চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে কতোটা প্রস্তুত ভারতবর্ষ?
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ মার্কিন শক্তির সীমাবদ্ধতা এবং আবারো একটি যুদ্ধ থামাতে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বর্তমান সামরিক সংঘাত মূলত ইউরোপের সামরিক নিরাপত্তা ক্ষেত্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও তা ভূরাজনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে।
এই ঘটনা থেকে ভারতের দুটি শিক্ষণীয় বিষয় নেওয়ার আছে।
প্রথমত, ইউক্রেন আক্রমণের ঘটনা আমেরিকার কাছ থেকে তার একমাত্র নিরাপত্তা-নিশ্চয়তাদানকারীর মর্যাদা কেড়ে নিয়েছি এবং সমগোত্রের সামরিক শক্তির মোকাবিলায় তার সামরিক ও কূটনৈতিক অক্ষমতা তুলে ধরেছে। দ্বিতীয়ত, এই অভিজ্ঞতা বেজিংকে ভারতের বিরুদ্ধে মস্কোর পদক্ষেপ অনুকরণ করতে উৎসাহিত করবে।
পিপলস লিবারেশন আর্মি( পিএলএ) যদি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর( এলএসি) অঞ্চলগুলি দখলের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সংঘর্ষকে যদি স্থানীয় যুদ্ধে রূপান্তরিত করে, তবে ওয়াশিংটনের থেকে নয়াদিল্লি বাগবিন্যাসের বেশি কিছু যে আশা করতে পারেনা তা এখন স্পষ্ট।
অন্যদিকে, ইউক্রেনে আগ্রাসনের ফলে আরোপিত ‘অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞার’ পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া নিজের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। এই প্রেক্ষাপটে এই ধরনের চীনা সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও সামরিক পর্যায়ে ভারতকে লড়তে হবে তার নিজস্ব শক্তিতে।
স্পষ্ট তুই আমেরিকা কখনো রাশিয়ার সঙ্গে কোন সংঘাতে বা যুদ্ধে জড়াতে চায়নি, কারণ তারা রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কে সচেতন এবং পিন্টাগনের আরেকটি চিরাচরিত বা অচিরাচরিত যুদ্ধ করার কোনো আগ্রহ নেই।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক পদক্ষেপের অনেক আগেও আমেরিকা সৈন্য পাঠাতে বা অস্ত্র সরবরাহ করতে অস্বীকার করেছিল। নর্থ আটল্যান্টিক অর্গানাইজেশন (ন্যাটো)- এর জন্য অংশীদারারাও রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সামরিক সংঘাত এড়িয়ে গিয়েছে। বর্তমান সংকট বেজিংকে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে।
রাশিয়ার সামরিক পদক্ষেপকে আগ্রাসন বলে অভিহিত না করে এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদান থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে চীন মস্কোর প্রতি তার প্রচ্ছন্ন সমর্থনের ইঙ্গিত দিয়েছে।
একটি নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি মার্কিন ও রুশ উপেক্ষার সুযোগ নিয়ে বেজিং-এর নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারতকে আক্রমণ করা এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। তাই ভারতকে তার সীমান্তে আরো সজাগ থাকতে হবে এবং কূটনৈতিক ফ্রন্টে সক্রিয় হতে হবে। যদিও নয়া দিল্লি নির্জোট পথ অনুসরণ করেছে। শেষ পর্যন্ত বিতর্কিত ভূরাজনীতি ও যাদের সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষমতা আছে সেই দেশগুলির এগিয়ে আসতে দ্বিধার কারণে, ভারতকে সংকটের সম্মুখীন হতে হবে একা।
বর্তমান সংকট কূটনৈতিক দিক থেকে নয়া দিল্লির জন্য চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে এই কারণে যে দেশটি বিভিন্নভাবে পশ্চিম ও রাশিয়া উভয়ের উপর নির্ভরশীল।
রাশিয়াপন্থী বা পশ্চিমপন্থী বেড়ার উভয় দিকেই নয়াদিল্লি কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। পশ্চিমের সমর্থন হারানোর বিপদ হলো মস্কো যা দিতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি মান সম্মান সামরিক হার্ডওয়্যার ভারত হারাবে। আর রাশিয়ার সমর্থন হারালে নয়াদিল্লিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোট হারাতে হবে।
অদূর ভবিষ্যতের নিরিখে ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে বহু প্রতীক্ষিত এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম ও অন্যান্য সামরিক হার্ডওয়্যার পাওয়া বিলম্বিত হবে।
যুদ্ধের সম্ভাবনা:
২০২০ সালের জুনের গালওয়ান পর্বটি ছিল পিএলএ- এর ধূর্ত তো সামরিক পদক্ষেপ। এটা অবশ্যই উল্লেখ্য যে চীন এখন আরামে শাক্সগাম উপত্যকায় বসে আছে। আর হিমবাহের পূর্বে আছে পাকিস্তান। ভারত এক মুহূর্তের জন্যও অসতর্ক হলে বেজিং ও ইসলামাবাদের মধ্যে সামরিক যোগাযোগ সম্পূর্ণ হতে পারে।
দুই পক্ষের সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা সত্ত্বেও পিএলএ কিন্তু নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সৈন্য ও সামরিক হার্ডওয়্যার মোতায়েন করা অব্যাহত রেখেছে। এটি এই ইঙ্গিতই দেয় যে, চীন ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত কিন্তু সংক্ষিপ্ত সামরিক অভিযান চালাতে পারে।
পিএলএ নিশ্চয়ই এখন ইউক্রেনে রাশিয়ার তৎপরতা খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। মস্কোর লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেলেই সৈন্যদের দলকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে। তবে অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও তারা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী হতে পারেনি।
