চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হারের জন্য জহরলাল নেহেরুকে দোষ দেওয়ার কেন হয়?
নিউজ ডেস্কঃ ১৯৬২ সালের ইন্দো চিন যুদ্ধের শেষে কেটে গেছে বহু বছর। কিন্তু এখনও দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক চাপান উত্রান কমেনি বিন্দু মাত্রও। একই সাথে সেই যুদ্ধের সময় আক্রমণকারী চীনা সেনা বাহিনী (পিএলএ) কে থামানোর জন্য নেহেরু সরকার কেনো বায়ু শক্তির ব্যবহার করেনি তা নিয়েও হয়নি কোনো বিতর্কের অবসান। ফলত, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত গালওয়ান উপত্যকায় চিনা সৈন্যের অনুপ্রবেশের জন্য জওহরলাল নেহেরুকে দায়ী করার প্রচেষ্টা চলছে। তবে, মনে রাখা প্রয়োজন যুদ্ধের যাবতীয় সিদ্ধান্ত মোটেও একা জহরলাল নেহেরু নেননি।
২০০৬ সালের ৩ জুলাই ইন্ডিয়ান ডিফেন্স রিভিউ তে প্রকাশিত এক পত্রে জেনারেল বি.এম. কলের উদ্ধৃত কথা প্রকাশ পায়। যা থেকে জানা যায় ইন্দো – চিন যুদ্ধের সময় নেহেরুর যাবতীয় সিদ্ধান্তে যথেষ্ট প্রভাব ছিল প্রফেসর ব্লকেট, এম্ব্যাসাডার জন গালব্রেথ, বি. এন. মল্লিক এবং ডিরেক্টর ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী (1948) ব্ল্যাকটের এই যুদ্ধের সময় সত্যিই কোনো ভূমিকা ছিল কিনা তার প্রমাণ পাওয়া না গেলেও ১৯৬২ সালের ২৬ অক্টোবর আমেরিকা ও অন্যান্য দেশগুলির কাছে নেহেরুর সাহায্য চেয়ে লেখা চিঠি থেকে গ্যালব্রেথের ভূমিকার কথা সামনে এসেছে।
একই সাথে, বি এন মল্লিকের যে যুদ্ধের সময় নেওয়া যাবতীয় সিদ্ধান্তে অবশ্যই এক বড় ভূমিকা ছিল তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। শুধু সামরিক উপদেষ্টা হিসেবেই নয়, যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শলাপরামর্শ দেওয়া, শান্তি বজায় রাখা, টাস্ক ম্যানেজ করা সহ কিছুর সাথেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। কারণ, নেহরুর মন্ত্রিসভা সেই সময় কিছুতেই পুরোপুরি ভাবে শুধুমাত্র তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেননের উপর যাবতীয় দায়িত্ব চাপিয়ে শান্তি পাচ্ছিল না। তবে, এই ঘটনা সম্পর্কিত সেই সময়ের কোনো নথি প্রকাশিত না হওয়ায় মুলিকের ৬৫০ পাতার স্মৃতিচারণ “দ্য চায়নিজ বিট্রেয়াল” ই ১৯৭১ সালের ঘটনাবলীর একমাত্র আধা সরকারি বিবরণ।
এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, এই বইটি ভারতের প্রয়াত প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাভান দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিল। তাছাড়া, ভারতে কৌশলগত চিন্তার পথপ্রদর্শক এবং ডিফেন্স স্টাডিস অ্যান্ড এ্যনালিসিস (IDSA) এর প্রতিষ্ঠাতা, পরিচালক প্রয়াত কে. সুব্রামানিয়াম ও এই বইটিকে ছাড় দিয়েছিলেন। বইয়ে সত্যতা বজায় রাখতে যুদ্ধের বিবরণী দেওয়া প্রত্যেকটি অধ্যায় ১৯৬১-১৯৬৩ সাল পর্যন্ত যাবতীয় সামরিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মেজর জেনারেল ডি.কে.পালিত দ্বারা যাচাই করা হয়েছিল। পলিত স্বয়ং সেই সময়ের কার্যত সমস্ত উচ্চ-স্তরের সভায় অংশ নিতেন।
ঘটনার প্রথম সূত্রপাত ১৯৬২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর দুই চিনা কোম্পানি থাগলা ব্রিজ অতিক্রম করে আসাম প্রবেশ করে ধোলা পোস্ট অবরোধ করলে। এর আগেই অবশ্য গালওয়ান নদীর উপর ভারতের পোস্ট, প্যাংগং সো -তে ইউলা এবং দীপসাং সমভূমিতে আরো কয়েকটি ছোট পোস্ট ঘিরে ফেলেছিল পিএলএ। থাগলা ব্রিজ অবরোধের পরেই অবস্থা বুঝে মেনন ১০ সেপ্টেম্বর থেকে তার দৈনিক সভা আয়োজন শুরু করেন।
