ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ইউক্রেনকে দখল করছে রাশিয়া! ইউক্রেন আক্রমণের পুরো গেম প্ল্যানটা কি জানেন?
রাজেশ রায়: অবশেষে আশঙ্কাই সত্যি করে রাশিয়া সরাসরি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হচ্ছে। হ্যাঁ অফিসিয়ালি রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেননি যে গোটা ইউক্রেন দখল করবে বরং পুতিন জানিয়েছে সে ইউক্রেনের নাজি সরকার কে হঠিয়ে দেবে। পুতিনের মতে ইউক্রেনের বর্তমান সরকার হিটলারের নাজি সেনার মত স্বৈরাচারী তাই রাশিয়া ইউক্রেন কে মুক্ত করবে তবে পুতিন কে যারা চেনেন তারা খুব ভাল করেই জানেন পুতিনের এসব মৌখিক কথা। রাশিয়ান ইনটেলিজেন্স এজেন্সি কেজিবির প্রাক্তন এজেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার লোক এটা সবাই জাননে, তার আসল উদ্দেশ্য পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা, তারই অংশ হিসাবে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ইউক্রেনকে দখল করতে চায় রাশিয়া।
ইউক্রেন আক্রমণের পুরো গেম প্ল্যানটা একটু বিস্তারিতভাবে বলা যাক। তার আগে একটা ব্যাপার সবাই জানেন রাশিয়া ২০১৪ এর দিকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় যা ইউক্রেনের একটা গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। তখন থেকেই ন্যাটো সহ আমেরিকা রাশিয়া কে ভরসা করে না। ইউক্রেন নিজেও জানত রাশিয়ার পরবর্তী স্টেপ হবে ইউক্রেন দখল। গত কিছুদিন আগে রাশিয়া হঠাৎই তাদের মিগ-৩১ ইন্টারসেপ্টার বিমান বাল্টিক সাগরের তীরে কালিনগ্রাদ শহরে মোতায়েন করে। প্রত্যেকটি মিগ-৩১ কিনজল হাইপারসনিক মিসাইল বহন করছে যার রেঞ্জ ২০০০+ কিলোমিটার এবং এর গতি ১০ ম্যাক। যারা ম্যাক জানেন না তাদের বলি, বাতাসে শব্দের গতি ৩৩২ মিটার/ সেকেন্ড একে ম্যাক বলা হয়। ১০ ম্যাক মানে ৩৩২×১০= ৩৩২০ মিটার বা ৩.৩ কিলোমিটার। অর্থাৎ কিনজল হাইপারসনিক মিসাইল এক সেকেন্ডে ৩.৩ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে তাহলে ভেবে দেখুন যাস্ট। এই মহূর্তে বিশ্বের কোন দেশের কাছেই হাইপারসনিক মিসাইল কে কাউন্টার করার সিস্টেম নেই। এবার প্রশ্ন আসে রাশিয়া কালিনগ্রাদে কেন মিগ-৩১ মোতায়েন করল?
তাহলে বলি কিছুদিন আগে আমেরিকা ইউক্রেনেকে সাপোর্ট দেবার জন্য পোল্যান্ডে তাদের কম্যান্ডো পাঠায় যা রাশিয়া মোটেও ভালভাবে নেয় নি যার জন্য তারা কালিনগ্রাদে মিগ-৩১ পাঠানো হয়। কিনজল হাইপারসনিক মিসাইলের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল এটি প্রায় ৫০০ কিলোটন পরমাণু বোম্ব বহন করতে সক্ষম। আর কালিনগ্রাদের স্ট্রাটেজিক অবস্থান এমনই যে এখান থেকে খুব সহজেই ন্যাটোর সদস্যযুক্ত পশ্চিম ইউরোপীয়ান দেশ গুলোর রাজধানীকে আক্রমণ করা সম্ভব তাও মাত্র ৭-১০ মিনিটের মধ্যে যার মধ্যে রয়েছে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারাও। অর্থাৎ রাশিয়া সরাসরি ন্যাটো ও আমেরিকাকে পরমানু যুদ্ধাস্ত্রের হুমকি দিয়ে রাখল। ইউক্রেনে আক্রমন করেছে রাশিয়া তবে এর পরিকল্পনা বহুদিন ধরেই করে আসছে রাশিয়া।
