কাশ্মীর নিয়ে ভারতবর্ষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে গেছেন নেহেরু!
সুমিতঃ পাকিস্তানের সাথে ভারতবর্ষের ঝামেলা নতুন নয়, আজ ৭০ বছর ধরে এই ঝামেলা চলছে পাকিস্তানের সাথে। তবে প্রথম থেকেই অর্থাৎ ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ১৯৪৭ সাল থেকেই এর বিরোধিতা শুরু করে। পাকিস্তানের আগ্রাসনের বিরোধিতা হিসাবে নেহেরুর ইউনাইটেড নেশনস এর দ্বারস্থ হওয়া সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই বিভিন্ন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। রাজীব ডোগরা তার ‘ইন্ডিয়া’স ওয়ার্ল্ড’ বইতে টাল মাটাল সেই পরিস্থিতির কথা অত্যন্ত সূক্ষ্মতার সাথে তুলে ধরেছেন। সেখান থেকেই জানা যায় যে কাশ্মীরে পাকিস্তানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে যাওয়া ঠিক কতো বড় ভুল ছিলো তা অল্প সময়ের মধ্যেই অনুধাবন করেছিলেন নেহেরু।
প্রসঙ্গত ঘটনার সূত্রপাত ১৯৪৭ সালে জম্মু কাশ্মীরে। দেশ ভাগের পর কিছু পাকিস্তানি আদিবাসী ওই বছরের অক্টোবর মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহায়তায় জম্মু-কাশ্মীরের বেশ কিছু অংশ দখল করে নেয়। পরবর্তী যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী আক্রমনকারীদের দখলকৃত কিছু এলাকা খালি করতে বাধ্য করলেও বেশ কিছু জায়গা তবুও রয়ে গেছিলো পাকিস্তানের দখলেই। সেই সময় আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যেখানে ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল সেখানে অপরদিকে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন পাশে দাঁড়িয়েছিলো পাকিস্তানের। যুদ্ধে জেতায় যেখানে ভারতের উচিত ছিল আক্রমণকারীদের কাছ থেকে জম্মু-কাশ্মীরের অধিকৃত অংশ পুনরায় ছিনিয়ে নেওয়া সেখানে হাস্যকরভাবে ব্রিটেনের চাপে এবং মাউন্টব্যাটেনের আশ্বাসে নেহেরু গোটা বিষয়টি জাতিসংঘের কাছে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার বিশ্বাস ছিলো নব্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব সংস্থাটি ভারতের পক্ষে থাকবে এবং পাকিস্তানের অগ্রসন রোধ করবে।
সেই সময় থেকেই নেহেরুর এই পদক্ষেপের কার্যকারিতা নিয়ে শুরু হয়েছিলো বিস্তর কাঁটা ছেড়া। এক্ষেত্রে সমালোচকদের মূল প্রশ্নই হলো, ভারত যেখানে যুদ্ধে জিতেই গেছিলো সেখানে আলাদা করে নেহেরুর জাতিসংঘের কাছে যাওয়ার যৌক্তিকতা ঠিক কি? যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী চাইলেই সহজে হানাদার দের জম্মু কাশ্মীর থেকে বিতাড়িত করতে পারতো। এর বিপক্ষেও অবশ্য রয়েছে যুক্তি। সেই সময়ের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেছে যে যুদ্ধরত অবস্থায় দুই দেশের সেনাবাহিনীই নাকি এমন এক অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলো যে জাতিসংঘের কাছে দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর ছিল না কোনো উপায়। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে গোটা বিষয়টি না মেটানো গেলে ভবিষ্যতে পাকিস্তান যে পুনরায় ভারতের অধিকৃত অংশে অগ্রাসন চালাবে সেরকম একটা আশঙ্কাও ছিলোই। তবে, সত্যি বলতে কি শুধুমাত্র এই আশঙ্কা থেকেই নেহেরু জাতিসংঘের কাছে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন সেকথা ভাবলে ভুল হবে। ইংল্যান্ড সেই সময় পাকিস্তানের পাশে থাকায় একপ্রকার ষড়যন্ত্র করেই মাউন্টব্যাটেন তখন নেহেরুকে বিশ্বব্যাপী কনফারেন্স করার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। আর দোষ ছিল নেহেরুরই যে তিনি প্ররোচনায় পা দিয়েছিলেন।
