ভারত

স্বাধীনতা আন্দোলনেকি ভূমিকা ছিল বাংলার অগ্নিকন্যা লীলা নাগের?

নিউজ ডেস্কঃ সাল ১৯০০। যুগটা ছিল পরাধীন ভারতের পরাধীন নারী ক্ষমতা। কিন্তু এই রীতিকে তোয়াক্কা না করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে পুরুষদের পাশাপাশি অনবরত লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় নারীরা। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শত অত্যাচারের পরও হার মানেননি ইংরেজদের কাছে। তাদের মধ্যে এই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম এক বীর সাহসী যোদ্ধা ছিলেন লীলা নাগ। লীলা নাগ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় নাম। যিনি ইংরেজদের ক্ষমতাধীনে থাকা ভারতে দাড়িয়ে ইংরেজদের শাসন বিরোধী কার্যকলাপের পাশাপাশি সেই সময়কার সমাজের বহু রীতির পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন।

১৯০০ সালে ২ অক্টোবর আসামের গোয়ালপাড়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন লীলা নাগ। তার পৈত্রিক বাড়ি ছিল বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার পাঁচগাও গ্রামে। তার জন্মগত নাম ছিল শ্রীমতি লীলাবতী নাগ এবং বাবা মার দেওয়া আদুরে নাম ছিল বুড়ি। তার বাবার নাম ছিল গিরিশ চন্দ্র নাগ যিনি পেশায় একজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এবং তার মা ছিলেন কুনজলতা একজন গৃহিনী। মৌলভী বাজারের অন্যতম শিক্ষিত ও সংস্কৃতমনা পরিবার ছিল লীলা নাগের। ১৯১৬ সালে অবসর গ্রহণ করে তার বাবা চলে যান ঢাকায়। 

১৯০৫ সালে আসামের দেওগড় বিদ্যালয় শুরু হয় লীলা নাগের শিক্ষা জীবন। কিন্তু এর কিছুদিন পরই ১৯৬০ সালে কলকাতা ব্রহ্মা গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি হন তিনি এবং সেখান থেকে সম্পন্ন করে তার প্রাথমিক শিক্ষা। ১৯১১ সালে ঢাকার ইডেন হাই স্কুলে ভর্তি হন। সংগীত সে তার ও চিত্রকলাও শিখেছিলেন তিনি। তৎকালীন সময়ে নানাবিদ গুণাবলীর জন্য ইডেন হাইস্কুলে সকলে দৃষ্টি আকর্ষন করেছিলেন এবং তাঁকে ইডেন হাইস্কুলের শিক্ষকরা নারী নেত্রীর স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং বৃত্তি হিসাবে ১৫ টাকা লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। ওই  কলেজেরই শিক্ষার্থী ছিলেন বিখ্যাত নারী বিপ্লবী কামিনী রায়, অবলা বসু। আইএ পড়ার সময় কলেজের সিনিয়র স্কুডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হন তিনি এবং আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের স্নেহাশীষ লাভ করেন। ১৯১৯ সালে  কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে পাস করেন আইএ। সেই বছরই বেথুন কলেজেই  ইংরেজি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। শিক্ষাজীবন থেকেই তার মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জাগ্রত হতে থাকে। বেথুন কলেজে থাকাকালীন সময়ে তার নেতৃত্বে পরিবর্ত হয়েছিল অনেক পুরনো ধরা। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কলেজের কাজকে গতিশীল করার জন্য গড়ে তোলা ছাত্রী ইউনিয়ন নামে সংগঠন, কলেজের পূর্বতন ছাত্রছাত্রীদের সাথে যোগযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের জন্য রি-ইউনিয়ন নামক সামাজিকতার প্রবর্তন এবং  কলেজের বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বড়লাট স্ত্রিকে নত হয়ে শ্রদ্ধা জানানোর এই রীতিটি বিলুপ্তিতে প্রধান ভূমিকা রাখা। মূলত তার প্রতিবাদেই বিলুপ্ত হয়ে ছিল শ্রদ্ধা জানানোর অপমানজনক রীতিটি। 

