সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থ সাহায্য করত ভারতবর্ষের উত্তরাখণ্ডের ড্যাম। জানুন বিস্তারিত
রাজেশ রায়:—ভাগীরথী নদীর উপর ড্যাম তৈরি হচ্ছে। স্বাধীন ভারতের প্রথম কোন বড় স্থাপনা যা সম্পন্ন হতে কয়েক দশক লেগে কিন্তু এর পরিকল্পনা ভারত স্বাধীন হবার পরপরই করে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৬১ সালেই এই ড্যাম তৈরির প্রাথমিক সার্ভে শেষ হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর সময়ে ভাগীরথী নদীর উপর তৈরি এই ড্যাম থেকে পরে ভারত ইলেক্ট্রিসিটি সহ কৃষিকাজে অনেক সুবিধা পায় কিন্তু এই ড্যাম তৈরি নিয়ে অনেক ঝামেলাও তৈরি হয়। এই ড্যাম তৈরিতে অর্থনৈতিক ও পরিবেশের সমস্যার থেকেও। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ড্যাম তৈরিতে অর্থ সাহায্য করছিল কিন্তু ১৯৮০ আসতে আসতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয় যার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেয় তখন ভারত সরকার নিজেই এই ড্যাম তৈরির দায়িত্ব নেয়। তেহেরি ড্যাম উত্তরাখন্ডে অবস্থিত কিন্তু যখন এই ড্যাম তৈরি হয় তখন উত্তরাখন্ড উত্তর প্রদেশের অংশ ছিল। ২০০০ সালের ৯ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের উত্তর ভাগ আলাদা করে উত্তরাখন্ড গঠন করা হয়।
তেহেরী ড্যামের গল্প শুরু হয় ১৯৬১ সাল থেকে অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতা লাভের ১৪ বছর পর। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের কাছে তখন প্রধান লক্ষ দেশের প্রত্যেক প্রান্তে প্রতিটি মানুষের ঘরে ইলেকট্রিসিটি পৌঁছে দেওয়া। ১৯৬১ সালেই ড্যাম তৈরির জন্য প্রাথমিক সার্ভে করা হয়। ১৯৬৯ সালে ভারত সরকার কে এই ড্যামের রিপোর্ট দেওয়া হয়। প্রথমে এই ড্যাম থেকে পাওয়া ইলেকট্রিসিটির লক্ষ ৬০০ মেগাওয়াট রাখা হয় এবং এই ড্যামের উচ্চতা ২৬০.৫ মিটার রাখা হয়। সেসময় এটি ভারতের সবচেয়ে বড় জাতীয় প্রজেক্ট ছিল। দেখুন বর্তমানে এর থেকেও অনেক বড় বড় প্রজেক্ট রয়েছে, সেজন্য মনে হতে পারে এটা তেমন কীছু নয়। কিন্তু সেসময়ের বিচারে এটা সত্যিই বড় প্রজেক্ট ছিল। ভারত সরকার কে রিপোর্ট জমা দেবার পর ১৯৭২ সালে ভারত সরকার এই ড্যাম তৈরির অনুমতি দেয় এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে উত্তর প্রদেশ সরকারকে এই ড্যাম তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৭৭-৭৮ পর্যন্ত এই ড্যামে কাজ খুব ধীর গতিতে হতে থাকে এর প্রধান কারন হচ্ছে ফান্ডিং কম থাকার কারনে। এই সময় এই ড্যাম থেকে প্রাপ্ত ইলেকট্রিসিটির লক্ষ বাড়িয়ে ৬০০ মেগাওয়াট থেকে ১০০০ মেগাওয়াট করা হয়। অর্থাৎ পরিকল্পনা পরিবর্তন করে নতুন করে কাজ শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে এই কোটেশ্বর হাইড্রো পাওয়ার ড্যাম তৈরিরও অনুমোদন দেওয়া হয়। কোটেশ্বর হাইড্রো পাওয়ার ড্যাম তেহেরি ড্যামের নীচে তৈরি হয়েছে, এটি শুরু হয়ে গেছে। তেহেরি ড্যাম ২৬০.