নিয়ন্ত্রন রেখায় সবকিছু যখন ঠিকই আছে তখন বিতর্ক থেকে কেন পিছু ছাড়ছে না?
নিউজ ডেস্কঃ ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই বেশ জটিল। এই সব কিছুরই সূচনা ১৯৬২ সালে। ঠিক কি ঘটেছিল ওই বছর? বছরের প্রথম দিক থেকেই ভারত ও চীনের মধ্যে দেখা দিয়েছিল এক রাজনৈতিক অস্থিরতা। অবশেষে ২o অক্টোবর চীন হঠাৎ করেই যুদ্ধ ঘোষণা করে ভারতের বিরুদ্ধে। এর কিছু দিন পরেই অর্থাৎ ২৬ অক্টোবর নেহেরু সরকার চীনের আগ্রাসন মোকাবেলায় জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর থেকে প্রায়ই ভারত – চিন সীমান্তে দেখা যায় চিনের অগ্রাসন। তবে, সাম্প্রতিককালে এই রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে আরো বেশ খানিকটা। কিন্তু, মোদি সরকার এই প্রসঙ্গে একেবারেই মুখ খুলতে রাজি নয়। ফলত, পূর্ব লাদাখে ভারত-চীন সেনার সামরিক অচলাবস্থা নিয়ে পার্লামেন্টে একটি আলোচনা সভার জন্য বার বার দাবি জানাচ্ছে কংগ্রেস। তাদের বক্তব্য” নিয়ন্ত্রন রেখায় সবকিছু যখন ঠিকই আছে তখন বিতর্ক থেকে পালাচ্ছে কেনো সরকার?”
তাদের এই প্রশ্ন যথেষ্ট যুক্তিসম্মতও। এতো বড়ো একটা ঘটনা নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং যদিও বা একটি বিবৃতি দিয়েছেন, সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরাসরি পার্লামেন্টে বিতর্ক সভা আয়োজনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। রাজনাথ সিং তার বিবৃতিতে এই বিতর্ক নাকচের কারণ হিসাবে তুলে ধরেছেন পরিস্থিতির “সংবেদনশীল” প্রকৃতির কথা। তার মতে, “ভারত চীন বিবাদ এখনো চলছে ফলে সংবেদনশীল বেশ কিছু তথ্য জুড়ে রয়েছে গোটা ব্যাপারটির সাথে। ফলত যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে জনসমক্ষে বিস্তারিত জানানো অসম্ভব এবং একথা বিরোধীদেরও বোঝা উচিত।”
কিন্তু মজার কথা হলো এই বিষয়ে বর্তমান সরকারের অবস্থান তাদের অতীতের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বিশেষ করে যদি তুলনা করা হয় ১৯৬২ সালের সাথে। যখন কিনা ইন্দ-ভারত পরিস্থিতি ছিলো আরো অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং গুরুতর।
যুদ্ধের মাঝেই সেই সময় তৎকালীন জনসংঘ নেতা এবং রাজ্যসভার বিধায়ক অটল বিহারী বাজপেয়ী সংসদে ভারত-চীন যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য এক বিশেষ অধিবেশনের দাবি করেন। এ নিয়ে তিনি কংগ্রেসের ওপর তখন নেহাত কম চাপ সৃষ্টি করেননি। বাজপেয়ী জনসংঘের চার জন সদস্যকে সাথে নিয়ে সেই সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে দেখা করার জন্য সংসদে এক বিশেষ অধিবেশনের দাবি জানালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে নেহেরু বিনা দ্বিধায় তখন রাজিও হয়ে যান। বাজপেয়ী তখন ৩৬ বছরের এক তরুণ যুবক এবং নেহেরু বয়সে ঠিক তার দ্বিগুণ, 72।
বাজপেয়ী যদিও সেই সময় পার্লামেন্টের সবচেয়ে ছোট দলগুলির মধ্যে একটির সদস্য ছিলেন তবুও তার দাবি অনুযায়ী যুদ্ধ চলাকালীন চিনা অগ্রাসনের মাঝেই পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা নেহেরু পার্লামেন্টে বিশেষ এই অধিবেশনের দিন ঠিক করে ৮ নভেম্বর। নেহরু সরকার পার্লামেন্টে ভারত-চীন যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিলে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে আলোচনার বিষয়ের গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে গোটা বৈঠকটি একটি “গোপন অধিবেশনে” সম্পন্ন হওয়া উচিত। কিন্তু, যেহেতু আলোচ্য বিষয়গুলি প্রত্যেক দেশবাসীরর মনেই বিভিন্ন অনিশ্চিয়তার জন্ম দিয়েছিল তাই সচ্ছতা বজায় রাখতে নেহরু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
বাজপেয়ী আলোচনার দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ৯ নভেম্বর কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন। নেহেরু সরকারের ফরেন পলিসি থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কোনো কিছু নিয়েই সেই সময় প্রশ্ন তুলতে ছাড়েননি তিনি। নেহেরু সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ এনেছিলেন যে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় রাখা হয়েছিল বেশ কিছু ঢিলেমি। যাকে তিনি “মহাপাপ” বলে অভিহিত করেছিলেন সেই সময়। বাজপেয়ী বলেছিলেন “এটা খুবই লজ্জার বিষয়” যে স্বাধীনতার ১৫ বছর পরেও সীমান্তে সৈন্যদের হাতে সরকার সঠিক অস্ত্রটুকু অব্দি তুলে দিতে পারেনি। বক্তৃতায় তিনি সেই দিন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন “যতক্ষণ না আমরা দেশের মাটি থেকে চিনা বাহিনীকে ধুয়ে সাফ করে দিচ্ছি ততক্ষণ আমাদের এই অপমান এবং পরাজয়ের দাগ মুছে ফেলা সম্ভব হবে না।” কিন্তু, বাস্তব হল বর্তমানেও আকসাই চিন সহ ভারতের এক বিস্তীর্ণ এলাকা এখনো রয়ে গেছে চীনের দখলেই।
আর একটি মজার বিষয় হলো, এই ঘটনার কয়েক দশক পর সেই বাজপেয়ীই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পাকিস্তান যখন ১৯৯৯ সালে কার্গিলে অনুপ্রবেশ করেছিল, তখন সামরিক সংঘর্ষের সময় রাজ্যসভায় যে কোনো রকম বিতর্কের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। সেই সময় এর কারণ হিসেবে সরকার ব্যাখ্যা দিয়েছিল যে বিষয়টি জনসাধারণের মাঝে আলোচনার জন্য খুবই বেশি সংবেদনশীল।এমনকি হালফিলে নরেন্দ্র মোদীর সরকারও কিন্তু একই পথে হেঁটেছে। চীনের সাথে চলমান সীমান্ত উত্তেজনাকে অত্যন্ত সংবেদনশীল বলে বর্ণনা করে তার সরকার জানিয়েছে এমন গুরুতর রাজনৈতিক অবস্থা বিস্তারিত ভাবে জনগণের সাথে আলোচনা করা একেবারেই অনুচিত।