গোটা পৃথিবী জুড়ে আমেরিকা এবং রাশিয়া মোট কত লক্ষ কোটি টাকার অস্ত্র ব্যবসা রয়েছে?
নিজস্ব সংবাদদাতা:গোটা বিশ্ব জুড়ে করোনার দাপটে বিশ্ব অস্ত্র বাজার ছিল কিছুটা নমনীয়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক চাপাউত্রান তো ছিলোই সেই সঙ্গে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই গোটা বিশ্ব জুড়ে বেড়েছিল যুদ্ধের আশঙ্কা। তার ওপর ইসরায়েল প্যালেস্তাইনের মধ্যেও চলছে এক চূড়ান্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা। বেশ কিছু দেশ ক্রমাগত বিশ্বশান্তি রক্ষার চেষ্টা করলেও এই অবস্থাকেই কাজে লাগাচ্ছে বিভিন্ন অস্ত্র কোম্পানিগুলি। অস্ত্রে বিক্রির জোয়ার লাগতেই সুযোগ বুঝে ব্যবসার বাজার পুরোদমে সাজিয়ে ফেলেছে মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন।
১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে লকহিড কর্পোরেশন ও মার্টিন ম্যারিয়েট্টা এই দুই কম্পানির সংযুক্তিকরণের মাধ্যমেই তৈরি হয় আজকের অ্যারোস্পেস, প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কিত অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন। এতটাই বৃহৎ এই কর্পোরেশন যে প্রায় ১১৬০০০ মানুষ কাজ করে এখানে। বিশ্বের অন্যতম সর্ববৃহৎ এই অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি মূলত পাঁচটি অংশের মধ্যে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে। বিশ্ব জুড়ে লকহিডের বিক্রিত পণ্যগুলির মধ্যে ট্রাইডেন্ট ক্ষেপণাস্ত্র, পি-৩ অরিয়ন, এফ-১৬ ফ্যালকন, এফ-২২ র্যাপ্টর, সি-১৩০ হারকিউলিস, এ-৪এআর ফাইটিংহক এবং ডিএসসিএস-৩ উপগ্রহ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
আন্তর্জাতিক সূত্রের খবর, এই চলতি বছরের ১৩ই মে-তেই লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন তাদের অত্যন্ত মূল্যবান এফ-৩৫ লাইটনিং-২ স্টিলথ যুদ্ধ বিমানের ২০০ তম ইউনিট টি আন্তর্জাতিক ক্রেতার কাছে সফল ভাবে হস্তান্তর করেছে। ১.৫৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বিশাল এই প্রজেক্টের মূল মালিকানা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলেও বর্তমানে যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, ইতালী, নেদারল্যাণ্ডস, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক এবং কানাডা সহ আরো ৭ টি দেশ এই এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের লাইফটাইম অংশীদার। অংশীদার হিসাবে এফ-৩৫ তৈরির জন্য নিয়মিত প্রযুক্তি সরবরাহ করে এই দেশগুলো। এ তো গেলো কেবল যুদ্ধ বিমান তৈরির কথা। বিক্রয়ের কথা বলতে হলে, ইসরাইল, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, পোল্যাণ্ড, সিঙ্গাপুর এবং বেলজিয়াম হলো এমন ছটি দেশ যারা এফ-৩৫ এর আন্তর্জাতিক ক্রেতা হিসাবে অগ্রধিকার পেয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এই লিস্টেই নাম যোগ হতে চলেছে মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের। এখনো অব্দি পাওয়া খবর অনুযায়ী ৫০টি এফ-৩৫এ স্টিলথ যুদ্ধবিমান ক্রয়ের জন্য প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রেখেছে এই দেশটি। এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজের বিমান বাহিনীতেই এই মুহূর্তে এফ-৩৫ এ সিরিজের যুদ্ধবিমান রয়েছে ১৮৪টি। এর মেজ মেরিন কর্পোসে এফ-৩৫বি সিরিজের বিমান রয়েছে ৮১ টি এবং নেভীতে এফ-৩৫সি সিরজের এডভান্স স্টিলথ যুদ্ধবিমান রয়েছে মোট ১৮ টি। ভবিষ্যতের কথা ভেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংখ্যা দ্রুতহারে আরো বাড়াচ্ছে। ইতিমধ্যেই নেভীর এয়ার ক্রাফট বহন করার জন্য আরো ২৩৬টি নতুন এফ-৩৫সি, মেরিন কর্পোসের জন্য ১০টি এবং বিমান বাহিনীর জন্য প্রায় তিন শতাধিক এফ-৩৫এ সিরিজের যুদ্ধবিমান অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। আধিকারিকদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যেই এই নতুন বিমানগুলি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে সক্ষম হবে তারা। এদিক দিয়ে আবার বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে রাশিয়া। পঞ্চম প্রজন্মের এসইউ-৫৭ স্টিলথ যুদ্ধবিমানের প্রডাকশন লাইন চালু করা হলেও টাকার অভাবে গত এক দশকে বহু চেষ্টার পরেও ১০টির বেশি জেট ফাইটার সার্ভিসে আনতে সক্ষম হয়নি রাশিয়া।
