ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক এতো ভালো হওয়ার পেছনে কি কারন রয়েছে জানেন?
২০১৭ সালে প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইসরায়েল যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহু নরেন্দ্র মোদীকে অভিবাদন জানিয়ে বলেন ভারত ও ইসরায়েলের সম্পর্ক অটুট। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বলেন আই ফর আই অর্থাৎ ইন্ডিয়া ফর ইসরায়েল এবং ইসরায়েল ফর ইন্ডিয়া। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হওয়া জঙ্গি হামলার নিন্দা করে ইসরায়েলের সাথে থাকার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ভারত ও ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে সবসময় সেরকম ছিলনা। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ইসরায়েলের সাথে ভারতের মজবুত কূটনৈতিক সম্পর্কের পথ খুব একটা সহজ ছিলনা।
বর্তমান যে জায়গায় ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের বিবাদ রয়েছে সে জায়গায় একটা সময় ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রনে ছিল। জেরুজালেম শহরও ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। ব্রিটিশরা যে কাজ ভারতের সাথে করে ঠিক সেই একই কাজ মধ্যপ্রাচ্যে করে। ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতকে বিভক্ত করে পাকিস্তান তৈরি করে ব্রিটিশরা, সেই একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র ইসরায়েল তৈরি করে ব্রিটিশরা।
মহাত্মা গান্ধী এবং জহরলাল নেহেরু দুজনেই প্যালেস্টাইনের মাঝে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের বিপক্ষে ছিলেন, বরং তাঁরা প্যালেস্টাইনের পক্ষে ছিলেন কারন তারা মনে করতেন ধর্মের ভিত্তিতে দুটো দেশ তৈরি হলে পরে সমস্যা তৈরি হবে।
এর অর্থ এই নয় যে তাঁরা ইহুদিদের বিপক্ষে ছিলেন, জেরুজালেমে ইহুদিরা ১৯২০ সাল থেকেই থাকতে শুরু করেছিল সেসময় তারা অবশ্য সংখ্যা লঘু ছিল, পরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদিরা এসে এখানে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ নির্দেশ দেয় বিভাজন হবে এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র তৈরি হয়। ভারত সেসময় ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিলেও দীর্ঘদিন ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিলনা।
১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসীমা রাও এর সরকারের সময় ইসরায়েলের সাথে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়। তবে মজার ব্যাপার হল এর আগেও বিভিন্ন যুদ্ধে ইসরায়েল ভারতকে সমর্থন দিত অর্থাৎ সরকারি ভাবে ইসরায়েল ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক ১৯৯২ সালে তৈরি হলেও পর্দার পেছনে অনেক আগে থেকেই ইসরায়েল ভারতের সম্পর্ক ছিল। ইসরায়েলের সাথে ভারতের সরকারী ভাবে দীর্ঘদিন কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার পেছনে প্রধান দুটি কারন ছিল আরব বিশ্ব এবং জোট নিরপেক্ষতা। আরব দেশগুলো প্রথম থেকেই ইসরায়েলের বিরোধী এবং প্যালেস্টাইনের পক্ষে ছিল।
ভারত আরব দেশগুলোর উপর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারনে কীছুটা নির্ভরশীল ছিল সেসময়। ১৯৬০ এর দশকে আরব দেশগুলো থেকে তেলের ব্যাপক রপ্তানি শুরু হয়, ভারতের অর্থনীতি তেলের উপর নির্ভরশীল ছিল তাছাড়া আরব দেশ গুলোতে প্রচুর ভারতীয় মানুষ কাজ করতো যার থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা লাভ হত ভারত সরকারের। এটাতো গেল অর্থনৈতিক কারন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভোট একটা বড় কারন ছিল। ভারতে একটি বড় সংখ্যায় মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে যাদের সমর্থন প্যালেস্টাইনের পক্ষে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলছিল যাতে গোটা বিশ্ব দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে যায়। তবে ভারতের মতো কিছু কোন পক্ষেই যোগ না দিয়ে জোট নিরপেক্ষ থাকে। অনেক আরব দেশও ভারতের সাথেই জোট নিরপেক্ষ ছিল। তবে আরব দেশগুলো নামে জোট নিরপেক্ষ থাকলেও তাদের সমর্থন সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষেই ছিল। কারন আমেরিকা ইসরায়েলের পক্ষে ছিল যার কারনে স্বাভাবিক ভাবেই আরব দেশগুলোর সমর্থন সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ছিল। এই জোট নিরপেক্ষতার জন্য ভারতও সরাসরি ইসরায়েলকে সমর্থন করতে পারতনা। ভারত নিজেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘনিষ্ঠ ছিল। তবে ১৯৯০ এর দশকে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়। প্রথম গল্ফ যুদ্ধ শুরু হয় এই সময়। ইরাক কুয়েত আক্রমন করে মাত্র দুদিনে কুয়েত দখল করে নেয়।
