আমেরিকা বনাম চীনের শীতল যুদ্ধ। জানুন বিস্তারিত
রাজেশ রায়ঃ এই মহূর্তে যদি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ভালভাবে লক্ষ করেন দেখবেন গোটা বিশ্ব ধীরে ধীরে আবারও একটি ঠান্ডা যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে? কারা দায়ী এর পেছনে!
সর্বপ্রথম Cold war বা ঠান্ডা লড়াই শব্দটা মাথায় এলেই আমাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত এই ৪৪ বছর ছিল বিশ্বের ইতিহাসে ঠান্ডা লড়াই। ততকালীন সময়ের দুই সুপার পাওয়ার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের এই লড়াই বিশ্ব কে অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। সরাসরি যুদ্ধ হয় নি এই দুই দেশের মধ্যে কিন্ত দুই দেশের মধ্যে স্নায়ুর লড়াই সেই সময় জিও পলিটিক্যালি বিশ্ব কে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫ টি দেশ তৈরি হয় তারপরই এই স্নায়ু যুদ্ধের অবসান ঘটে।
বর্তমানে আবারও সেই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে এখন আমেরিকা ও চীনের মধ্যে পরিস্থিতি খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তবে এখানে একটা অদ্ভুত ব্যপার হচ্ছে মিডিয়াম সাইজ দেশ গুলোর মধ্যে ঝামেলা, যা বিশ্ব কে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তবে এর কারন কী?
এর প্রধান কারন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পিছিয়ে আসা। ২০১৭ তে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকেই আমেরিকা গ্লোবাল পলিটিক্স থেকে সরে আসতে শুরু করে। একের পর এক বড় বড় সংস্থা যেমন WHO বা ওয়াল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, ইউনেস্কো, এমনকি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসে আমেরিকা। আমেরিকার মত সুপার পাওয়ার দেশ মতুন মোটো শুরু করে “মেক আমেরিকা ফাস্ট”. আমেরিকা ২০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেয়, ইরাক, জার্মানি থেকে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেয়। আমেরিকা বিভিন্ন দেশে সেনাবাহিনী রেখে যুদ্ধ করার বদলে নিজেদের অর্থনৈতিক কাঠামো মজবুত করতে শুরু করে। ঠিক এর জন্যই বিশ্বে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আমেরিকার মত এতবড় একটা সুপার পাওয়ারের এভাবে সরে আসাতে একটা হিউজ পাওয়ার গ্যাপিং তৈরি হয়েছে যার জন্য মিডিয়াম সাইজ পাওয়ার গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। যতই হোক দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বের সিকিউরিটি হেড হিসাবে ছিল, কিন্তু ২০১৭ এর পর থেকে আমেরিকা একটু সরে আসায় গ্যাপ তৈরি হয়েছে। যার জন্য ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার কিছুটা হলেও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
এখন দেখা যাক কোন কোন মিডিয়াম সাইজ দেশ সমস্যা তৈরি করছে। এইসব দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মুখ্য হচ্ছে তুরস্ক। তুরস্কের প্রসিডেন্ট রিসেপ তাইপে এরদোগান অটোম্যান লজিকে বিশ্বাসী, তার লক্ষ্য নিউ অটোম্যান সাম্রাজ্য তৈরি করা। বিষয়টা ভালভাবে বুঝতে হলে অনেকটা পেছনে যেতে হবে সময়টা দ্বাদাশ শতকের শেষের দিকে ১২৯৯-১৯২২ প্রায় আটশ বছর ধরে তুরস্কে অটোম্যান সাম্রাজ্য রাজত্ব ছিল, ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়া