১৯২১ সালে ইংরেজি অনার্সে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন। পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে পুরস্কার হিসেবে লাভ করেন পদ্মাবতী স্বর্ণপদকসহ একশ টাকা। ওই বছরই তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এম.এ তে এবং স্থাপন করেছিলেন  নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে ইতিহাস। কারন সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-শিক্ষার নিয়ম ছিল না। তাই ভর্তির জন্য প্রথমবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। কিন্তু তাতে তাঁকে থামানো সম্ভব হয়নি। কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে না মেয়েরা এই প্রশ্ন নিয়ে চ্যান্সেলর ও ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে দেখা করে তার জেদী, সাহসী মেয়ে লীলা। তাঁর  মেধা ও আকাঙ্খা বিবেচনা করে  তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর পি জে হার্টজ লীলাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিশেষ অনুমতি প্রদান দেন। এভাবেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার অধিকার। ১৯২৩ সালে তিনি অর্জন করেন ইংরেজিতে দ্বিতীয় বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এম এ পাশ করেছিলেন লীলা। শিক্ষাজীবন শেষ করে তাঁর জীবনে শুরু হয়েছিল এক নতুন অধ্যায়। 

তিনি গতানুগতিক জীবনের পথে না হেঁটে যোগ দান করেছিলেন নারী শিক্ষার প্রসার ও স্বদেশী  আন্দোলনে। ১৯২২ সালে উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বন্যা বিধ্বস্ত এলাকায় সুবিধার্থে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্ব গঠিত হওয়া  ‘উত্তরবঙ্গ ত্রাণ কমিটি’ র সহ-সম্পাদিকা ছিলেন তিনি। ওই সময় তিনি   দেখেছিলেন নারীদের দুর্দশা। যার তাগিদে তিনি নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্য ১২ জন সহ সংগ্রামী বন্ধুকে নিয়ে গঠিত করেছিলেন ‘দিপালী সংঘ’। এ সংঘের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দীপালি স্কুল,  নারীশিক্ষা মন্দির ও শিক্ষা ভবন নামেও দুটি স্কুল সহ আরও ১২টি অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল। এছাড়াও অনিল রায়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল ও মেয়েদের জন্য ক্লাব। পরবর্তীকালে ঢাকায় তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল দীপালি-১ নামের পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল কামরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুল, এবং নারীশিক্ষা মন্দির নাম রাখা হয়েছিল শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়। ঢাকায় তিনি  আরও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরমানিটোলা বালিকা বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । এছাড়াও তিনি গড়ে  তুলেছিলেন দিপালী ছাত্রী সংঘ, মহিলা আত্মরক্ষা কেন্দ্র, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র, ছাত্রী নিবাস, পাঠাগার ও নারী রক্ষা ফান্ড। বিপ্লবী সুনীল দাসের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন মেয়েদের জন্য ব্যায়ামাগার। সেখানে শেখানো হত ছুরি চালানো, অস্ত্র চালানো, লাঠি খেলা। এইসব প্রতিষ্ঠানে পরিচালনার কাজে তাকে সাহায্য করত তার  পিতা গিরিশচন্দ্র নাগ।

লীলা নাগ দিপালী সংঘ প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে থেকে জড়িত ছিলেন বিপ্লবীদের সাথে। তিনি ছিলেন দিপালীর সঙ্গে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের নেতৃত্বে  এবং সেই প্রশিক্ষণ চালাতেন তিনি গোপনে। তার শিষ্য ছিলেন দিপালী সংঘের অন্যতম সদস্য তথা আরেক অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। নারী জাগরণের ধারাকে সচল রাখতে তিনি ভারতবর্ষে ‘দিপালী ছাত্রী সংগঠন’ নামে প্রথম ছাত্রী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। এই সংগঠনটির মাধ্যমে ছাত্রীরা দাবি দেওয়ার পাশাপাশি অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিল সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডে।

যখন সমগ্র ভারতবর্ষে সাইমন কমিশনের পরিকল্পনা ও প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য গণআন্দোলন গড়ে ওঠে তখন ঢাকার রাজপথ উত্তপ্ত করে তুলেছিলেন লীলা নাগ। ১৯২৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হওয়া নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনে তিনি মঞ্চে উঠে বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে বলার সময়  সর্বভারতীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যার ফলে আরও প্রশস্ত হয়েছিল তার বিপ্লবী জীবনের পথ। 

