নেতাজি বামপন্থী মহাসভার সাথে বন্ধুত্ব করার পেছনে কি কারন ছিল জানেন?
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ভারতবর্ষের রাজনীতি সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আজও বিস্মিত করে বহু মানুষকেই। এরকমই একটি প্রশ্ন হলো কেন নেতাজির মতো একজন স্বঘোষিত বামপন্থী মহাসভার সাথে মিত্রতা করেছিলেন? আসলে, আমাদের মধ্যে অধিকাংশেরই ধারণা যে সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন সম্পূর্ণভাবে ‘সাভারকর বিরোধী’। তবে, কিছুটা সত্য হলেও এই ধারণাটি কিন্তু পুরোপুরি সঠিক নয়।
বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং হিন্দু মহাসভার রাজনীতির সাথে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস বা তার ফরওয়ার্ড ব্লকের সম্পর্ক ঠিক কেমন ছিলো তা নিয়ে আলোচনা হয়ে এসেছে বহুকাল ধরেই। বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ভুল ভাবে বিকৃতও করা হয়েছে তাদের সম্পর্ক। তবে, নতুন বেশ কিছু তথ্য থেকে পরিষ্কার যে হিন্দু মহাসভা বা সাভারকরের রাজনৈতিক মতাদর্শ নেতাজি কখনোই সমর্থন না করলেও তাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক কিন্তু ছিলো খুবই সূক্ষ। রাজনীতিতে হাজার পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা একে অপরকে বরাবরই শ্রদ্ধার আসনে রাখতেন।
১৯৩৭ সালের মে মাসে সাভারকর যখন জেল থেকে মুক্তি পান, সুভাষ চন্দ্র বসু ও তখন এক বছরের কারাবাস এবং গৃহবন্দিত্ব কাটিয়ে মুক্তি পেয়ে ডালহৌসিতে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। উল্লেখ্য, এর এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে বোস তার ইউরোপীয় নির্বাসন থেকে ভারতে ফেরার সরকারি আদেশ অমান্য করায় প্রত্যাশিত ভাবেই কারাগারে বন্দী করা হয় তাকে। অবশেষে ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে তিনি মুক্তি পান। এই সময় সাভারকারের জনজীবনে প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে একটি বিবৃতি জারি করেছিলেন নেতাজি। তার আশা ছিলো সাভারকরও এরপর যোগদান করবেন কংগ্রেসে। যদিও ঘটেছিলো ঠিক উল্টোটাই। বছরের শেষের দিকে, সাভারকর হিন্দু মহাসভাকে একটি জাতীয় রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে মন দিয়েছিলেন।
অপরদিকে ১৯৩৮ সালে বোস কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে যোগদান করেন। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই এই সময় সভারকর এবং নেতাজির মধ্যে মাঝে মাঝে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে মতবিরোধ ও সংক্ষিপ্ত বাক্য বিনিময় ছাড়া আর সেভাবে কথাবার্তা হয়নি বললেই চলে।নেতাজি সেই সময় দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন যে কোনো রাজনৈতিক দলকে ভবিষ্যতে ভারতের হয়ে গোলটেবিল সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে তা করবে কেবলমাত্র কংগ্রেস। সাভারকর এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে শুধুমাত্র হিন্দু মহাসভাই দেশের হিন্দুদের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি রাখতে পারে। কারণ, তার মতে পূর্ববর্তী নির্বাচনে কংগ্রেস সফলভাবে এদেশের বেশিরভাগ হিন্দু আসন জিততে সক্ষম হয়েছিলো ঠিকই, তবে হিন্দুদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করেনি কংগ্রেস।
বোস এবং সাভারকর, দুজনের এই আমূল ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা বরাবরই পৃথক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কাজ করে এসেছেন। বোস সেই সময় একদিকে যেমন কংগ্রেসের গান্ধীবাদী নেতৃত্বের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন তেমনি তার নিজস্ব দল অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লকের মাধ্যমে একটি বিকল্প জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