১৯৮০ এর দশকে ইরাক ইরান যুদ্ধে ইরাকের ৮০ বিলিয়ন ডলার ঋন হয়ে যায়৷ কুয়েত একাই ১৪ বিলিয়ন ডলার ঋন দিয়েছিল ইরাককে। যুদ্ধ শেষ হবার পর কুয়েত ইরাককে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। আবার কুয়েত নিজে এত বেশী পরিমান তেল উৎপাদন শুরু করে এই সময় যাতে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমে যায়, ফলে ইরাককেও কম দামে তেল বিক্রি করতে হচ্ছিল। যার কারনে ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমনের নির্দেশ দেয়। ইরাকের কুয়েত দখলের পর আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে সেনা পাঠায় কারন ইরাক সৌদি আরব দখল করবারও পরিকল্পনায় ছিল এরকম হলে বিশ্ব বাজারে তেলের নিয়ন্ত্রন সাদ্দাম হোসেনের হাতে চলে যেত যা আমেরিকা কখনওই চাইছিলনা।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙে যায় এবং রাশিয়ার সাথে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়। অন্যদিকে সিরিয়া, জর্ডান, লেবাননের মতোন আরব দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের শান্তি চুক্তি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলা শীতল যুদ্ধের অবসান হয়, উপরন্তু আরব দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া শুরু হওয়ায় ভারতও সরাসরি ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। ইসরায়েল ভারতকে অনেকবার সমর্থন করেছে। ১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধের সময় আরব বিশ্ব নিরপেক্ষ ছিল কিন্তু সেসময় ইসরায়েল ভারতের পক্ষে ছিল। আরব দেশগুলো থেকে ভারত তেল আমদানি করে তবুও ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে আরব বিশ্ব পাকিস্তানের পক্ষে কিন্তু ইসরায়েল ভারতকে সহায়তা করে।
১৯৯৮ সালে ভারত যখন পরমানু বোম্ব পরীক্ষা বা পোখরান ২ করে তখন আমেরিকার বিল ক্লিন্টন সরকার ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর ঠিক একবছর পর ১৯৯৯ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কারগিল যুদ্ধ হয়, এই যু্দ্ধে ভারতীয় বায়ুসেনা ও প্রিশিসন গাইডেড বোম্ব দেয় ইসরায়েল। ১৯৬৮ সালে ভারতের ইনটেলিজেন্স সংস্থা র এর গঠন হয়। সেসময় র এর প্রধান আর এন কাওকে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নির্দেশ দিয়েছিলেন ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে। মোসাদকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক ইনটেলিজেন্স সংস্থা বলা হয়, মোসাদ সেসময় র কে সহায়তা করেছিল। ২০১৭ সালে কাশ্মীর ইস্যুতেও ইসরায়েল ভারতকে সমর্থন করে যেখানে আরব বিশ্ব দীর্ঘদিন কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন করতো। এমনকী সিএএতেও ইসরায়েল ভারতকে সমর্থন করে জানায় এটা ভারতের আভ্যন্তরীন বিষয়।
রাশিয়া,আমেরিকার পর ইসরায়েল থেকে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সরঞ্জাম কেনে। ২০১২ থেকে ২০১৬ তে ভারত ইসরায়েল থেকে ৪১ শতাংশ সামরিক অস্ত্র কিনেছে। সাইবার সিকিউরিটি, কৃষি প্রযুক্তি, কাউন্টার টেররিজমে ভারত ও ইসরায়েল যৌথভাবে কাজ করে।
১৯৯০ সালে আমেরিকা পাকিস্তানকে হারপুন মিসাইল বিক্রি করে, এর বিপরীতে ইসরায়েল থেকে ভারত বারাক ১ এয়ারডিফেন্স মিসাইল কেনে। ইসরায়েল থেকেই অত্যাধুনিক হেরন ড্রোন, স্পাইডার, বারাক ৮ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম কিনেছে ভারত। সুতরাং বহুকাল থেকেই ইসরায়েল ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত। রাশিয়া, ফ্রান্সের মতোই ইসরায়েল ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু দেশ। যার কারনে হামাসের মতোন জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে ভারত ইসরায়েলকে সমর্থন করছে।