ভারত

প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর প্রোজেক্ট কেন শেষ হচ্ছে না জানেন?

রাজেশ রায়:– বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরপথে মত বিশাল সমুদ্র সীমা পাহাড়া দেওয়ার জন্য দরকার শক্তিশালী নৌবাহিনী। তবে শুধু দেশকে বাইরের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করাই নয় বরং বানিজ্য এবং অন্যান্য দেশের সাথে সুসম্পর্ক রাখার জন্যও নেভি দরকার। সম্প্রতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারতীয় নেভির সী বার্ড প্রজেক্টের রিভিউ করেন৷ এই প্রজেক্টের আওতায় কর্নাটকের কারওয়ারে ভারতীয় নেভির জন্য বিশাল নেভাল বেস তৈরি করা হচ্ছে। ২০২৫ এ যখন এটি সম্পন্ন হবে তখন এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় নেভাল বেস হবে। এর স্ট্রাটেজিক্যাল অবস্থানই এই বেসের গুরুত্ব অনেল বাড়িয়ে দেয়। আজ এই সী বার্ড প্রজেক্ট সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

বিশ্বের সবচেয়ে বড় নেভাল বেস আছে আমেরিকার কাছে। আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে অবস্থিত নেভাল পৃথিবীর সবথেকে বড়। ভার্জিনিয়া রাজ্যে অবস্থিত নেভাল স্টেশন নরফ্লক বেসে একসাথে ৭৫ টি জাহাজ সহ ১৩৪ টি বিমান থাকতে পারে। ১৯১৭ সালে তৈরি এই বেসটিতে এক বছরে এক লক্ষ ফ্লাইট হয় বা প্রতিদিন গড়ে ২৭৫ টি করে বিমান ওঠানামা করে। অর্থাৎ প্রতি ছয় মিনিটে একটি করে বিমান অপারেট হয় এখান থেকে। কর্নাটকের কারওয়ারের এই বেসে একসাথে ৩০ টি জাহাজ ও সাবমেরিন থাকতে পারবে। কারওয়ার বেস সম্পর্কে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা দরকার। এই প্রজেক্টে মোট খরচ ৩ বিলিয়ন ডলার বা সাড়ে বাইশ হাজার কোটি টাকা। প্রায় ১১,০০০ একর জায়গার উপর তৈরি এই বেস ২০২৫ এর মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে মনে করা হচ্ছে এবং এটি দেশের পশ্চিম উপকূলে তৈরি হচ্ছে। 