কিন্তু, বিপত্তি বাধে ১৯৩৯ সালে। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে সাভারকর এ.কে.-ফজলুল হকের সাম্প্রদায়িক সরকারের বিরুদ্ধে প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভাকে শক্তিশালী করতে বাংলায় এলে রাজনৈতিক তরজা বাঁধে দুজনের মধ্যে। সুভাষ এবং তার বড়ো ভাই শরৎ, উভয়েই সেই সময় কংগ্রেসের প্রাদেশিক আইনসভার নেতা হওয়া সত্ত্বেও নিজস্ব উপায়ে ব্রিটিশ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। অথচ তাদের সমস্ত পরিকল্পনা বারংবার ব্যর্থ হচ্ছিল গান্ধীজির হতক্ষেপে, যিনি সেই সময় পুরোপুরি ভাবে জিডি বিড়লা এবং হকের অর্থমন্ত্রী নলিনী রঞ্জন সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন।
বসুর রাজনৈতিক মুখপত্র হিসাবে পরিচিত, ফরওয়ার্ড ব্লক সেই সময়, কলকাতায় সাভারকারের বক্তৃতাকে ‘টব-থাম্পিং’ বলে অভিহিত করে এবং সমালোচনা করা হয় যে বক্তৃতায় ভুল জিনিসের ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন সাভারকর। প্রকৃতপক্ষে, বোসের করা এই সমালোচনা আসলে সাম্প্রদায়িক সমস্যার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রতিফলিত করেছিলো – যা ছিলো তৎকালীন হিন্দু মহাসভার পদ্ধতির থেকে অনেকটাই আলাদা। ফরোয়ার্ড ব্লক যুক্তি দিয়েছিল যে ‘হিন্দু মহাসভা সাম্প্রদায়িক পার্থক্যকের ওপর বার বার জোর দিয়ে ভারতীয় জাতিসত্তার ধারণাকে এক অপূরণীয় ক্ষতির মুখে ফেলে দিচ্ছে।’
একই সাথে উল্লেখ করা হয় যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং তার অনুগামীগণ কোনোভাবেই সমগ্র ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না বরং তারা বৃহৎ ভারতীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাংশ মাত্র। বাকি মুসলিমদের এক বিশাল অংশ ধীরে ধীরে দায়িত্বশীল জাতীয়তার দীক্ষায় দীক্ষিত হচ্ছে। ফরওয়ার্ড ব্লক পরিষ্কার জানায় যে এই গণ আবেদনকে অস্বীকার করে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের অবদানকে উপেক্ষা করে তারা সাভারকারকে মানতে সক্ষম হবে না।
কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে, রাজনৈতিক চিন্তাধারায় এতটা মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ভোটের জন্য সুভাষ চন্দ্র বোস হিন্দু মহাসভার সাথে একটি নির্বাচনী জোটে প্রবেশ করেছিলেন। এই অধ্যায়টি বরাবরই একেবারে উপেক্ষিত থেকে যায় নেতাজির জীবনীতে। তবে, জোটটি অবশ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ভেঙে যায়। বাংলায় শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বে বসু ও মহাসভার মধ্যে সম্পর্ককে ভীষণভাবেই তিক্ত করে তুলেছিল। তবে, যে প্রশ্নটি এখন অবধি উত্তরহীন ছিল তা হল – কেন বসুর মতো একজন স্বঘোষিত বামপন্থী মহাসভার মতো একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সাথে মিত্রতা করলেন?
ফরোয়ার্ড ব্লকের একটি স্বাক্ষরিত সম্পাদকীয়তে, বোস নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন যে তিনি সমস্ত দলের কাছে, বিশেষ করে হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের কাছে একটি আবেদন জারি করেছিলেন যাতে রাজনৈতিক দলগুলি তাদের মত পার্থক্যের কথা ভুলে অন্তত নাগরিকদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে একত্রিত হয়। আর এর মধ্যে প্রথম সাড়া মেলে হিন্দু মহাসভার তরফ থেকেই। ফলে, একদিকে কথা মতো বিরোধিতা ভুলে জোট বাঁধার জন্য ‘হিন্দু মহাসভার জাতীয়তাবাদী গুনাগুনগুলিকে যেমন নেতাজি কৃতিত্ব দেন, তেমনি সাথে ‘ হিন্দু মহাসভার কঠোর সাম্প্রদায়িক উপাদানগুলোরও সমালোচনা করেছিলেন তিনি। কারণ, প্রয়োজন সত্ত্বেও কংগ্রেসের সাথে কোনো রকম বোঝাপড়ায় যেতে সম্পূর্ণ রকম ভাবে নারাজ ছিলো তারা। হিন্দুসভার সাথে বোঝাপড়ার কারণ হিসাবে বোস দাবি করেছিলেন যে এটি এমন এক সঠিক সিদ্ধান্ত যা ‘যথাযথ সময়ে সাম্প্রদায়িকতার নয়, বরং জাতীয়তাবাদের জয়’ নিশ্চিত করবে। তার মতে, ব্রিটিশ কর্পোরেশনের আধিপত্যকে প্রতিহত করার জন্য দরকার ভারতীয়দের একত্রিত হওয়া।