এর বিপরীতে চীন চায় এমন ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করতে যেখান থেকে সে কখনো ফিরে যাবে না। কাজেই পরবর্তী কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিজের আধিপত্য রাখতে তার প্রয়োজন দুই থেকে তিন দিনের একটি দ্রুত অভিযান।
ইউক্রেনে রাশিয়া একটি চিরাচরিত ঘরানার যুদ্ধ লড়ছে। সাঁজোয়া বাহিনী, যন্ত্রসজ্জিত বাহিনী, ও পদাতিক ইউনিটগুলির জন্য রুশ বিমান বাহিনীর সহায়তা সম্মানিত একাধিক প্রবেশ ও প্রস্থান পথ আছে। বিপরীতে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভূগোল ও আবহাওয়া হলো প্রধান বাধা। যাননির্ভর বাহিনীর জন্য প্রস্থান ও প্রবেশের সীমিত এবং সেখানে পদাতিকদের জন্য পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলা মৃত্যুফাঁদের মধ্যে দিয়ে পা দিয়ে চলার মতো সামিল হতে পারে। এখানে বিমান বাহিনীরও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখানে চিরাচরিত ঘরানা অভিযানের জন্য প্রয়োজন প্রকৃতি ও আধুনিক প্রযুক্তির সমর্থন।
পিএলএ এই বাস্তবতাগুলি সম্পর্কে ভাল ভাবে সচেতন, এবং তাই তারা অন্য হীন পদ্ধতি অবলম্বন করবে। তাদের মধ্যে প্রথমটি হল জলের অস্ত্রায়ন। ২০২০ সালে গালওয়ান সংকটের সময় চীন গালওয়ান নদীর জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে বলে রিপোর্ট এসেছিল এবং বেইজিং ইতিমধ্যেই ব্রহ্মপুত্রের উপর পাঁচটি বাঁধ নির্মাণ করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
সংক্ষেপে, একটি চিরাচরিত পদ্ধতির অভিযান শুরু করার আগে পিএলএ-এর জলের অস্ত্রায়নের ভারতীয় অবস্থানকে প্লাবিত করা বা জলকে দূষিত করার জন্য অন্তর্ঘাত চালানো বা নিচের দিকে জলপ্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এখন প্রশ্ন হল ভারত কি চীনের জল যুদ্ধ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে?
এর উত্তর নিহিত রয়েছে পরিকাঠামোর সেই ধরনের উন্নয়নে যা ইচ্ছাকৃত বন্যা প্রতিরোধ করতে পারে। কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে এটাও বুঝতে হবে যে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখাকে একসঙ্গে কোথাও জড়ো করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকে। বেজিংকে কূটনৈতিক টেবিলে এনে এই অঞ্চলের জল সম্পদ সংক্রান্ত তথ্য দিতে রাজি করাতে হবে এবং নয়া দিল্লিকে চীনের এইভাবে বাঁধ দিয়ে জল আটকানোর ইস্যুতে আইনি পথ খুঁজতে হবে।
পিএলএ-এর দ্বিতীয় ধরনের আক্রমণ হতে পারে নন-কাইনেটিক ক্ষেত্রগুলিকে একযোগে সক্রিয় করা। যেমন- পাঁচমিশালি( হাইব্রিড), গ্রে জোন ও তথ্য যুদ্ধ( সাইবার আক্রমণ, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের সমন্বয়)। এর লক্ষ্য হবে ভারতের কম্যান্ড, নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগ, কম্পিউটার, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাগুলিকে অকেজো করে দেওয়া। কারণ- তাহলে যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ধারণা এলোমেলো হয়ে যাবে এবং পাল্টা আক্রমণ করার ক্ষমতাও কমে যাবে। সেই সঙ্গেই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ কার্যত বন্ধ করে দেওয়া গেলে, নয়া দিল্লির কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়াও বিলম্বিত হবে। ভারতের জন্য এমন পরিস্থিতি একটি কঠিন চ্যালঞ্জ হতে পারে।
পিএলএ-এর প্রচলিত ঘরানার সামরিক আক্রমণ রুখে দেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ওপারে সমতল ভূমিতে পাল্টা আক্রমণ হেনে উচ্চতর অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী যথেষ্ট যুদ্ধ অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। নন কনট্যাক্ট ওয়ারফেয়ারেও ভারতীয় বাহিনী দক্ষতা অর্জন করেছে। তবে চীনের সঙ্গে লড়াই শুধু সংখ্যার খেলা হবে না। প্রযুক্তির অপ্রতিরোধ্য ব্যবহারের বিষয়ও হবে। ভারত সরকারকে দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পরিকাঠামো ও অপ্রচলিত ঘরানার যুদ্ধের ক্ষমতা তৈরি করতে হবে, যা যুদ্ধের প্রতিটি পর্যায়ে সমর্থন দেবে।
সম্প্রতি সেনাপ্রধান জেনারেল এম এম নারাভানে ভারতের ইতিমধ্যে কিছু নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার বিষয়ে তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন। ফাইস চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল মনোজ পান্ডে ‘প্রতিপক্ষের কৌশলগত উদ্দেশ্যগুলিকে পরাস্ত করার জন্য ভারতের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন’ বলেও উল্লেখ করেন।
তাদের বিবৃতিগুলি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ- ভারত যখন তার কৌশলগত পরিকাঠামো তৈরি করে এবং নন-কনট্যাক্ট ওয়ারফেয়ার ক্ষমতা বিকশিত করে সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত করছে। তখন চীন এই সমস্ত দিকগুলি থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছে। এই ধরনের ক্রমাগত নতুন করে উঠে আসতে থাকা চ্যালেঞ্জ গুলির মোকাবিলা করতে ভারতকে অবশ্যই তার নিরাপত্তা জালিকার ফাঁক গুলি দ্রুত ভরাট করতে হবে।