প্রজেক্ট সী বার্ড দুটি ফেজে সম্পন্ন হচ্ছে। ফেজ ওয়ান সম্পন্ন হয়েছে ২০০৫ সালে এবং ফেজ ২ ২০২৫ এ সম্পন্ন হবার কথা। এবার মনে হতে পারে এত বড় বেস কেন তৈরি করা হচ্ছে? ১৯৭১ সালে যখন ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয় তখন পশ্চিম উপকূলে ভারতীয় নেভিকে সমস্যায় পড়তে হয়। পশ্চিম উপকূলে মুম্বাই বন্দর ছিল কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মুম্বাই বন্দরে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে কারন এটি গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য পথ, সেজন্য কার্গো জাহাজ এখানে প্রচুর আসা যাওয়া করে। সুতরাং এত ভিড়ে অপারেশন করা অনেক সমস্যার তাই একটি বিকল্প বেস তৈরির জন্য জায়গার খোঁজ শুরু হয়। প্রাথমিক ভাবে তিনটি সম্ভাব্য জায়গা নির্বাচন করা হয়। কেরলের কুন্নুর ও ত্রিবান্তপুরম এবং তামিলনাড়ুর টুথুকুডি। কিন্তু ১৯৮২ এর দিকে ভারতীয় নৌবাহিনীর ১১ তম নেভি চীফ অ্যাডমিরাল অস্কার স্ট্যানলি ( ১ মার্চ ১৯৮২ থেকে ৩০ নভেম্বর ১৯৮৪) জানান এমন জায়গা হতে হবে যা পশ্চিম উপকূলে হতে হবে, একদিকে উঁচু পাহাড় এবং অন্যদিকে আরব সাগর থাকবে। সুতরাং এই নিয়মে প্রথমেই তামিলনাড়ুর টুথুকুডি বাদ হয়ে যায়। তিনিই বলেন কারওয়ার সবচেয়ে ভাল জায়গা হবে। অবশেষে এই প্রজেক্ট ১৯৮৬ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সময়ে শুরু হয়। কিন্তু এই প্রজেক্ট শুরুতে দেরী হয় কারন ১৯৯১ এর দিকে ভারতে অর্থনৈতিক সংকট ছিল, এ বিশাল জায়গায় গাছ কাটতে পরিবেশবিদদের ছাড়পত্র দরকার ছিল এবং দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। অবশেষে ১৯৯৯ সালে পোখরান ২ এর পর তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডিজ প্রজেক্ট সী বার্ড শুরু করবার সবুজ সংকেত দেয়। লার্সেন এন্ড টুব্রো এই প্রজেক্টের প্রধান কনট্রাক্টর ছিল তবে এর সাথে জার্মানির হোচটিয়েফ, নেদারল্যান্ডসের ব্যালেস্ট নাদিম ড্রেজিং ও নিডিকো এবং অস্ট্রেলিয়ার রেডিসব কোম্পানি এই প্রজেক্টে যুক্ত ছিল। কারওয়ার বেসের আশেপাশে সমুদ্রে তিনটি ব্রেক ওয়াটার তৈরি করা হয়েছে। আসলে এটি বড় বড় পাথর দিয়ে তৈরি বিশেষ স্থাপনা, সমুদ্রে প্রবল জোয়ারের সময় তৈরি উঁচু ঢেউ, ঝড় এবং সুনামির মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বেসকে রক্ষা করে। এখানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ আছে, আঞ্জুদ্বীপ দ্বীপ, রাউন্ড দ্বীপ ও আর্গ দ্বীপ। এখানে বিনাগা পয়েন্ট বলে একটি জায়গায় ড্রেজিং করে সমুদ্রকে গভীর করা হয়েছে যাতে বড় বড় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এখানে প্রবেশ করতে পারে। পাশাপাশি পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে ব্রেক ওয়াটার তৈরি করা হয়েছে যাতে ৪.৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পাথর ব্যবহার করা হয়েছে যা বেসটিকে রক্ষা করবে। নেভির সদস্যদের থাকবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে সাথে সাথে জাহাজ রিপিয়ারিং ও পুননির্মাণের ব্যবস্থাও রয়েছে। জাহাজ রিপিয়ারিং এর জন্য শিপ লিফ্টিং ও ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ কোন জাহাজ খারাপ হলে তা বিশেষ ক্রেনের সাথে তুলে বেসের ভিতর নির্দিষ্ট ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা আছে। 

ফেজ ওয়ান ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে যাতে ব্রেক ওয়াটার, ড্রেজিং, নেভাল কোয়ার্টার, হসপিটাল, মেইনটেন্যান্স ফেসিলিটি তৈরি করা হয়েছে। কর্নাটকের কারওয়ারে তৈরি এই নেভাল বেসের নাম রাখা হয়েছে আইএনএস কদম্বা। ভারতীয় নেভির পশ্চিম কম্যান্ড আছে মুম্বাইয়ে, দক্ষিন কম্যান্ড আছে কোচিতে এবং পূর্ব কম্যান্ড আছে বিশাখাপত্তনমে। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে যৌথ কমান্ড আছে যা সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনী উভয়ই ব্যবহার করে। আইএনএস কদম্বা বর্তমানে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম নেভাল বেস, যখন কমপ্লিট হবে তখন ভারত সহ এশিয়ার সবচেয়ে বড় নেভাল বেস হবে। মুম্বাই ও কোচির কম্যান্ডের মাঝে এটি অবস্থিত। 