জোট ভেঙে যাওয়ার পর, ক্ষুব্ধ সুভাষ চন্দ্র বসু স্পষ্টতই জানিয়েছিলেন যে তিনি মহাসভার বিরোধী নন বরং বিরোধী কংগ্রেসকে স্থানচ্যুত করার তাদের এই রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার। ফরওয়ার্ড ব্লকে তিনি লিখেছেন যে হিন্দু মহাসভা বাংলার রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করার জন্য এবং বাংলার হিন্দুদের হয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করার উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলায় আসতে চাইছে কিন্তু, বাঙালিরা অনেক আগেই এই দেশে জাতীয়তাবাদের মেরুদন্ড হয়ে উঠেছে। সত্যি কথা বলতে, হিন্দু মহাসভার সাথে আমাদের কোন ঝগড়া বা বিবাদ নেই। কিন্তু যে রাজনৈতিক দল হিন্দু মহাসভা বাংলার জনজীবনে কংগ্রেসকে প্রতিস্থাপন করতে চায় এবং সেই উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছে, তাদের সঙ্গে লড়াই অনিবার্য। আর এই লড়াই সবে শুরু হয়েছে।”
১৯৪০ সালের জুলাই মাসে নেতাজীকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করার কিছুদিন আগেই, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য একটি বিস্তৃত জোট গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় বসু স্বয়ং সাভারকর এবং জিন্নাহর সাথে দেখা করেছিলেন কিন্তু উভয়ের সাথে আলোচনাই স্পষ্টত হতাশ করেছিলো তাকে। তিনি তাঁর বই, দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল-এর দ্বিতীয় অংশে লিখেছিলেন যে, একদিকে জিন্নাহ যেমন সেই সময় শুধু কিভাবে ব্রিটিশদের সহয়তায় ভারত ভাগের দ্বারা পাকিস্তান গঠন করা যায় সে পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তেমনি সাভারকার আবার অপরদিকে তৎকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে ছিলেন একেবারেই অবচেতন। তিনি শুধুমাত্র চিন্তা করছিলেন যে হিন্দুরা কিভাবে ব্রিটেনের সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করতে পারলে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত হবে।
নেতাজির বয়ান অনুযায়ী দুই নেতার সাথে দীর্ঘ আলোচনার শেষে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে একত্রিত ভাবে একটি জাতীয় অভ্যুত্থানের পরিকল্পনায়, ‘মুসলিম লীগ বা হিন্দু মহাসভা, কারোর কাছ থেকেই কিছু আশা করা যায় না।’
ঘটনাক্রমে, নির্বাচনী জোট পোক্ত হওয়ার অনেক আগেই অর্থাৎ, ১৯৩৯ সালে সুভাষ চন্দ্র বোস যখন সাভারকারের রাজনীতির সমালোচনা করতেন, সেই সময় ৩০ ডিসেম্বর ফরওয়ার্ড ব্লকের একটি সংখ্যায় এস. কৃষ্ণ আইয়ারের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে আশ্চর্যজনকভাবে সভারকারের বেশ উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছিল।
অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নিবন্ধে বলা হয়েছিলো, শতাব্দীর প্রথম দশকে স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের রাজনীতিতে যে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে রোমান্টিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম মিঃ সাভারকর। সত্যিকারের নায়করা যে ধাঁচে তৈরি হয় মহারাষ্ট্রের সাহসী ছেলে সভারকারও জীবনের দীর্ঘ একটা পর্ব যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে পার করেও তার পুরো কর্মজীবনটিকে ব্যবহার করেছে তিলে তিলে এক সাহসী স্বপ্ন এবং অ্যাডভেঞ্চারের দীর্ঘ রোমাঞ্চকর গল্প বুনতে। অবিশ্বাস্য রকমভাবে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অবরুদ্ধ অবস্থায় কাটানোর পর সাভারকর শেষ পর্যন্ত যখন মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পেরেছিলেন, তখন, দেশের সকলের দৃষ্টি ছিলো তাঁর- ই ওপরে। দীর্ঘ এই ধরনের দমন-পীড়নের ফলে যেখানে অন্য যেকোনো একজন মানুষ পুরোপুরিভাবে নিঃশেষ হয়ে যেত, সেখানে সাভারকর সেই পরীক্ষায় সফল ভাবে উত্তীর্ণ তো হয়েছেনই সেই সঙ্গে এই প্রতিকূল পরিস্থিতি তার মধ্যে এনে দিয়েছে প্রখর বুদ্ধি এবং দিয়েছে এক অত্যন্ত গতিশীল চরিত্র। এ থেকেই তার মানসিক শক্তির প্রমাণ মেলে।