নেহরু নয়, বরং বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সভার আয়োজন করতেন তিনিই। মূলত সিওএএস জেনারেল আরএন থাপার, এয়ার মার্শাল অ্যাসপি ইঞ্জিনিয়ার, পররাষ্ট্র সচিব এমজে দেসাই, ডিআইবি মুল্লিক এবং অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা সচিব এইচ.সি. সারিনের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হতো সভাগুলি। তবে শোনা যায় কৃষ্ণ মেনন কখনোই কারোর ওপর জোর করে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন না। বরং মুলিকের রেকর্ড থেকে জানা যায় ১৭ ই সেপ্টেম্বর উত্তর-পূর্ব ভারতের চীন সীমান্তে যুদ্ধের সরঞ্জাম পৌঁছানোর জন্য মেনন জখম আই এ এস এর পরিপূরক হিসাবে কলিঙ্গ এয়ার ওয়েস ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখন সরাসরি মেননের বিরোধিতা করেন তৎকালীন এয়ার চিফ।
চিন দৌলত বেগ ওল্ডি, গালওয়ান এবং হট স্প্রিংসকে আক্রমণের হুমকি দিলে ১৮ই সেপ্টেম্বর পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে আলোচনার সময় প্রথম চিনা আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ব্যবহারের কথা উঠে আসে। ঘটনা হলো, সেই সময় সেনা কমান্ডার জেনারেল দৌলত সিং লেহ এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে মনোনিবেশ করার জন্য বাকি অংশ থেকে সামরিক সেনা পদ প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিলে এয়ার চীফ সেই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তার দাবি ছিলো, আইএএফ চুশুল বিমানক্ষেত্রটি খুব কষ্টে তৈরি করেছে এবং প্রয়োজনে তারা লাদাখের সীমান্তবর্তী পশ্চিম তিব্বতে লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলার প্রস্তাব ও দিয়েছে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত COAS ও রাজি না হওয়ায় সেনা কমান্ডার তার পরামর্শ প্রত্যাহার করে নেন।
আইবি -কে তখন নিজস্ব সূত্র মারফত তিব্বত, সিনকিয়াং এবং ইউনান -এ চীনা বিমান ক্ষেত্রগুলি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। মুলিকের নিজের বয়ান “সেই সময় রাশিয়া ও আমেরিকা ছাড়া সবচেয়ে শক্তিশালী বিমান বাহিনী সম্পন্ন দেশ হিসাবে পরিচিতি ছিল চীনের। ভারতে কোনো নাইট ইন্টারসেপ্টারের অভাবে, তাদের বোমারু বিমানগুলি দক্ষিণে মাদ্রাজ পর্যন্ত প্রবেশ করতে সক্ষম ছিলো।”
মুলিক সেই সময় সভা চলাকালীন বরংবার সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে চিনা সেনাদের কাছে mig-২১ আছে। কিন্তু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী তীব্রভাবে মুলিকের কথায় অসম্মতি জানান। তবে, মুলিক তার বদলে কিন্তু বার বার দাবি করে এসেছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু চিন নয় এমনকি ইন্দোনেশিয়ার হাতেও MIG-21 তুলে দিয়েছে।
মুলিক তার বইয়ের ৩৫১ নম্বর পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করেছেন যে ঠিক কি কারণে ইন্দো- চীন যুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ব্যবহার হয়নি সেরকম ভাবে। তার মতে “আলোচনার পরে সবদিক পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে যুদ্ধ বাড়ানোর ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয় কারণ ভারতের ওপর আঘাত হানতে চীনের সরাসরি লক্ষ্য ছিলো কলকাতা, কানপুর প্রভৃতি বড়ো শহর। কিন্তু, অপরদিকে চীনের ক্ষতিসাধন করার মতো কোনো টার্গেট ই তিব্বতে ছিলো না। সমস্ত লক্ষ্যই ছিলো ভারতের বোমারু বিমানের নাগালের বাইরে ছিল। তাই ফল স্বরূপ বিমান বাহিনীর ভূমিকা পরিবহন ও অস্ত্র সরবরাহের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ঘটনা হলো প্রথমে ৯ অক্টোবর এবং পরে ৩০ অক্টোবর ভারতের সাথে চীনের সংগ্রাম এতটাই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে যে সেই সময় ভারতীয় সৈন্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বোমা হামলা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। সুতরাং, এক্ষেত্রে নেহেরু দোষারোপ করা নেহাতই বোকামি।