এরপর কয়েক বছরের মধ্যে  বৈপ্লববিক পরিবর্তিত হতে থাকে দিপালী সংঘের। নারী সমাজের মুখপাত্র হিসাবে প্রকাশিত হয় ‘জয়শ্রী’ নামের একটি পত্রিকা যার মূল ভূমিকা পালন করেন লীলা নাগ।

শুরু হয় ১৯৩০ সালে সত্যাগ্রহ আন্দোলন সেই সময় আশালতা সেন ও লীলা নাগের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ঢাকায় ‘মহিলা সত্যাগ্রহ কমিটি’। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির ফলে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল বহু বিপ্লবীদের। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তার স্বামী অনিল রায়। অনিল রায় গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে ‘ শ্রীসংঘের ‘ দায়িত্ব এসে পড়েছিল লীলা নাগের কাঁধে। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি ভারতবর্ষে বিপ্লবী দলের পরিচালনা করেছিলেন। 

সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার জন্য শ্রীসংঘের সদস্যরা অস্ত্র সংগ্রহ এবং বোমা তৈরি কাজ করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র অনিল দাস, ক্ষিতীশ, বীরেন, ফটিক ও শৈলেশ রায় প্রমুখ বোমার ফর্মুলা নিয়ে কাজ করতেন। ১৯৩১ সালের আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের কার্যকলাপ। এরপর বেশ বিপ্লবীদের হাতে বেশ কিছু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলার জজ নিহত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার মূল চালিকা শক্তিকে খুঁজে বের করা প্রচেষ্টা শুরু করে। অবশেষে  ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর গ্রেফতার করে লীলা নাগকে। গ্রেফতার হওয়ার পর টানা ছয় বছর তিনি ঢাকা, রাজশাহী, সিউড়ি, মেদিনীপুর জেল এবং হিজলীতে কারারুদ্ধ ছিলেন।  ১৯৩৭ সালে ৮ ই অক্টোবরে মুক্তি পান লীলা নাগ। তিনি ছিলেন বিনা বিচারে আটক হওয়া ভারতবর্ষের  প্রথম মহিলা রাজবন্দী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মুক্তির খবর শুনে তাকে চিঠির মাধ্যমে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এরপর বহুবার তাকে কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল।

বাল্যবিবাহ প্রথা ও নারী শিক্ষা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে জন্ম হয়েছিল এই বিপ্লবী নারী। তার বাবা তাকে বারবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তার ইচ্ছা ছিল আজীবন দেশের সেবা করা, দেশের স্বাধীনতা আনা তারপর সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। কিন্তু তার মায়ের মৃত্যু হবার পর তার বৃদ্ধ বাবার অনুরোধে অবশেষে ১৯৩৯ সালে বিপ্লবের অন্যতম প্রেরণাদাতা এবং শ্রীসংঘের প্রতিষ্ঠাতা অনিল রায়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। 

১৯৪৭ এর দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গে আসেন লীলা নাগ। দেশভাগের পর তিনি পাশে এসে দাঁড়ান সংখ্যালঘু ও বস্তুহারাদের চরম দুঃখ ও দুর্দিনে। 

তার বৈবাহিক জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি । ১৯৫২ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে লীলা নাগের স্বামী অনিল রায় মারা যান। বিয়ের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় বিধবা হওয়ায় এবং বহুদিনের আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গীকে তিনি হারিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে সেই শোক অল্পদিনের মধ্যে কাটিয়ে উঠে আবার তিনি পুনরায় মনোনিবেশ করেন তাঁর স্বদেশের বৃহত্তর স্বার্থে। ১৯৬৪ সালে তিনি পূর্ববাংলা বাঁচাও কমিটির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। যার কারনে তাঁকে পুনরায় পুলিশ গ্রেফতার করে। ১৯৬৬ সালে তিনি ছাড়া পান। সেই সময় শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পরেছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাঁকে ভর্তি করা হয় কলকাতার পি.পি হাসপাতালে। ২৩ দিন তাঁর সংজ্ঞা ফিরে এলেও তার বাকক্ষমতা বন্ধ হয়ে যায়।  অচল হয়ে যায় শরীরের ডান অংশ সম্পূর্ণভাবে। এভাবেই প্রায় আড়াই বছর জীবনের সাথে যুদ্ধ করে ১৯৭০ সালের ১১ জুন লীলা নাগ ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকে গমন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.