পাকিস্তানের তিন প্রদেশে অস্থিরতা। অর্থনীতির উপর ক্রমশ চাপ বাড়ছে। জানুন বিস্তারিত
সম্প্রতি পাকিস্তানের বালুচিস্তানের মাস্টুং শহর এবং খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের হাঙ্গু শহরে দুটি আত্মঘাতী বিস্ফোরনে অন্তত ৫০ জনের বেশী লোকের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনার পর বালুচিস্তানের কেয়ারটেকার ইনফর্মেশন মন্ত্রী জান আচাকাজাই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানে থাকা প্রায় ১.৭৩ মিলিয়ন আফগান নাগরিককে পাকিস্তান ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে কারন পাকিস্তান মনে করছে বালুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে এই আত্মঘাতী বিস্ফোরনের জন্য তেহরিক ই তালিবান পাকিস্তান সংগঠন দায়ী। যদিও পাকিস্তানের এমন দাবী যথেষ্ট হাস্যকর কারন দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কাজকর্ম করে আসছে, যে সন্ত্রাসীদের পাকিস্তান দীর্ঘদিন ভারতের বিরুদ্ধে হামলার জন্য তৈরি করেছে আজ পাকিস্তান নিজেই তার স্বীকার। এই ঘটনার কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের গিলগিট বালতিস্থানে একটি বড় বিক্ষোভ হচ্ছিল ভারতে যোগ দেবার জন্য। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার জোড়া আত্মঘাতী বিস্ফোরনে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার করুনচিত্র গোটা বিশ্বের সামনে প্রকাশিত হয়ে গেল।
পাকিস্তানে আঞ্চলিক অস্থিরতা এবং সন্ত্রাস খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাকিস্তানের বালুচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশ দুটি আফগানিস্তান সীমান্তে যার কারনে এখানে আফগান তালিবানের একটা প্রভাব দেখা যায়। এই দুটি প্রদেশে সম্প্রতি হওয়া আত্মঘাতী বিস্ফোরন কোন নতুন ব্যাপার নয়, গত একবছরে খাইবার পাখতুনখাওয়াতে অন্তত তিনশো আক্রমন হয়েছে এবং বালুচিস্তানে প্রায়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর আক্রমন হয়। এই দুটি প্রদেশে তেহরিক ই তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি এবং আইএসআইএস সন্ত্রাসী সংগঠনের দুটি দল আইএসকেপি বা ইসলামিক স্টেট খোরসান প্রভিন্স এবং আইএসপিপি বা ইসলামিক স্টেট পাকিস্তান প্রভিন্স কাজ করে। পাকিস্তানের অভিযোগ টিটিপি আফগানিস্তানে প্রশিক্ষন নিয়ে পাকিস্তানে আক্রমন করছে যদিও পাকিস্তানের এই দাবি অস্বীকার করেছে আফগান তালিবান। তবে বালুচিস্তানে দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্থানীয়দের উপর অত্যাচার, প্রাকৃতিক সম্পদের লুঠ এবং স্থানীয় বালুচদের প্রায় সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখার কারনে বালুচিস্তানকে স্বাধীনতা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে যার নেতৃত্বে আছে বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ। এরা প্রায়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর আক্রমন করে। খাইবার পাখতুনখাওয়ার বেশীরভাগ অঞ্চলে টিটিপি তার প্রভাব বাড়ানোর জন্য আক্রমন করে। অন্যদিকে গিলগিট বালতিস্তান প্রদেশের মানুষদের দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের উপর ক্ষোভ রয়েছে।
গিলগিট বালতিস্তানের স্কার্দু শহরে গত ৩১ আগস্ট থেকেই তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়, হাজার হাজার মানুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে ভারতের কারগিলে যাওয়ার হুমকী দেয়৷ পাকিস্তান তৈরির পর থেকে এত বড় বিক্ষোভ এই অঞ্চলে আগে দেখা যায়নি। পিওকে বা পাকিস্তান অকুপাইড কাশ্মীরকে পাকিস্তান দুটি ভাগে ভাগ করেছে, একটি ভাগকে বলা হয় গিলগিট বালতিস্তান এবং অন্যটিকে বলা হয় আজাদ কাশ্মীর।
১৯৭০ সালে গিলগিট বালতিস্তানকে সরাসরি নিজেদের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্তর্ভুক্ত করে। তবে ২৯ আগস্ট, ২০০৯ সালে গিলগিট বালতিস্তানকে আংশিক স্বায়ত্তশাসন দেয় পাকিস্তান এবং এখানের জন্য একটি নির্বাচিত সরকারও গঠন করা হয়। এই অঞ্চলের মানুষদের পাকিস্তানের পাসপোর্ট ও পরিচয়পত্র রয়েছে কিন্তু এদের সাথে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকদের মতো আচরন করে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সংসদেও এই অঞ্চলের মানুষদের কোন প্রতিনিধি নেই। দেশের সাধারন নির্বাচনেও অংশ নিতে পারেনা এখানের মানুষজন।