এমনকি আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সাম্রাজ্য। এটি একটি মুসলিম সাম্রাজ্য। মধ্য প্রাচ্যের সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, বর্তমান ইসরায়েল, সৌদি আরব এমনকি মিশরের কিছু অংশও এই অটোম্যান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। কিন্ত ১৮৮২ সাল থেকে অতিরিক্ত ঋণের জন্য এই সাম্রাজ্যের ভীত নড়ে যায় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অটোম্যান সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেড়েক মেরে দেয়। অটোম্যান সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে তুলনামূলক অনেক ছোট একটি দেশ তুরস্ক তৈরি হয়। সেইসময় ১৯২৩ সালে তুরস্কের নেতা মুস্তাফা কামাল আর্তাকুক বাধ্য হয়ে লাউশেন চুক্তি করে, চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক ভবিষ্যতে কোনওদিন তাদের সীমানা বাড়াবে না, সুতরাং অটোম্যান সাম্রাজ্য তৈরি হবার কোন সম্ভবনা নেই। অনেক জায়গায় দেখবেন এটা রটে গেছে ২০২৩ এ লাউশেন চুক্তির ১০০ বছর পূর্ন হবে চুক্তি ভেঙে যাবে তখন নাকি তুরস্ক অটেম্যান সাম্রাজ্যে আবার তৈরি করবে কিন্তু বাস্তবে লাউশেন চুক্তি তে এমন কোন টাইমলাইন নেই। আর যদি তুরস্কের ভৌগলিক ম্যাপ দেখেন দেখবেন দক্ষিণে রয়েছে ইসরায়েল এবং উত্তরে সমস্ত ন্যাটো দেশগুলো যার জন্য তুরস্ক এসব শক্তিশালী দেশগুলোর সাথে যুদ্ধ করে নিজের পায়ে কুড়ুল মারবে না। হ্যাঁ তুরস্ক হয়ত সিরিয়ার কিছু অংশ দখল করতে পারে। তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ ভেঙে পড়ছে, এর বড় কারন তাদের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের পলিসি। সম্প্রতি আজারবাইজান – আর্মেনিয়ার যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজান কে সাহায্য করে, তুরস্ক লিবিয়া, সিরিয়া তে সেনা পাঠিয়েছে। ভূমধ্যসাগর এলাকায় সাইপ্রাস কে নিয়ে গ্রীসের সাথে ঝামেলা তৈরি করছে। দীর্ঘদিনের বন্ধু রাষ্ট্র আমেরিকার সাথেও ঝামেলা রয়েছে তুরস্কের, যার জন্য আমেরিকার থেকে স্যাংশান খেয়েছে তুরস্ক। ২০১৫ থেকে রিফিউজি সমস্যা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ঝামেলা রয়েছে তুরস্কের। মূলত তুরস্ক এই এলাকা কে পুরো অস্থিতিশীল করে তুলেছে। চারিদিকে এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরির জন্য তুরস্কের অর্থনৈতিল কাঠামো পুরো ভেঙে পড়েছে। তুরস্কের মুদ্রা লিরার মান দ্রুত কমছে।
মধ্যপ্রাচ্যে আরও একটি মিড সাইজ শক্তি হচ্ছে ইরান। লিবিয়া ও সিরিয়া তে সরাসরি যুক্ত আছে ইরান। সিরিয়ার প্রসিডেন্ট বাসার আল আসাদ কে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায় আমেরিকা সহ পশ্চিমা বিশ্ব, এই বাসার আল আসাদ কে সাপোর্ট করে ইরান। লিবিয়া তে হিজবুল্লাহ নামে অরগানাইজেশান সরাসরি ট্রনিং ও অস্ত্র সাহায্য করে ইরান। সম্প্রতি ইরাকের প্রধানমন্ত্রী কে হত্যার চেষ্টা করার অভিযোগ উঠেছে ইরানের বিরুদ্ধে। তাছাড়া ইসরায়েলের সাথে ঝামেলা লেগেই আছে ইরানের। এবার আসছে পাকিস্তানের কথা। পাকিস্তানের কথা কে না জানে, গোটা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের আতুর ঘর হচ্ছে এই পাকিস্তান। আফগানিস্তানে তালিবান কে সাহায্য করে আফগানিস্তান সহ পুরো এলাকা কে অস্থিতিশীল করল পাকিস্তান। আরও একটি দেশ বেলারুশের ও ঝামেলা