রিভার্স ইন্জিনিয়ারিং এর কারনেই এগিয়ে যাচ্ছে চীন। কতোটা পিছিয়ে ভারতবর্ষ?
রাজেশ রায়ঃ হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড (HAL) এই মহূর্তে দেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজিক ও ডিফেন্স প্রজেক্টে যুক্ত রয়েছে। এই মহূর্তে হ্যালের ঝুলিতে ১ লক্ষ কোটি টাকার অর্ডার রয়েছে। এলসিএ তেজস থেকে শুরু করে কমব্যাট হেলিকপ্টার ও আনম্যানড সিস্টেম সবেতেই হ্যাল কাজ করছে। বিসনেজ ওয়ার্ল্ড এর মনীশ ঝা কে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারে হ্যালের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর আর মাধবন হ্যালের বিভিন্ন প্রজেক্ট এলসিএ তেজস, আমকা, তেজস মার্ক ২, HTT -40 ট্রেনিং এয়ারক্রাফট ও ড্রোনের উপর গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছেন।

আর মাধবন তাঁর সাক্ষাৎকার তিনি যা যা জানিয়েছিলেন
** মনীশ ঝা : প্রাইভেট সেক্টর সংস্থা টাটা অ্যাডভানস্ড সিস্টেম লিমিটেড (TASL) এবং এয়ারবাসের মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে C-295 ট্যাকটিক্যাল মিলিটারি এয়ারক্রাফটের একটি চুক্তি হয়েছে। দেশের একটি বড় এরোস্পেস সংস্থা হিসাবে হ্যাল এটা কী ভাবে দেখছেন?
> আর মাধবন : এটা খুবই ভাল উদ্যোগ। আমরা খুশি যে টাটা এই প্রজেক্টে যুক্ত রয়েছে। আমরা এই প্রজেক্টে যুক্ত হই নি। যখন নতুন কোন ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি হয় তা সে হ্যাল ই হোক বা নতুন কোন প্রাইভেট কোম্পানিরই হোক সেই ইনফ্রাস্ট্রাকচার সঠিক ভাবে ব্যবহার দরকার। টাটা দেশের মধ্যে এই প্রজেক্টের অবশ্যই কিছু পার্টস তৈরি করবে যা দেশের মধ্যে একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করবে।
** মনীশ ঝা :- কিন্তু এই C-295 প্রজেক্টে অংশ নেবার আাশা কী হ্যালের নেই??
> আর মাধবন :- না আমাদের এমন কোন ইচ্ছে নেই যখন নিজস্ব কিছু প্রজেক্ট হবে তখনই হ্যাল তাতে অংশ নেবে। সুতরাং এই ধরনের প্রজেক্ট ছাড়া হ্যাল অন্য কোন প্রজেক্টে অংশ নেবে না। আমরা দেশের মধ্যে একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করছি। আমরা টাটার মতন সংস্থার সাথে এবং সরকারি সংস্থা ন্যালের (ন্যাশানাল এরোস্পেস ল্যাবরেটরি) সাথে যৌথভাবে নিজস্ব মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট তৈরি করব।
