স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার অগ্নিকন্যা বীণা দাসের অবদান কতোটা জানেন?
গোটা ভারতবর্ষ যখন ইংরেজ শাসনে পরাধীন তখন বাংলার নারীরাও ছিল পরাধীন। কিন্তু সেই পরাধীনতাকে তোয়াক্কা না করে ঝাঁপিয়ে পরেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। নিজেদের জীবনকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে লড়ে গেছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। সেই সমস্ত সংগ্রামী নারীদের মধ্যে আমরা অনেককে হারিয়ে ফেলছি ইতিহাসের পাতায়।আর এই হারিয়ে ফেলা ইতিহাসের পাতায় এক উজ্জ্বল নাম হল বীণা দাস। যার সাহসিকতা এবং বীরত্বে সম্মুখীন বহুবার হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকেরা।
১৯১১ সালে ২৪ আগস্ট নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহন করেছিলেন বীণা দাস। তবে তাদের পৈত্রিক বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। তার পিতা ছিলেন বেণী মাধব দাস যিনি একজন কটকের র্যাভেনশ কলেজের শিক্ষক তথা দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি প্রচুর ছাত্রদের বৈপ্লবিক কার্যকর্মে উদ্দীপিত করেছিলেন। তাঁর মাতার নাম ছিল সরলা দাস যিনি ১৯০০ সালে কলকাতায় নিঃস্ব ও অসহায় মহিলাদের সাহায্যার্থে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সরলা পুণাশ্রম নামে একটি ছাত্রীনিবাস । যেখানে গোপনে এই ছাত্রীনিবাসে বিপ্লবীদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র মজুত রাখা হত এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে গোপনে যুক্ত ছিলেন এই ছাত্রীনিবাসের অনেক ছাত্রী। তাঁর বাবা এবং মা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থাকলেও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে। বেনীমাধব দাস ও সরলা তাঁদের সন্তানদের মনে মুক্তচিন্তার বীজ বপন করেছিলেন শৈশবেই। তাঁর বোন ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণকারী আরো এক অগ্নি কন্যা কল্যাণী দাস। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ছিলেন তাঁর বাবা বেণীমাধব দাসের ছাত্র এবং তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র ছিলেন।
শৈশবকাল থেকেই তিনি দেখেছিলেন তাদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সুভাষের। তাঁকে সুভাষের রাজনৈতিক বিশ্বাস, ব্রিটিশ বিরোধী নীতি প্রভাবিত করেছিল। পরবর্তীকালে বীণা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে শৈশবে একবার তাঁর স্কুলে ইংরেজ ভাইসরয়ের স্ত্রীর স্কুল পরিদর্শন উপলক্ষে মেয়েদের স্কুল থেকে শেখানো হয়েছিল যে ম্যাডামকে ফুল দিয়ে জানাতে এবং স্কুলে প্রবেশের সময় ফুল ছড়িয়ে তাঁর পদতলে নত হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। এটি সে জানতে পারা মাত্রই নিজেকে ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখেন। বীণা দাস তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন “ তাঁর কাছে খুব অপমানজনক লেগেছিল “অভ্যর্থনা জানাবার এই পদ্ধতিটি। তাই সে নীরবে এই রিহার্সাল থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ক্ষোভে অপমানে তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিল। তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিল ক্লাসের আরো দুজন মেয়ে । অত্যন্ত বিচলিত বোধ করে তারা শপথ নিয়েছিল যে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা তাদের জীবন উৎসর্গ করবে। পরবর্তী কালে তাঁর যখনই শৈশবের ওই শপথের কথা মনে আসত, তিনি মানসিকভাবে অনেক শক্তি ফিরে পেতেন আর উদ্দেশ্য সাধনের পথে অবিচল থাকতে পারতেন।”
একবার সুভাষকে তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ও রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী বীণা প্রশ্ন করেছিলেন যে কিভাবে স্বাধীনতা অর্জন করবে দেশ? সশস্ত্র আন্দোলন না কি অহিংস নীতি প্রয়োগ? তখন নেতাজি তাঁর প্রশ্নে উত্তর দিয়েছিলেন যে স্বাধীনতার জন্য প্রতিটি দেশবাসীকে প্যাশনেটলি উন্মুখ হতে হবে তবেই স্বাধীনতা আসবে। সেক্ষেত্রে অহিংস আন্দোলন বা সশস্ত্র আন্দোলন পথটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তিনি স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হলেন বেথুন কলেজে। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনৈতিক মনস্ক হয়ে ওঠেন। ওই সময় তিনি যুগান্তর দলের সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৮ সালে বেথুন কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে তিনি আন্দোলন করেছিলেন সাইমন কমিশন বয়কট করার উদ্দেশ্যে। ওই প্রতিবাদ জন্ম দিল ছাত্রী সংগঠনের। বীণা দাস, তাঁর ভগ্নী কল্যাণী দাস ও আরো কিছু ছাত্রীদের নিয়ে গঠিত হল ছাত্রী সংঘ সংগঠন। এই সংগঠনের সদস্যদের আত্মরক্ষার জন্য শেখান হতো লাঠি চালানো। বিখ্যাত বিপ্লবী দীনেশ মজুমদারের সাথে যোগাযোগ রেখে চলত এই সংগঠন। বীণাকে তাঁর কলেজে এক সহপাঠিনী সুহাসিনী গাঙ্গুলি যোগাযোগ করে দেন বাংলার বিপ্লবী দলের সাথে। ১৯৩০ সালে তিনি ছোট ছোট দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লর্ড ডালহৌসির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে বাংলার গভর্নর স্টানলি জ্যাকসনের আসার খবর পেয়ে বীণা মনস্থির করলেন জ্যাকসনকে হত্যা করার। তাঁর এই লক্ষ্যে বিপ্লবীদের সংগঠন যুগান্তরের সদস্য কমলা দাসগুপ্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর দৃঢ়তা ও অটুট সংকল্পের কথা বুঝতে পেরে বীণা দাসকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন কমলা দাসগুপ্ত। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য এক পুরুষ সহবিপ্লবীর দ্বারস্থ হন তিনি। ২৮০ টাকা দামে একটি চোরাই রিভলভার সংগ্রহ করেন। মানিকতলার কাছে রামমোহন রায় গ্রন্থাগার লুকিয়ে বন্দুক নিয়ে এসে বীণা দাসের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কমলা দাসগুপ্ত। বন্দুক চালানোর কৌশল শিখিয়েছিলেন কিন্তু লক্ষ্যবস্তুতে নিশানা করার অনুশীলন শেখানো যায়নি বীণা দাসকে।কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের সমাবর্তন উৎসবে বাংলার রাজ্যপাল তথা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে স্টানলি জ্যাকসন তাঁর বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। সেই সময়ই বীনা দাসকে তাঁর উপর গুলি চালান। কিন্তু স্ট্যানলি জ্যাকসনের উপর চালানো গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় রক্ষা পেয়ে যান জ্যাকসন এবং বীনা দাসকে পুলিশের হাতে তুলে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দী।
গ্রেপ্তার করে বীণাকে নিয়ে আসে লালবাজারে। পুলিশ কলকাতায় তাঁর হোস্টেলের রুম সার্চ করে পান অনেক বুলেট ও বৈপ্লবিক কাগজ পত্রের সন্ধান। লালবাজারে তাঁর বাবা মা তাঁর সাথে দেখা করতে এলে ব্রিটিশ পুলিশ জানান যে কোথা থেকে অস্ত্র জোগাড় করেছেন বীণা সেটি যদি জানিয়ে দেয় তাহলে তাঁর লঘু শাস্তি হবে। তবে তাদের ওই চাপের কাছে মাথা নত করলেন না তার পরিবার। স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যা প্রচেষ্টায় তাঁর ৯ বছরের জন্য কারাদণ্ড হয়েছিল। আদালতে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের কাঁধেই তুলে নেন গভর্নরের ওপর আক্রমণের দায় এবং সাথে স্পষ্টভাবে জানান যে তার এই প্রতিবাদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যারা সীমাহীন অত্যাচার করে চলেছে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি মানুষের উপর। এরপর বীণা দাসকে পাঠানো হলো মেদিনীপুর জেলে। তিনি জেলে বন্দীদের দুর্দশা দেখে শুরু করেন অনশন। সাতদিন অনশন করার পর তার সব দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয় জেল কতৃর্পক্ষ। এরপর দীর্ঘ সাত বছর বাংলার বিভিন্ন জেলে কাটিয়ে মহাত্মা গান্ধীর চেষ্টায় ১৯৩৯ সালে মুক্তি পান বীণা দাস।
মুক্তিলাভের পর কংগ্রেস পার্টিতে যোগদান করেন বীণা এবং ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ওই সময় তিনি দক্ষিন কলকাতার হাজরায় একটি সভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সেই জনসভা ব্রিটিশ পুলিশ ভেঙে দিতে শুরু করলে বাধা দেন তিনি। সেই অপরাধে তাঁকে তিন বছরের জন্য আবার কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল। রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলেন তিনি। মুক্তি পান ১৯৪৫ সালে। এরপর ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী যতীশ ভৌমিকের সাথে বিবাহ হয় তাঁর। তখন সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু তাঁর সংগ্রামী মনোভাব থেকে সরে যাননি তিনি। বারবার ছুটে গেছেন উৎপীড়িত শোষিত অসহায় মানুষের পাশে।
অমৃতবাজার পত্রিকার কর্মচারী ইউনিয়ন কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশ ও বেতন বৃদ্ধির দাবীতে ১৯৫১ সালে তিনি শুরু করেন ধর্মঘট। কর্মচারীদের পাশে এবং পক্ষে থেকে নিরন্তন সাহস যুগিয়ে গেছেন তাদেরকে। এখানে শেষ নয় দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার যখন পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের মধ্যপ্রদেশের দন্ডকারণ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তখন এর প্রতিবাদে বীনা দাস ও তাঁর স্বামী যতীশ ভৌমিক সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশন প্রত্যাহার করে দেন| শুরু করেন বীণা দাস স্কুলে শিক্ষকতা। ১৯৬০ সালে সমাজসেবায় অবদানের জন্য তাঁকে পদ্মশ্রী-তে সম্মানিত করা হয়েছিল। এরপর তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর আড়ালে ঋষিকেশে চলে যান তিনি।
১৯৮৬ সালের ২৬শে ডিসেম্বর একটি মৃতদেহ ঋষিকেশের রাস্তার ধারে পড়েছিল। বেশ কয়েকদিন ধরে মৃতদেহটি রাস্তায় পড়ে থেকে অর্ধবিকৃত হওয়ার পর খবর যায় লোকাল থানায়। দীর্ঘ তিনমাস অনুসন্ধানের পর পুলিশ জানতে পারে যে এই মৃতদেহটি ছিল ভারতের অগ্নিকন্যা বিপ্লবী বীণা দাসের। দেশের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা এই নারীর সাথে শেষ জীবনে কি ঘটেছিল সে বিষয়ে তথ্য নেই ইতিহাসে পাতায়।