এবার দেখা যাক কেন এখানেই বেস তৈরির জন্য বাছা হয়েছে? প্রথমেই আসছে এর ভৌগোলিক অবস্থান। উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘিরে থাকায় এখানে আক্রমন করা সহজ নয়। দ্বিতীয়ত হচ্ছে এর স্ট্রটেজিক্যাল অবস্থান। আইএনএস কদম্বার একদিকে রয়েছে পারস্য উপসাগর এবং অন্য দিকে পূর্ব এশিয়া। সুয়েল ক্যানেল এর কাছেই অবস্থিত। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক পথ। তৃতীয়ত প্রাকৃতিক ভাবে গভীর সমুদ্র উপলূল এবং চতুর্থত হচ্ছে পর্যাপ্ত জমি। এখন ১১০০০ একর জায়গা জুড়ে এটি তৈরি হচ্ছে কিন্তু ভবিষ্যতে চাইলে নেভি এটা বাড়াতেও পারে। এখানে ভবিষ্যতে জাহাজ তৈরির ব্যবস্থাও করা হবে। ৪৫ স্কয়ার কিলোমিটার বা ১১০০০ একর জায়গা জুড়ে তৈরি এই বেসে আরব সাগরে ২৩ কিলোমিটার উপকূল রয়েছে। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে ভারতীয় নৌবাহিনীর ১১ টি সামনের সারির যুদ্ধজাহাজ সহ ১০ টি ছোট জাহাজ এখানে থাকতে পারে। এখানের শিপ লিফ্ট সিস্টেম ১০,০০০ টন পর্যন্ত জাহজ লিফ্ট করতে পারে। আইএনএস পতঞ্জলি নামে একটি নেভাল হসপিটাল রয়েছে এখানে। আইএনএস কদম্বার প্রথম কম্যান্ডার ছিলেন কে পি রামাচন্দ্রান। ফেজ ওয়ান তৈরি তে খরচ হয় ২৬২৯ কোটি টাকা বা ৩৪৫ মিলিয়ন ডলার। কিন্ত দ্বিতীয় ফেজের খরচ হতে চলেছে প্রায় ১৩,০০০ কোটি টাকা। এখন আইএনএস বিক্রমাদিত্য এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এখানে আছে তবে ভবিষ্যতে আইএনএস বিক্রান্ত ও স্করপিয়ান ক্লাস সাবমেরিনদের এখানে রাখা হবে। ২০১২ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী একে অ্যান্টনির নেতৃত্বে ক্যাবিনেট কমিটি অফ সিকিউরিটি ফেজ ২ এর অনুমোদন দেয় এবং ১৩৫০০ কোটি বা ২ বিলিয়ন ডলারের ফান্ডিং দেওয়া হয়। এখানে নেভি ৫০ টি যুদ্ধজাহাজ রাখবার পরিকল্পনা করেছে। এখানে ৩০০০ ফিট লম্বা রানওয়ে তৈরি করা হচ্ছে যা ভবিষ্যতে বাড়িয়ে ৬০০০ ফিট করা হবে। এই বেস বানানোর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সামুদ্রিক মিশন অপারেট করা। তবে উদ্ধার কার্য, বানিজ্য, এই অঞ্চলের অর্থনৈতিল উন্নয়ন, ফ্লীট সাপোর্ট ও মেইনটেন্যান্সের জন্যও এই বেস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং জানান এই বেস স্ট্রাটেজিক্যালি, কুটনৈতিক ভাবে এবং বানিজ্যের জন্য বিশেষ দরকারী। ভারত মহাসাগরে আমাদের যে সাগর বা সিকিউরিটি এন্ড গ্রোথ ফর অল ইন রিজিয়ন প্রজেক্ট রয়েছে যার লক্ষ এই এলাকায় থাকা দেশ গুলোকে নিরাপত্তা দেওয়া। যদি ভারতীয় নেভি শক্তিশালী হয় তাহলে এই অঞ্চলের দেশ গুলোকে ভারতকে বিশ্বাস করবে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন হবে। সাথে সাথে চীনের জিও পলিটিক্যাল প্রভাব কমবে এই এলাকায়। এই আইএনএস কদম্বার অনেক সুবিধা রয়েছে ভারতের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published.