** মনীশ ঝা :- হ্যালের কী এই প্রজেক্টের বিষয়ে কোন প্ল্যান আছে? এই মিলিটারি এয়ারক্রাফট তৈরির কোন ডিজাইন কী তৈরি আছে?
> আর মাধবন:- অনেক সময় আগে আমাদের এমন একটি পোগ্রাম ছিল কিন্তু তারপর থেকে আমারা শুধু ট্রান্সফার অফ টেকনোলজি বেসড প্রজেক্টে কাজ করেছি। কিন্ত এটাই সেই সময় যখন আমরা এই প্রজেক্টে কাজ করব। আমরা MTA (মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট) নামে একটি প্রজেক্টে কাজ করেছিলাম, এতে একটি রাশিয়ান কোম্পানি যুক্ত ছিল কিন্তু সেই প্রজেক্ট বেশী দূর এগোয় নি। এবার আমরা সেই প্রজেক্ট শুরু করতে চলেছি তবে এবার এটা আমাদের নিজস্ব প্রজেক্ট হবে। আমরা একটি এয়ারক্রাফট তৈরি করব যা মিলিটারি ও প্যাসেঞ্জার উভয় সেক্টরেই ব্যবহার হবে।
** মনীশ ঝা :- বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অ্যটাক হেলিকপ্টার বোয়িং অ্যাপাচির মতন একটি ১২ টন ক্লাসের অ্যাটাক হেলিকপ্টার তৈরির কথা ঘোষনা করেছিল হ্যাল। আপনারা এটাও জানিয়েছিলেন যদি এ বছরের মধ্যে সরকার ফান্ডিং দেয় তাহলে ২০২৩ এর মধ্যে এর প্রথম প্রোটোটাইপ তৈরি হবে। গ্লোবাল এরিনা তে এটা কী হ্যালের একটি গেম চেঞ্জার প্রজেক্ট??
> আর মাধবন :- হিন্দুস্তান এরোনটিক লিমিটেডের ১৩ টন ক্যাটেগরির মিডিয়াম লিফ্ট হেলিকপ্টার তৈরির একটি প্রজেক্ট আছে যার নাম ইন্ডিয়ান মাল্টিরোল হেলিকপ্টার (IMRH) যা ট্যাকটিক্যাল ট্রুপস পরিবহন, কমব্যাট সার্চ এন্ড রেসকিউ, কমব্যাট লজিস্টিক সাপোর্ট, ক্যাসুয়ালটি এভাকুয়েশন সহ বিভিন্ন মিশনের জন্য উপযোগী। ২০২৮ থেকে ইন্ডিয়ান মিলিটারি তে অ্যাক্টিভ থাকা Mi-17 হেলিকপ্টার গুলোর রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে এটি সার্ভিসে আসবে। কিন্ত অ্যাপাচির মতন হেলিকপ্টার তৈরির কোন প্ল্যান নেই হ্যালের।
** মনীশ ঝা :- ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স ও আর্মির এই মহূর্তে ১৬০ টি লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার (LCH) এর দরকার আছে। ভারত-চীন স্ট্যান্ডঅফের সময় দুই ইন্জিন বিশিষ্ট LCH লাদাখে মোতায়েন ছিল। লের মতন উচ্চতায় এর পারফরম্যান্স কেমন ছিল? আপানদের আর কী প্ল্যান আছে LCH নিয়ে?
> আর মধবন :- হাই অল্টিটিউডে LCH এর পারফরম্যান্স অ্যাপাচির থেকেও ভাল। ভবিষ্যতে এই হেলিকপ্টারে আমরা ইন্ট্রিগেটেড আর্কিটেকচার ডিসপ্লে সিস্টেম (IADS), অটোমেটিক ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম (AFCS), হ্যালের তৈরি আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ টেকনোলজি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট, অ্যান্টি ট্যাংক মিসাইল ইনস্টল করব।
** মনীশ ঝা – প্রথম তেজস মার্ক -১এ ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স এর কাছে কবে আসবে? হ্যাল GE Aviation এর সাথে F-404 ইন্জিনের চুক্তি করেছে ৭১৬ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। এই ইন্জিনের MRO (মেইনটেন্যান্স, রিপিয়ার ও অপারেশন) ফেসিলিটি কী ভারতে আছে?