একই সঙ্গে ফরওয়ার্ড ব্লকের এই সংখ্যায় আপসোস করে বলা হয় কংগ্রেসের সাথে হাত মিলিয়ে দেশে জাতীয়তাবাদের ঝান্ডাবাহক হিসাবে পবিত্র কাজে তার দুর্দান্ত উপহারগুলিকে কাজে লাগানোর বদলে সাভারকর হিন্দু মহাসভার ব্যানারের চারপাশে ঘোরাফেরা করছেন এবং একটি সাম্প্রদায়িক স্তোত্র গাইছেন। মিঃ সাভারকর স্পষ্টতই দেশে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ভয়ঙ্কর বৃদ্ধির কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছেন যা, নিঃসন্দেহে আজকের ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে অসুস্থ এবং বিপজ্জনক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনা প্রতিরোধের জন্য তিনি যে পথে যাচ্ছেন তা নিঃসন্দেহে অন্যায্য প্রকৃতির। দেশকে দুটি যুদ্ধ শিবিরে বিভক্ত করে ভবিষ্যতে রক্তপাতের জন্য প্রস্তুত করা একেবারেই বাস্তবসম্মত বা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
যদিও বোস নিজে এই শব্দগুলি লেখেননি, তবে, তার বামপন্থী মুখপত্রে এতগুলো কথা যে পুরোপুরি তাঁর অনুমোদন ছাড়াই লেখা হয়েছিল একথা সম্পূর্ন অবিশ্বাস্য।
যতবার সুভাষ চন্দ্র বোসকে নিয়ে কথা উঠেছে, ততবার, সাভারকর নিজেও কিন্তু প্রকাশ্যে নেতাজির অসংখ্য প্রসংশা এবং গুনগান করেছেন। নেতাজি ভারত ত্যাগ করার প্রায় এক মাসের মাথায়, ১৯৪১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সাভারকার সর্বভারতীয় সুভাষ দিবসের আয়োজকদের কাছে বিদেশে তার নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি বার্তা পাঠান। এই বার্তাই তিনি বলেন: ‘ তিনি যেখানেই থাকুন না কেন সমগ্র জাতির কৃতজ্ঞতা, সহানুভূতি এবং শুভকামনা যেনো সর্বদা তার পাশে থাকে কখনও ব্যর্থ না হওয়া সান্ত্বনা এবং অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে।’
পুনরায়, ১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মুখপত্র সংগঠকের সাথে সাভারকারের শেষ সাক্ষাত্কারে, সাভারকর ভারতের স্বাধীনতা লাভের কারণ হিসাবে ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকটি কারণকে প্রধান হিসাবে চিন্হিত করেছিলেন। যায় মধ্যে তিনটি কারণই ছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সুভাষ চন্দ্র বসু এবং তার আজাদ হিন্দ ফৌজ বাহিনীর সাথে যুক্ত
সাভারকারের মতে, “ভারতের স্বাধীনতায় অবদান আছে বেশ কয়েকটি ঘটনার। কংগ্রেস একাই হিন্দুস্থানের স্বাধীনতা এনেছে এমনটা ভাবা ভুল। একই সাথে শুধুমাত্র অসহযোগ আন্দোলন, চরকা বা ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের জন্যই চাপে পড়ে ব্রিটিশ সরকার আমাদের দেশ থেকে ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে এমনটা মনে করাও সমান অযৌক্তিক। এই কয়েকটি বিষয় ছাড়াও এমন বেশ কয়েকটি গতিশীল এবং বাধ্যতামূলক শক্তি ছিল সেই সময়, যা শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের হঠিয়ে ভারতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিলো। প্রথমত, ভারতের রাজনীতি সেই সময় সেনাবাহিনীর মধ্যেও সফলভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো-সেই সমস্ত সেনাবাহিনী যাদের ওপর ব্রিটিশরা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলো সফলভাবে ভারত শাসন করার জন্য। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের শাসনের সামনে জোড়া হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহ এবং বিমান বাহিনীর বিদ্রোহের হুমকি। তৃতীয়ত অবশ্যই ছিলো নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং আইএনএ-এর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা; ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য হওয়ার চতুর্থ কারণ নিঃসন্দেহে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ। গোড়ার এই ঘটনা ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। এবং সর্বশেষ অর্থাৎ পঞ্চম কারণ হলো কংগ্রেস, সহ অন্যান্য দলের হাজার হাজার বিপ্লবী এবং অসংখ্য দেশপ্রেমিকদের দ্বারা করা অকল্পনীয় আত্মত্যাগ।”