আছে পোল্যান্ডের সাথে। সম্প্রতি বেলারুশের উপর অভিযোগ উঠেছে বিমান হাইজ্যাকের। এবার আসি ভেনেজুয়েলার কথা, আমেরিকার সাথে অত্যন্ত খারাপ সম্পর্কের কারনে আর্থিক ভাবে দেওলিয়া এই দেশটিতে বর্তমানে স্বৈরাতন্ত্র চলছে। কিউবার সাথে ভেনেজুয়েলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনী কে ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ কিউবাই করে। ২০০৮ সালে কিউবা ও ভেনেজুয়েলার মধ্যে একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী কিউবা ভেনেজুয়েলার মিলিটারি ও ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট কে ট্রেনিং দেয়, এর ফল স্বরুপ ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো জোর কের দেশটিতে রাজত্ব করছে। সৌদি আরবের সাথে ইয়ামেনের ঝামেলা চলছে বহুদিন ধরে, এখানেও ইরান যুক্ত রয়েছে। ইরানই ইয়ামেন কে অস্ত্র সরবরাহ করে। আরও একটি অপ্রত্যাশিত দেশ হচ্ছে উত্তর কোরিয়া। এরকম মিডসাইজ দেশ অনেক রয়েছে যাদের জন্য বিশ্ব একটি ভয়ানক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এমন পরিস্থিতি তৈরির কারন কী। একটা প্রধান কারন তো আগেই বলেছি ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার সরে যাওয়া, যার ফলে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। শুধু এটাই প্রধান কারন না, আরও একটা কারন আছে যেমন শক্তিশালী কোন দেশের সাহায্য। এইসব ছোটখাটো বা মাঝারি দেশ গুলো কিছু শক্তিশালী দেশ সাহায্য করছে। যেমন উদাহরণ হচ্ছে পাকিস্তান। পাকিস্তান কেন এত লাফালাফি করে? কারন পাকিস্তান কে সাহায্য করছে চীন। ঠিক তেমনি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ইয়ামেন কে সাহায্য করছে ইরান আবার ইরান কিছুটা হলেও সাহায্য করে রাশিয়া, চীন। সিরিয়ার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ কে সহায়তা করছে ইরান ও রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া কে সাহায্য করছে চীন। আরও একটি কারন হচ্ছে ক্ষমতা দখলের লোভ। আমেরিকা সরতে যে গ্যাপ তৈরি হয়েছে তা কে পূরন করবে, সেই নিয়ে ঝামেলা।
ধর্ম একটা বড় ফ্যাক্ট, সৌদ আরব ও ইরান তার উদাহরণ। সৌদি আরব মূলত সুন্নি মুসলিম দেশ এবং ইরান একটি শিয়া মুসলিম দেশ সেই নিয়ে ঝামেলা। তুরস্ক ও একটা বড় উদাহরণ, তুরস্কের জন্ম হয়েছিল সেকুলার দেশ হিসাবে কিন্তু আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে তুরস্ক নিজেকে মুসলিম দেশ হিসাবে ঘোষনা করতে পারে। দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে জনগনের নজর ফেরাতেও এসব সমস্যা তৈরি হয়। যেমন উদাহরণ তুরস্ক। তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ এই অবস্থায় চারিদিকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হলে জনগন ব্যাস্ত থাকবে। আরও একটি বড় কারন হচ্ছে শক্তিশালী দেশগুলোর অস্ত্র ব্যবসার জন্যও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এর একটা সমাধান হতে পারে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পুনরায় গ্লোবাল সিকিউরিটি হেড ফিরে আসা। তবে তা হলেও এটা নিশ্চিত যে আগামী দিনে বিশ্ব আমেরিকা বনাম চীন একটি নতুম শীতল যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কে জানে এর থেকেই হয়ত অদূর ভবিষ্যতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হবে।