৫ মিটার উচ্চ এবং এর জন্য ৪২.৫ স্কোয়ার কিলোমিটার লেক তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে কোটেশ্বর ড্যাম ১০৩ মিটার উচ্চ এবং এর জন্য ২.৬৫ স্কোয়ার কিলোমিটার লেক তৈরি করা হয়েছে। ভাগীরথী নদীর উপর তৈরি এই ড্যামে প্রায় ১২৫ টি গ্রাম পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার মধ্যে ৩৭ টি গ্রাম জলের তলায় এবং ৮৮ টি গ্রাম অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুরোনো তেহেরী শহর আজ ড্যামের রিজার্ভারের তলায়। আজ যে শহর আমরা দেখি তাকে নতুন তেহেরী শহর বলা হয়। তবে চিন্তা নেই কোনও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। এখানে ড্যাম করবার আগে জনবসতি ফাঁকা করা হয়েছিল। তেহেরি ড্যাম বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম আর্থ ফিল ড্যাম এবং সব মিলিয়ে বিশ্বের দশম উচ্চতম ড্যাম। ভাগীরথী নদীর উপর তৈরি এই ড্যাম কোটেশ্বর ড্যামের সাথে মিলিয়ে ১০০০ মেগাওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে এবং ২৬১৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার জল ধরে রাখতে পারে। বর্ষাকালে এই জল ভর্তি হয় এবং এই জলই উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, পাঞ্জাব ও রাজস্থানের প্রায় নয় লাখ হেক্টর জমিতে চাষের জন্য ব্যবহার হয়। এছাড়াও এই ড্যাম দিল্লির ৪০ লাখ লোককে ৩০০ কিউসেক এবং উত্তর প্রদেশের মানুষকে ২০০ কিউসেক পানীয় জল সরবরাহ করে। তেহেরী ড্যাম সত্যি করেই দিল্লি ও আগ্রার মানুষের পিপাসা মেটায়, সাথে সাথে এতটাই কৃষিকাজের জন্য জল দেয় যে চাষীরা বছরে তিনটি শস্য পর্যন্ত উৎপন্ন করতে পারে। দরকার পড়লে গঙ্গাতে অতিরিক্ত জল সরবরাহ করে এই ড্যাম।
কুম্ভের সময় গঙ্গায় শাহী স্নানের সময় হরিদ্বার ও প্রায়াগরাজে অতিরিক্ত জল সাপ্লাই এই ড্যামের মাধ্যমেই আসে। এই ড্যাম ১০০০ মেগাওয়াটের পূর্ণ ক্ষমতা সবসময়ই উৎপন্ন করে এবং প্রতি বছর ভারতের উত্তর গ্রীড কে ৩০০০ মিলিয়ন ইউনিট শক্তি সরবরাহ করে। এই ড্যাম গঠনের ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক লাভ ভারতেরও হয়েছে। এই ড্যাম তৈরির সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশেষ সহায়তা করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা মিলে এই ড্যামের নিরপত্তার ব্যাপার গুলো সুনিশ্চিত করে। তারপরই অবশেষে ১৯৯৪ সালে ভারত সরকার এই ড্যাম তৈরির সবুজ সংকেত দেয় এবং ১৯৯৫ সালে কাজ আরাম্ভ হয়। ১০ বছর সময় লাগে এই ড্যাম তৈরিতে। ২০০৫ সালের অক্টোবর এই কাজ সম্পন্ন হয় এবং তেহেরী রিজার্ভার থেকে জল আসা শুরু হয়। কিন্তু ড্যামের পাওয়ার হাউস ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং জুলাই, ২০০৭ এ এই ড্যাম