এফ-৩৫ নিয়ে কথা যখন হচ্ছেই তখন এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখ্য এই মাল্টি-নেশন প্রজেক্টে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ও প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ ছিলো তুরস্ক। সহযোগী দেশ হিসাবে এই প্রজেক্ট থেকে ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আনুমানিক ১৬টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান পাওয়ার কথা ছিল তুরস্কের। এমনকি সম্পর্ক এমনই ছিলো যে ইতিমধ্যেই তুরস্কের চাহিদার ভিত্তিতে বিশেষ ভাবে কাস্টমাইজ করে এফ-৩৫এ সিরিজের ৮টি এডভান্স স্টিলথ যুদ্ধবিমান তৈরির কাজ সম্পন্ন অব্দি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, মাঝখানে তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সংগ্রহ করলে ঝামেলা বাঁধে আমেরিকার সাথে। সম্পর্ক এতটাই তিক্ত হয়ে পড়ে যে পূর্বের মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন তুরস্কে এফ-৩৫ সরবরাহ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। এমনকি নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসনও ২০২১ এর শুরুতেই এই প্রজেক্ট থেকে তুরস্কের অংশীদারিত্ব বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারি ভাবে জানিয়ে দিয়েছে তাদের। ২০১৯ থেকে এফ-৩৫ পরিচালনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লকহীড মার্টিনের ট্রেনিং ফ্যাসালিটিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন বেশ কিছু তুর্কী পাইলট কিন্তু চুক্তি ভঙ্গ হওয়ায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হই তাদেরও।
এইরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্য থেকে বেরোনোর উপায় অবশ্য ছিল তুরস্কের কাছে। তুরস্ক চাইলেই ২০২০ সালের মধ্যে আমেরিকার কাছ থেকে চুক্তিমতো এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান আদায় করে নিয়ে তারপর রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করতে পারতো। সেক্ষেত্রে আমেরিকার পরে বলার কিছু থাকত না। এছাড়া অল্প সংখ্যক এফ-৩৫ তুরস্কের হাতে চলে আসলে সেক্ষেত্রে এমনিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ চাপে থাকতো। এফ-৩৫ এর প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তুরস্ক নিজের দেশে অভূতপূর্ব প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটাতে পারতো। ভেনেজুয়েলা অতীতে ঠিক এই পরিকল্পনাটিকেই কাজে লাগিয়েছিলো। এক সময় আমেরিকা এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ভেনেজুয়েলা কে বিক্রয় করেছিল ঠিকই কিন্তু মাঝে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার বিমান বাহিনীতে সার্ভিসে থাকা এফ-১৬ এর প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা বন্ধ করে দেয়। এমনকি অপগ্রেডিং করতেও অস্বীকার করে। তবে, শেষ অব্দি ভেনিজুয়েলা তাদের হাতে থাকা এফ-১৬ রাশিয়া কিংবা চীনের হাতে তুলে দেবার হুমকী দেওয়ায় আমেরিকা গোপন কিছু শর্ত চাপিয়ে এফ-১৬ আপগ্রেডেড করে দেয় এমনকি প্রয়োজনীয় যাবতীয় যন্ত্রাংশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরবরাহ করতে বাধ্য হয়।
তবে একটা বিষয় মাথায় রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, এফ-৩৫ এর দাম যাই হোক না কেন বা প্রযুক্তি যতোই উন্নত হোক না কেন এর প্রতি ঘণ্টায় অপারেটিং কস্ট কিন্তু অত্যন্ত বেশি। এক একটি এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটারের বর্তমান ক্রয় মূল্য ৯০ মিলিয়ন ডলার। তার ওপর আবার এই যুদ্ধবিমানের পার আওয়ার অপারেটিং কস্ট গিয়ে পৌঁছায় ৩৬ হাজার ডলারের কাছাকাছি। এছাড়া এর আরেকটি অসুবিধা হলো নির্দিষ্ট সময় পর স্টিলথ ক্যাপাবিলিটি ধরে রাখার জন্য এফ-৩৫ এর এয়ার ফ্রেমে গোপন কোটিং দেওয়া আবশ্যিক। কিন্তু, এটা অত্যাধিক রকমের জটিল এক পদ্ধতি হওয়ায় সব মিলিয়ে খরচও অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পায়। ফলে, কেনার ইচ্ছা থাকলেও উন্ননশীল দেশ হিসাবে এই ধরনের খরচ মেটানো মোটেও সহজ নয়।