> আর মাধবন :- কনট্রাক্ট অনুযায়ী হ্যাল অর্ডার পাবার ৩৬ মাসের মধ্যে প্রথম তেজস মার্ক -১ এ ডেলিভারি দেবে। সেই হিসাবে ২০২৪ এর ফেব্রুয়ারিতে প্রথম মার্ক ১ এ ডেলিভারি হবে। বর্তমানে ডিজাইন চলছে, আমারা আশা করছি ২০২২ এর মার্চের মধ্যে প্রথম প্রোটোটাইপ ফ্লাই করবে। আমরা GE Aviation এর সাথে ৯৯ টি F-404 ইন্জিনের চুক্তি করেছি, ইন্জিন সাপোর্ট প্যাক সহ। প্রত্যেকটি এয়ারফোর্স বেসে ইন্জিন টেস্টিং ফেসিলিটি তৈরি করবে হ্যাল। তবে এই চুক্তির মধ্যে MRO ফেসিলিটি নেই। আমরা GE aviation এর সাথে আলোচনা করছি ভারতে একটি D লেভেল মেইনটেন্যান্স ফেসিলিটি তৈরি করার জন্য।
** মনীশ ঝা :- তেজস মার্ক-২ এর প্রথম প্রোটোটাইপ কবে আসবে?
> আর মাধবন :- সমস্ত ট্রায়াল সম্পন্ন করার পর আশা করা হচ্ছে ২০২৬ এ মার্ক -২ প্রোডাকশনে আসবে।
** মনীশ ঝা :- AMCA এর ব্যাপারে কিছু বলুন
> আর মাধবন :- দেখুন অ্যাডভান্সড মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফটের (AMCA) এর প্রি ডিজাইন ফেজ কমপ্লিট হয়ে গেছে। এর অন্যান্য টেকনোলজির উপর কাজ চলছে। সম্ভবত ২০৩০-৩২ এ ফাইনাল সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। এটা যদিও একটি ডিআরডিও প্রজেক্ট তাই এর সঠিক টাইমলাইন বলা সম্ভব না। তবে আমরা যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব চেষ্টা করছি।
** মনীশ ঝা :- আপনি সম্প্রতি বলেছেন তেজস মার্ক -২ এর জন্য GE এর তৈরি F-414 ইঞ্জিন ভারতে তৈরি হবে। কিন্তু অনেক চুক্তি সত্বেও এমন হাইটেক টেকনোলজি ভারতে আনা সম্ভব হয় নি, রাফায়েল অফসেট চুক্তিতেও একই ব্যাপার হয়েছিল।
> আর মাধবন:- এলসিএ মার্ক -২ একটি মিডিয়াম ওয়েট ফাইটার জেট যাতে GE F414 ইঞ্জিন ব্যবহার করা হবে যা ৯৫KN পাওয়ার যুক্ত। GE জানিয়েছে এই ইন্জিনের ৬০% ভারতে তৈরি হবে। বর্তমানে হ্যাল দুটি এরো ইন্জিন তৈরি করছে যা হেলিকপ্টার ও ছোট বিসনেজ জেটে ব্যবহার হবে। তবে হাইথ্রাস্ট ইন্জিন তৈরির চেষ্টাও শুরু হয়েছে।
** মনীশ ঝা:- হ্যাল নিজের ফান্ডিং এ ফ্ল্যাগশিপ বেসিক ট্রেনার HTT-40 তৈরি করেছে। এর ফাইনাল আপডেট কী? এই এয়ারক্রাফটের জন্য সিলেক্টেড হানিওয়েলের TP331-12B ইন্জিনের আপডেট কী?
