্তব্যকে সমর্থন করে মুখ খোলেন ডাক্তার খান। জানা যায় সত্যিই বলপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল তার কাছ থেকে।  মাত্র দু’বছর আগেই ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মাসে ঠিক কি কারণে এবং কিভাবে পাকিস্তানের পরমাণু বোমা বানানোর হার দ্রুত আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তা উল্লেখ করে‘ পাকিস্তানি নিউক্লিয়ার ফোর্সেস, ২০১৮’ নামক প্রতিবেদনটি তুলে ধরেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বিজ্ঞানীদের নিয়ে গড়ে ওঠা প্রভাবশালী সংগঠন ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টদের বিশিষ্ট কয়েকজন বিজ্ঞানীযেহ্যান্স এম. ক্রিস্টেনসেন, রবার্ট এস. নরিস ও জুলিয়া ডায়মন্ড প্রমুখ। প্রতিবেদনে আশঙ্কার সাথে তারা উল্লেখ করেন যে পাকিস্তানের স্বল্পপাল্লার নসর’ এবং আজহারী ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র গুলিকে তৈরি রাখা হয়েছে পাকিস্তানের নিজস্ব পারমাণবিক ওয়ারহেড নিক্ষেপ করার জন্য। আর এই ওয়ারহেডের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, প্রায়১৪০-১৫০ টি।  মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বিজ্ঞানীরা ঐ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, যে হারে পাকিস্তান পরমাণু বোমা বানিয়ে চলেছে তাতে ২০২৫ সালের মধ্যে ২২০-২৫০টি পরমাণু বোমার ওয়ারহেডের অধিকারী হবে পাকিস্তান। পাকিস্তানের এই পরমাণু কর্মসূচীর মূল কান্ডারী ই কিন্তু ছিলেন পরমাণু বোমার জনক ড. আবদুল কাদের খান। কিছু মাস পূর্বে মারা গেছেন এই বিজ্ঞানি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.