কিন্তু কনফারেন্স সম্পন্ন হতেই ভুল ভাঙ্গে তার। সেই সঙ্গে তাঁর এই ব্যর্থ কনফারেন্স ভারতীয় জনগণকে ঠিক কতটা ক্ষুব্ধ করেছে তাও অজ্ঞাত ছিল না তার। নয়াদিল্লিতে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে তিনি বিবৃতি দিয়ে সেই সময় তার রাষ্ট্রসঙ্ঘের দারস্ত হওয়ার কারণগুলিও ব্যাখ্যা করেছিলেন।
এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সাথে ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের মধ্যে আয়োজন করা হয় এক সরকারি কনফারেন্স। সেখানে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে ভারতের অনুরোধ ছিলো কাশ্মীর আক্রমণে অংশগ্রহণ এবং সহায়তাকারী যাবতীয় পাকিস্তানি সরকারী কর্মী, সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিত্বদের যেনো রোধ করে জাতিসংঘ। ভারতের দাবি ছিলো:
১) পাকিস্তানের অন্যান্য নাগরিকদের কাশ্মীরের যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে বিরত করা।
2) ভারতের মাটিকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের কাশ্মীরের ভূখণ্ডে প্রবেশ এবং কাশ্মীরের বিরুদ্ধে অভিযান রোধ করা। সেইসঙ্গে সংগ্রাম দীর্ঘায়িত করতে পারে এমন যাবতীয় সামরিক ও বেসামরিক দ্রব্য সরবরাহ রোধ করা।
নেহেরু এই সময় জাতিসংঘের স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল যে আগ্রাসন রোধ করতে জাতিসংঘের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে মুখ্য পদক্ষেপ হল যে কোনো প্রকারে পাকিস্তানকে চাপ দিয়ে হানাদার প্রত্যাহার করানো ও যুদ্ধ বন্ধ করা।
কিন্তু, দুঃখজনকভাবে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চাপা পড়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ এই সত্য। আর ঠিক তারই পূর্ণ সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান এখনো দাবি করছে যে জাতিসংঘের সাথে আলোচনায় নেহেরু নাকি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে কাশ্মীর একটি বিতর্কিত অঞ্চল। অথচ আসল সত্য হলো নেহেরু সেইসময় সাংবাদিক সম্মেলনে জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের সাথে লড়াই সংঘটিত হয়েছে ভারতীয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলেই ফলত যেকোনো আক্রমণকারীকে ভূখণ্ড থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে ভারত সরকারের। যতক্ষণ না কাশ্মীর থেকে অনুপ্রবেশকারীরা হটছে ততক্ষণ দুই দেশের মধ্যে অন্য কোন বিষয় নিয়ে আলোচনার কোনো স্থান নেই।’ কিন্তু সমালোচকেরা এই ব্যাখ্যাতে সন্তুষ্ট নন। তাদের যুক্তি যতোই পাকিস্তান এবং ব্রিটেনের ষড়যন্ত্র এবং মাউন্টব্যাটেনের প্ররোচনা থাকুক কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজস্ব নির্বুদ্ধিতাতেই সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন নেহেরু।
কনফারেন্স শেষ হলে জাতিসঙ্ঘের প্রতি নেহেরুর মোহভঙ্গ ঘটে এবং আস্থা হারিয়ে ১৯৪৮ সালের ৫ মার্চ গণপরিষদে তার বিবৃতিতে তিনি জানান:
“আন্তর্জাতিক সরকারের প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা এবং বিচার ব্যবস্থাকে ভারত বরাবরই সম্মান করে বলেই অনেক বিশ্বাস নিয়ে জাতিসংঘে গোটা ব্যাপারটি জানানো হয়েছিল। আর ঠিক এই একই কারণে অনেক ধাক্কা খাওয়ার সত্ত্বেও এখনো আমরা জাতিসংঘের উপস্থাপিত আদর্শকে মেনে চলেছি। তবে, সেইসঙ্গে নিজ দেশের মানুষ এবং তাদের আস্থা অটুট রাখার জন্যও তাদের প্রতি বেশ কিছু কর্তব্য রয়েছে আমাদের। দেশবাসীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হলে এক প্রকার ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে সেই সমস্ত মৌলিক আদর্শগুলির সাথে জাতিসংঘ যেগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। “