পুরোপুরি শুরু হয়। কোটেশ্বর ড্যাম ২০১২ তে শুরু হয়। তবে এই ড্যাম তৈরির জন্য অনেক লোককে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরাতে হয়েছিল। প্রায় এক লক্ষ লোককে অন্যত্র সরাতে হয়, যার জন্য দীর্ঘদিন কোর্টে মামলা চলে যার জন্য এই প্রজেক্টে দেরী হয় অনেক। লোকেদের দুই ভাগ করা হয়েছিল পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হিসাবে। যাদের ৫০ শতাংশের উপর ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় রাখা হয়, এদের অর্থ ও জমি দেওয়া হয় নতুন জায়গায়।
পুরোনো তেহেরি শহর যা আজ জলের তলায় সেখনকার ৫,২৯১ পরিবার কে নতুন তেহেরি শহরে জমি দেওয়া হয়। মোট ৫,৪২৯ পরিবার পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৩,৮১০ পরিবার আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ ছিল। ১৯৯৬ সালে এইসব পরিবারের কতটা ক্ষতি হয়েছে যাচাই করবার জন্য হনুমান্তা রাও কমিটি গঠন করা হয়, কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ৩৩,০০০ টাকা ঘর তৈরিতে এবং নতুন দোকান দেওয়া হয় এবং পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ২-৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়, সাথে পানীয় জলের সুবিধা এবং চাষযোগ্য জমি দেওয়া হয়। তবে এই তেহেরি ড্যাম করা নিয়ে পরিবেশবিদরা এবং স্থানীয় মানুষরা আন্দোলন করেছিল অনেক। পরিবেশবিদ দের দাবি ছিল সঠিক কোন পরিকল্পনা ছাড়াই এত বিশাল পরিমান লোককে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাদের আরও দাবি ছিল এই ড্যাম বিশেষ জিওলজিক্যাল ফল্ট লাইনে অবস্থিত যাখানে তীব্র ভূমিকম্প আসার সম্ভবনা আছে। যদিও এই ড্যাম রিখটার স্কেলে ৮.৪ ম্যাগনিটিউড ভূমিকম্প পর্যন্ত সইতে পারে কিন্তু এর বেশী ভূমিকম্প এলে সমস্যা আছে। এই ড্যাম ভেঙে গেলে হরিদ্বার, রিষিকেশ সহ অনেক শহর ডুবে যেতে পারে সাথে কোটি কোটি মানুষের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ড্যামের প্রভাব ভাগীরথী নদীর উপরও পড়েছিল যেখানে ড্যাম হবার আগে ভাগীরথী নদীর প্রবাহ ১০০০ কিউবিক ফিট প্রতি সেকেন্ড ছিল সেখানে ২০০৫ এ রিজার্ভার তৈরি হবার পর প্রবাহ কমে ২০০ কিউবিক ফিট প্রতি সেকেন্ড হয়ে যায়। তবে মানুষের উন্নতিও দরকার। এই ড্যাম এই এলাকার মানুষের জন্য একটি আশীর্বাদ স্বরূপ। পানীয় জল, বিদ্যুৎ, চাষের জল সহ অনেক সুবিধা এই ড্যাম থেকে পওয়া যায়। উত্তরাখন্ড সরকার প্রতি বছর তেহেরী লেক উতসব আয়োজন করে যাতে এই এলাকা এজটি গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমন স্থল হয়ে উঠেছে। জলস্তর কমে গেলে এখানে পুরোনো তেহেরি শহরের ডুবে যাওয়া অংশ দেখা যায় যা দেখতে মানুষ ভিড় করে যার মধ্যে ব্রিটিশ আমলে তৈরি একটি ক্লক টাওয়ার রয়েছে। এই ড্যাম ইতিমধ্যে ৬.৫ ম্যাগনিটিউডের একটি ভূমিকম্প সামলে নিয়েছে তাও কিছু হয়নি।