** আর মাধবন:- HTT-40 সমস্ত স্পিন ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে। সী লেভেল পারফরম্যান্স ট্রায়াল ও সম্পন্ন হয়েছে। ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স এ যুক্ত হবার প্রয়োজনীয় সমস্ত শর্ত পুরন করেছে এটি। আমরা হানি ওয়েলের সাথে কথা বলছি এই ইন্জিন ট্রান্সফার অফ টেকনোলজির মাধ্যমে ভারতে তৈরি করার।
** মনীশ ঝা :- এলসিএ তেজস মার্ক ২ এর প্রোটোটাইপ এবং AMCA ডিআরডিও এর এরোনটিক্যাল ডেভলপমেন্ট এজেন্সি (ADA) তে তৈরি হচ্ছে এদের ক্যাপেবিলিটি সম্পর্কে যদি একটু বলেন? একটা রিপোর্ট পাওয়া গেছে এইসব স্ট্রাটেজিক প্রজেক্টের জন্য ফান্ডিং কম হচ্ছে।
> আর মাধবন:- এলসিএ মার্ক -২ একটি মিডিয়াম ওয়েট ৪.৫+ জেনারেশন মাল্টিরোল সুপারসনিক ফাইটার জেট। এটি মিগ-২৯, মিরাজ-২০০০ ও জাগুয়ার ফ্লীট কে রিপ্লেস করবে।
AMCA নেক্সট জেনারেশন হাইলি স্টেলথি গেম চেঞ্জার এয়ারক্রাফট। এলসিএ মার্ক -২ ২০২৭-২৮ এবং AMCA ২০৩৫ এ প্রোডাকশনে যাবে।
** মনীশ ঝা :- আনম্যানড রিমোটলি পাইলট এয়ারক্রাফটের যুগ শুরু হয়েছে। ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স চীফ ইতিমধ্যে এই সব কমব্যাট ড্রোনের ব্যাপারে বলেছে যে গুলি লেজার গাইডেড ডাইরেক্ট এনার্জি ওয়েপনস সমরিদ্ধ। বহু বছর ধরে এয়ারক্রাফট তৈরিতে অভ্যস্ত হ্যাল কী এই ফিল্ডে পিছিয়ে পড়েছে?
> আর মাধবন:- হ্যাল ড্রোন সেক্টরে যথেষ্ট ইনভল্ভড। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হ্যাল ইতিমধ্যে কমব্যাট এয়ার টিমিং সিস্টেম (CATS) এর উপর কাজ করছে। ২০২১ আমরা এই প্রজেক্ট শো কেসড করেছি, সাথে বিভিন্ন পেলোড যুক্ত ড্রোনেরও। ডিআরডিও এর সাথে আমরা মিডিয়াম ও হাই অল্টিটিউড ড্রোন প্রজেক্টে যুক্ত আছি।
** মনীশ ঝা :- টার্বোফ্যান জেট ইন্জিন সবচেয়ে অ্যাডভান্সড ও জটিল প্রাযুক্তি। পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানির সাথে ভারত কী যৌথভাবে এই ইন্জিন তৈরির কথা ভাবছে?
> আর মাধবন:- ডিআরডিও এই সেক্টরে পার্টনার খুঁজছে। খুব কম কোম্পানিই ১১০ KN ইন্জিন তৈরি করতে পারে।
** মনীশ ঝা :- এই ধরনের অ্যাডভান্সড প্রজেক্টের জন্য ফান্ডিং একটা বড় জিনিস। যেমন F-15 ও F-16 এর ইন্জিন তৈরি করতে ৭ বছর লেগেছিল তাতে অন্তত ৪-৫ বিলিয়ন ডলার খরচা হয়েছিল। আমাদের কী সেই বাজেট আছে?
> আর মাধবন:- আসলে এটি ডিআরডিও এর সাথে গভমেন্ট ফান্ডিং প্রজেক্ট। ইন্জিন ডেভেলপমেন্ট ও প্রোটোটাইপ তৈরি তে আলাদা আলাদা ভাবে খরচা করা হবে।
** মনীশ ঝা:- চীন রিভার্স ইন্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে এরো ইন্জিন তৈরি করে ফেলল। সেই তুলনায় ভারত অনেক পিছিয়ে।
> আর মাধবন:- দেখুন চীন রাশিয়ান টেকনোলজি নিয়ে শুরু করেছিল কিন্তু তাতে তারা প্রথমে সফল হয় নি। হ্যা এটা ঠিক তাদের কাছে এখন বিকল্প ইন্জিন আছে। আসলে চীন আলাদা ভাবে কাজ করে, তাদের সমস্ত ডিপার্টমেন্ট সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের এই ক্ষেত্রে একটি ঝামেলা আছে কারন আমাদের ডিজাইন এজেন্সি ও অ্যাপ্রুভাল এজেন্সি আলাদা।