দুর্ভাগ্য তার এবং ভারতবর্ষের পরবর্তী প্রজন্মের যে তার আদর্শ এবং জাতিসংঘ উভয়ই বিশ্বাসঘাতকতা করে ছিল তার সাথে। প্রশ্ন ওঠে, জাতিসংঘ থেকে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে সেটা ভাবা কি নেহেরুর দোষ ছিল? বা পোস্ট করে এইভাবে তৈরি হলে জাতিসঙ্ঘের ছুটে যাওয়া টা কি তার নিজেরই বিচারের ভুল ছিল না? এই অনুশোচনার মধ্যে মাউন্টব্যাটেনের ওপর অনেকটাই দোষ চাপানো গেলেও একথা তো সত্য যে নেহেরু রাজনীতিতে নতুন ছিলেন না একেবারেই। তার সারা জীবনই কেটেছিল ব্রিটিশদের মোকাবিলা করে। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মাউন্টব্যাটেনের কুচক্রী স্বভাব বা ব্রিটেন এবং পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের কথা একেবারেই না বোঝে সোজা গর্তে ঝাঁপ দেওয়া নেহাতই তার নিজস্ব বোকামি।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ১৯৫১ সালের ২ মার্চ সংসদে এক বক্তৃতায় নেহেরু পুনরায় অসন্তোষ প্রকাশ করে জানান”
কাশ্মীরের ভারতে যোগদান সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভারতের বাকি রাজ্য যেভাবে সংযুক্ত হয়েছে ঠিক একইভাবে কাশ্মীর ও ভারতের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। ভারতে কাশ্মীরের যোগদান বা সার্বভৌমত্ব নির্ধারণ করার জন্য আমরা জাতিসংঘের কাছে যাইনি বরং বিশ্বশান্তি বজায় রাখার জন্য পাকিস্তানের আগ্রাসন রোধ করতে অভিযোগ জানানো হয়েছিল সেখানে। অথচ জাতিসংঘ সেই সুযোগ নিয়ে নিজেদের তদন্তের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। এখনো পর্যন্ত জাতিসংঘ কমিশন বা নিরাপত্তা পরিষদ কেউই কোনো প্রস্তাব দিয়ে সরকারিভাবে জানায়নি যে কাশ্মীর অধিগ্রহনের ব্যাপারটি প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো।”
এবার ঘটনা হলো তার বক্তব্যের মধ্যে সত্যতা থাকলেও তিনি একবারের জন্যও স্পষ্ট জানান নি যে ঠিক কেন, কার পরামর্শে বিশ্ব সংস্থার কাছে হঠাৎ গিয়েছিলেন তিনি। নেহেরু বলেছিলেন, ‘বিশ্বশান্তি বজায় রাখার জন্য পাকিস্তানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হয়েছিলো’। অথচ যে দেশ কিনা সেই সময় বিশ্বের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিল তা কিভাবে বিশ্বশান্তিকে বিপন্ন করতে পারে সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো কিছুই উল্লেখ করেননি তিনি। তাছাড়া সত্যিই যদি বিশ্বশান্তি ঝুঁকির মুখে পড়তো তবে জাতিসংঘের নিজেই উদ্যোগ নিতে এত বড় যুদ্ধ রোধের। সেক্ষেত্রে আলাদা করে ভারতের জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়ার তো কোনো মানেই ছিল না।
বিশ্বরাজনীতির মূল খেলাই হল একবার বিরোধ প্রকাশ্যে এলে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলি সেই ঝামেলায় মাথা গলানোর চেষ্টা করবেই। এক্ষেত্রেও ঘটেছে ঠিক তাই। প্রথমে ব্রিটেনের দাবি মেনে এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের সাথে সামরিক চুক্তি সম্পন্ন হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। শোনা যায় বিষয়টিতে নেহেরু এতটাই বিরক্ত হয়েছিলেন যে অপকটে এক মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তিনি বলেই ফেলেছিলেন ‘যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক উপদেশ পেয়ে পেয়ে আমরা ক্লান্ত। পুরো পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ‘