ব্রিটেনের কলোনী হলেও আমেরিকাকে লিজ। জিব্রাল্টার নিয়ে কেন বারংবার ঝামেলায় জড়াচ্ছে স্পেন এবং ব্রিটেন?
রাজেশ রায়:- স্পেনের উপকূলে অবস্থিত একটি জায়গা হচ্ছে জিব্রাল্টার। তবে জিব্রাল্টার স্পেনের অংশ নয় আবার জিব্রাল্টার স্বাধীন কোন দেশও নয়। ব্রিটিশরা একে তাদের অংশ মনে করে। সোজা কথায় জিব্রাল্টার একটি ব্রিটিশ কলোনী। ইতিহাস সাক্ষী আছে ব্রিটিশরা তাদের কলোনীর উপর অনেক অত্যাচার করেছে কিন্তু জিব্রাল্টারের লোকেদের সাথে ভাল ব্যাবহারই করে ব্রিটিশরা। এখানকার লোকেরা ব্রিটিশ নাগরিক, তারা ব্রিটেনে গিয়ে পড়াশোনাও করতে পারে, তারা অনেক সুবিধাও পায়। জিব্রাল্টারের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৪,০০০। কিন্ত এই জিব্রাল্টারের অধিকার নিয়ে স্পেন ও ব্রিটেনের মধ্যে ঝামেলা আছে। এসম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
প্রথমেই জানা দরকার জিব্রাল্টারের অবস্থান সম্পর্কে। ইউরোপের একটি অন্যতম বড় দেশ হচ্ছে স্পেন। স্পেনের আশেপাশে বেশ কয়েকটি সাগর আছে। যেমন স্পেনের উত্তরাংশে রয়েছে বেস্কে উপসাগর ও দক্ষিনাংশে আছে অ্যালবোরান সাগর। মরোক্ক ও স্পেনের মাঝে রয়েছে এই অ্যালবোরান সাগর। এছাড়া স্পেনের পূর্বদিকে রয়েছে ব্যালেরিক সাগর। এখানেই স্পেন ও মরক্কোর মধ্যে রয়েছে জিব্রাল্টার। ভূগোলে একটি কথা বারবার উল্লেখ করা হয় জিব্রাল্টার প্রনালী। এটি এখানেই অবস্থিত, জিব্রাল্টারের খুব কাছে অবস্থিত হওয়ায় একে জিব্রাল্টার প্রনালী বলা হয়। দুটি বিশাল স্থলভাগের মাঝে কোন সরু জলপথকে প্রনালী বলা হয়। ইউরোপ ও আফ্রিকার মাঝে অবস্থিত এই জিব্রাল্টার প্রনালী ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরকে সংযুক্ত করে। জিব্রাল্টারে খুব বড় একটি পাহাড় আছে যাকে দি রক অফ জিব্রাল্টার বলা হয়। এটি এখানকার একটি জনপ্রিয় পর্যটক কেন্দ্র যেখানে প্রতিবছর কয়েকলাখ পর্যটক আসে। জিব্রাল্টারের আয়তন মাত্র ৬.৭ স্কোয়ার কিলোমিটার। এখানকার লোকেরা ব্রিটিশ নাগরিক হবার পাশাপাশি জিব্রাল্টিয়ানসও। এখানকার সরকারি ভাষা ইংরেজি। জিব্রাল্টারের মুদ্রাকে জিব্রাল্টার পাউন্ড বলা হয় এবং এখান জিডিপি ২.১ বিলিয়ন ডলার। তবে এত ছোট জায়গা হওয়া সত্বেও জিব্রাল্টার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা কারন যদি কোন দেশ জিব্রাল্টারে তাদের নেভাল বেস তৈরি করতে পারে তাহলে খুব সহজেই সেই দেশ তার নেভির মাধ্যমে জিব্রাল্টার প্রনালীকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। সেই দেশ চাইলে জিব্রাল্টার প্রনালীকে ব্লক করে দিতে পারবে ফলে ভূমধ্যসাগরীয় দেশ গুলো সহজে আটলান্টিক সাগরে যেতে পারবে না। যদিও তাদের কাছে অন্য পথ থাকবে তবে সেই পথ অনেক দীর্ঘ ও ব্যায়বহুল হবে। ফলে আন্তর্জাতিক বানিজ্যের জন্য জিব্রাল্টার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আগেই বলো হয়েছে জিব্রাল্টার একটি ব্রিটিশ কলোনী। এই মহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ব্রিটেনের ১৪ টি কলোনী আছে। যেমন ভারত মহাসাগরে দিয়েগো গার্সিয়া, এটি ব্রিটেনের কলোনী কিন্তু এটি ব্রিটেন আমেরিকাকে লিজে দিয়ে রেখেছে।
রহস্যময় বারমুডা ট্রাঙ্গেলের নাম সবাই জানে সেই বারমুডাও ব্রিটেনের কলোনী। তবে অতীতে যে বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল তার তুলনায় এগুলো খুবই কম। একসময় বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায়না। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ কানাড, অস্ট্রেলিয়া সবই ব্রিটেনের অধীনে ছিল কিন্তু এখন মাত্র কিছু কিছু ছোট দ্বীপ ব্রিটিশদের অধীনে আছে। জিব্রাল্টার আইবেরিয়ান পেনিনসুলার অংশ। আইবেরিয়ান পেনিনসুলা ইউরোপের একটি ছোট অংশ যাতে অ্যান্ডোরা, স্পেন, পর্তুগাল, জিব্রাল্টারের মতন দেশ রয়েছে। এবার জানা দরকার স্পেনের সাথে জিব্রাল্টার নিয়ে ব্রিটেনের ঝামেলা কী করে হল? এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ায়, যাকে ব্রেক্সিট বলা হয়, কেন জিব্রাল্টার নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছিল?