গত ২৫ জানুয়ারী থেকে ইউক্রেন বর্ডারে বেলারুশের সাথে ব্যাপক যুদ্ধ এক্সারসাইজ শুরু করে রাশিয়া যার নাম দেওয়া হয় “অ্যালায়েড রিজলভ”. প্রায় এক লক্ষ রাশিয়ান সেনাকে মোতায়েন করা হয় ইউক্রেনে, যারা এই এক্সারসাইজে অংশ নেয়। রাশিয়ার এসইউ-৩৫, এসইউ-৩০ যুদ্ধ বিমান সহ পরমানু অস্ত্র বহনে সক্ষম মিগ-৩১ বিমান এবং প্রায় ৬০০০ আর্টিলারি, ট্যাংক এই এক্সারসাইজে অংশ নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হওয়া স্নায়ু যুদ্ধের পর এটাই ছিল রাশিয়ার বৃহত্তম যুদ্ধ সমাবেশ। গত একমাস ধরে ইউক্রেনে কিভাবে আক্রমণ করা হবে তার পুরো এক্সারসাইজ করে রাশিয়া, এছাড়াও ক্রিমিয়ার সেবাস্তিপোল বন্দর থেকে রাশিয়ান নেভির বিরাট নৌবহর ইউক্রেনের পাশে ব্ল্যাক সী তে পৌঁছায়, এই বহরে রাশিয়ান নেভির ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট, সাপ্লাই জাহাজ, সাবমেরিন সব আছে। অর্থাৎ রাশিয়া ইউক্রেনকে পুরো ঘিরে ফেলে একমাস ধরে। তারপরই আজ আক্রমণ করা হয়। তবে এর আগে রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক ঘোষনা করেন। ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের দুটি প্রদেশ ডনটেস্ক ও লুনহানস্কের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। এই দুটি প্রদেশ এবার থেকে স্বাধীন দেশ হিসাবে পরিচত হবে। এদের নতুন নাম হবে রিপাবলিক ডনটেস্ক রিপাবলিক ও লুনহানস্ক রিপাবলিক। বহুদিন ধরেই এই দুই প্রদেশে রাশিয়া তাদের সমর্থকদের গোপনে পাঠাতে থাকে। এত বছর ধরে রাশিয়ার প্রভাবে এই দুটি শহরের অধিকাংশ মানুষ রুশপন্থি হয়ে উঠেছে।
এবার দেখা যাক রাশিয়া ইউক্রেনের এই যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে স্টক মার্কেট, সেফ হেভেন, শস্য, এনার্জি ও তেল সহ অর্থনীতির উপর কী প্রভাব ফেলবে। প্রথমেই বলা যাক সেফ হেভেন সম্পর্কে। সেফ হেভেন কি? সরকারী বন্ড, সোনা এদের সেফ হেভেন বলা হয়। সাধারণত মানুষ ইনভেস্ট করে স্টক মার্কেটে, ফলে দেশের জিডিপি বাড়লে শেয়ারের একটা লাভ পাওয়া যায় কিন্ত যুদ্ধকালীন সময়ে এখন যেমন রাশিয়া ইউক্রেন ঝামেলা চলছে কিংবা ধরুন করোনা মহামরী সময়ে মানুষ কী করে স্টক মার্কেটের বদলে সেফ হেভেনে বিনিয়োগ করে।
সরকারী সমস্ত বন্ড কে সবথেকে সেরা সেরা হেভেন বলা হয়। ইতিমধ্যে এই যুদ্ধের জন্য ফেডারেল রিজার্ভ বা আমেরিকার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক তাদের সুদ বাড়িয়ে দিয়েছে যার অর্থ ডলার, ইউরো, পাউন্ড, সুইস ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারন এইসব মুদ্রাকে শক্তিশালী কারেন্সি বলা হয়, এইজন্য লোকে এসব ক্রয় করে রাখে। এরপর আসছে সোনার মূল্যবিদ্ধি। ১০ গ্রাম ২৪ ক্যারট সোনার দাম ৫১,৫৩০ টাকা। করোনার সময় এই দাম প্রায় ৫৬,০০০ চলে গেছিল, পরে আবার কমতে শুরু করেছিল কিন্তু আবার বাড়তে শুরু করবে। এরপর আসে শস্য। ব্ল্যাক সী দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচুর শস্য রপ্তানি হয়। এবার যুদ্ধের কারনে এই মহূর্তে ব্ল্যাক সী ব্লক করে দিয়েছে রাশিয়া ফলে বানিজ্য এই মহূর্তে বন্ধ থাকবে যার ফলে এইসব শস্যর দ্রব্যমূল্য বাড়বে যার সরাসরি এফেক্ট পড়বে স্টক মার্কেটে। ব্ল্যাক সী এলাকায় শস্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক চারটি দেশ হচ্ছে রাশিয়া, ইউক্রেন, কাজাখিস্তান ও রোমানিয়া।
২০২১-২২ এর অর্থবর্ষের ডাটা অনুযায়ী ইউক্রেন বিশ্বের তৃতীয় সবচেয়ে বড় ভুট্টা রপ্তানিকারক ও চতুর্থ সবচেয়ে বড় গমের রপ্তানিকারক দেশ। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ইউক্রেন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া নিজে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গমের রপ্তানিকারক দেশ সুতরাং এই যুদ্ধের ফলে খাদ্যশস্যের দাম বাড়ছে এটা নিশ্চিত। এরপর আসছে ন্যাচারাল গ্যাস। ইউরোপের এনার্জির বড় উৎস রাশিয়া। রাশিয়া থেকে বাল্টিক সাগর হয়ে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম ১ ও নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস লাইন গেছে।