প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ন গিলগিট বালতিস্তানের খনিজসম্পদ পাকিস্তান ব্যবহার করে কিন্তু এই এলকার মানুষ তার কোন অংশই পায়না। পাকিস্তানের সংবিধানের ১৮ তম সংশোধন অনুযায়ী পাকিস্তানের বাকি চার প্রদেশের মানুষ তাদের ড্যাম, পর্যটন, গ্যাস, তেল ও খনিজ সম্পদ থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহার করতে পারে কিন্তু গিলগিট বালতিস্তান প্রদেশের মানুষকে তার অধিকার দেওয়া হয়না। উপরন্তু ১৯৬৩ সালের ২ মার্চ পাকিস্তান চীনকে উত্তর গিলগিট বালতিস্তানের প্রায় ৫,১৮০ স্কোয়ার কিলোমিটার জায়গা দিয়ে দেয়। এই অঞ্চলের সাথে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের সংযোগ রয়েছে। চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর বা সিপেকের অধিকাংশ এই অঞ্চল দিয়েই গেছে, চাইনিজ সংস্থাগুলো এখানে মাইনিং করছে কিন্তু স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়নি। সাধারন মানুষ সুবিধাতো পায়না উপরন্ত অবৈধ খননকার্যের জন্য এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা যায়। গতবছর এখানে একটি বিশাল গ্লেসিয়ার ধ্বসে এই অঞ্চলের বহু ঘর সহ কারাকোরাম হাইওয়ের একটি বড় অংশ ধ্বংস করে দেয়।
বর্তমানে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থাও শোচনীয়। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের কার্যক্রম আগস্ট মাসেই শেষ হয়ে গেছে আগামী জানুয়ারী মাসে পাকিস্তানে সাধারন নির্বাচন হওয়ার কথা কিন্তু তার আগে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খানকে ১৮০ টি অভিযোগের ভিত্তিতে কারাবন্দী করা হয়েছে। ইমরান খানের দল তেহরিক ই ইনসাফের একটি বড় প্রভাব ছিল পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া, বালুচিস্তান, গিলগিট বালতিস্তান প্রদেশে কিন্তু ইমরান খানের গ্রেফতার হওয়ায় পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে কারন শাহবাজ শরীফের কাছে ইমরান খানের মতোন জনসমর্থন নেই। আসলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে গেলে সেনাবাহিনীর সমর্থন দরকার।
২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকেই ইমরান খানের সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরোধীতা শুরু হওয়ায় যার কারনে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। বালুচিস্তান, গিলগিট বালতিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখাওয়াতে হওয়া বিক্ষোভ, সন্ত্রাসী কাজকর্ম এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের সরাসরি প্রভাব পড়ছে পাকিস্তানের অর্থনীতির উপর। সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের মুদ্রাস্ফীতি ৩১.৪ শতাংশে চলে গিয়েছে। জুলাই মাসে পাকিস্তানের বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমান মাত্র ১২.৯ বিলিয়ন ডলার হয় যাতে মাত্র সাড়ে তিনমাসের মতোন বানিজ্য হওয়ার কথা। পাকিস্তানের ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে।
২০২৩ সালের বিশ্বের মানব উন্নয়ন সমীক্ষায় ১৯২ টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ১৬১ এবং পাকিস্তানে মানব উন্নয়নের গতি খুবই কম। পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋনের পরিমান ৭৮ শতাংশ। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো পাকিস্তান তৈরির সময় থেকেই দুর্বল। ১৯৪৭ সাল থেকে ২০২৩ অবধি পাকিস্তান ২২ টি বেল আউট প্যাকেজ পেয়েছে আইএমএফের যা দক্ষিন এশিয়ার দেশ গুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। সম্প্রতি জুলাই মাসে আইএমএফ থেকে তিন বিলিয়ন ডলারের বেল আউট প্যাকেজ পেয়েছে পাকিস্তান। দেশটির সেনাবাহিনী জানিয়েছে আগামী পাঁচ বছরে পাকিস্তানে ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে সৌদি আরব এবং ইউএই। যেখানে পাকিস্তানের স্বাক্ষরতার হার মাত্র ৫৯ শতাংশ, ৩২ শতাংশ বাচ্ছা স্কুলেই যেতে পারেনা সেখানে দেশটির জিডিপির বড় অংশ সেনাবাহিনীর জন্য খরচ করা হয় যার কারনে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগস্ট ২০২১ এ যেখানে পাকিস্তানে ১৭,৯০০ গাড়ি তৈরি হত, সেখানে আগস্ট, ২০২৩ এ ৫,৯০০ গাড়ি তৈরি হচ্ছে পাকিস্তানে। চীন নিজেও পাকিস্তানে সিপেক প্রজেক্টে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয় আর। চীনের নিজেরও অর্থনৈতিক অবস্থা খানিকটা মন্থর হয়ে গেছে যার কারনে সিপেকের মতোন প্রজেক্টে খরচ করতে চাইছেনা তারা। যার কারনে অদূর ভবিষ্যতে আরও খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থায় পড়তে চলেছে পাকিস্তান।