যদি ইংল্যান্ডের কোন মিউজিয়াম দেখে থাকেন দেখবেন সেখানে ব্রিটেনের নিজস্ব ইতিহাস তেমন কিছুই নেই বরং কলোনী থাকাকালীন বিভিন্ন দেশ থেকে লুঠ করে আনা জিনিস রয়েছে সেখানে। ব্রিটেন তার সমস্ত কলোনীতে লুঠপাট করে নিজেদের অর্থনীতি ঠিক রেখেছিল। জিব্রাল্টার কয়েক শতাব্দী ধরে স্পেনের অংশ ছিল কিন্তু ১৭০৪ সালে স্পেনের উপর ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডসের নেভির যৌথভাবে আক্রমন করে এবং স্পেন বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ১৭১৩ সালে লন্ডনে এক চুক্তির মাধ্যমে স্পেন বাধ্য হয় জিব্রাল্টারকে ব্রিটেনকে দিয়ে দিতে। আজও স্পেনের মানুষ জিব্রাল্টারকে নিজেদের বলে দাবি করে। জিব্রাল্টারের অনেক মানুষ স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। স্পেন অনেকবার চেষ্টা করেছিল যাতে জিব্রাল্টারকে নিজেদের অধীনে আনা যায়, এরজন্য ১৯৬৮ সালে ও ২০০২ সালে জিব্রাল্টারের মানুষদের ভোটিং এর মাধ্যমে বলা হয় তারা স্পেন না ব্রিটেন কোন পক্ষে যাবে নির্নয় করতে। কিন্তু দুইবারই জিব্রাল্টারের ৯৬ শতাংশ মানুষ ব্রিটেনকে বেছে নেয়। কারন সেখানকার মানুষ ভেবেছে সামরিক ও অর্থনৈতিক ভাবে ব্রিটেন স্পেন অপেক্ষা অনেকবেশী শক্তিশালী সেজন্য ব্রিটেনেই তাদের ভবিষ্যত বেশী সুরক্ষিত।
আসলে ব্রিটেন নিজেও জিব্রাল্টারকে নিজেদের অধীনে রাখতে যার প্রধান কারন এর গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজিক অবস্থান এবং একটা সময় ব্রিটেনের সাম্রাজ্য অনেক বিশাল ছিল, স্বাধীনতা পাবার পর সেসব দেশই আজ ব্রিটেন থেকে শক্তিশালী হয়ে গেছে এটা ব্রিটেন মানতে পারেনা। সেজন্য এখন যে ১৪ টি কলোনী আছে ব্রিটেনের সেগুলো ব্রিটেন ছাড়তে চায়না। তবে ২০২০ সালে স্পেন দীর্ঘদিন পরে জিব্রাল্টারে তাদের কীছুটা অধিকার ফিরে পেয়েছে। তবে এর পেছনেও একটি গল্প আছে। ২০১৬ সাল থেকেই ব্রিটেন চাইছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে যাকে ব্রেক্সিট বলা হয়। স্বাভাবিক ভাবে ব্রিটিশ কলোনী হওয়ায় জিব্রাল্টারও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেড়িয়ে যাবার কথা কিন্তু সেসময় জিব্রাল্টারের অধিকাংশ লোক চাইছিল তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন না ছাড়তে। এরই সুযোগ নিয়ে স্পেন ব্রিটেনকে জানায় ব্রিটেন যদি জিব্রাল্টারে তাদেরও কীছু অধিকার দেয় তাহলেই স্পেন ব্রিটেনের ব্রেক্সিটকে সমর্থন করবে নাহলে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ভেটো দেবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরোতে হলে ব্রিটেনকে সব সদস্য দেশের ভোট লাগত সেজন্য ব্রিটেন বাধ্য হয় স্পেনের প্রস্তাবে রাজি হত। এইভাবে দীর্ঘদিন পর জিব্রাল্টারে স্পেন নিজের প্রভাব বাড়াতে সক্ষম হয়৷ জিব্রাল্টারের একমাত্র ল্যান্ড বর্ডার আছে স্পেনের সাথেই সুতরাং তারা স্পেনের উপরও অনেকটা নির্ভরশীল। তবে শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালে ব্রিটেন ও জিব্রাল্টার দুজনেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যায়। ভারত মহাসাগরে ব্রিটেনের দিয়েগো গার্সিয়া কলোনী নিয়েও মরিশাসের সাথে ঝামেলা আছে। মরিশাস অভিযোগ করেছে এটা ব্রিটেন অনৈতিক ভাবে দখল করেছে তাদের থেকে। একসময় যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য ডুবত না আজ সেই ব্রিটেনের অবস্থা দেখলে হাসি পায়।