লাদেনকে মারতে কি অপারেশান করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র?
রাজেশ রায় : পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক জঙ্গী ওসামা বিন লাদেন কে খুঁজে বের করে হত্যা করা এতটা সহজ ছিলনা। যাকে অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার বলা হয়। আমেরিকান নৌসেনার স্পেশাল ফোর্স নেভি সীলের চিহ্ন এই নেপচুন স্পিয়ার এটা দেখতে ত্রিশূলের মতন। দশ বছর ধরে ওসামা বিন লাদেন কে খুঁজে অবশেষে পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা লাদেন কে আমেরিকার নেভি সীল কম্যান্ডোরা গিয়ে মেরে আসে, এই পুরো ঘটনার কোড নেম এই নেপচুন স্পিয়ার।
ওসামা বিন লাদেনের ব্যাপারে বলতে গেলে প্রথমেই আসতে হবে আফগানিস্তানের কথায়। আজ গোটা আফগানিস্তান জুড়ে তালিবানের শাসন। আফগানিস্তান পুরো ধ্বংস বলতে গেলে। আফগানিস্তানের এমন পরিস্থিতি ও তালিবানের উত্থানের জন্য চারটি দেশ দায়ী। প্রথম হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, দ্বিতীয় হচ্ছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, তৃতীয় হচ্ছে আফগানিস্তান নিজে ও চতুর্থ হচ্ছে পাকিস্তান। পাকিস্তানই হচ্ছে প্রধান কালপ্রিট। পাকিস্তানই এই তালিবানদের অস্ত্র সরবরাহ করত, অর্থ সাহায্য করত, মেডিক্যাল সহায়তা করত।
ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৯৭৯ সালের দিকে, রাতারাতি আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসে, কমিউনিস্ট সরকার কে হাঠানো হয় নেপথ্যে ছিল আমেরিকা, আমেরিকা তালিবান তৈরি করে নিজেদের স্বার্থে। তালিব শব্দের অর্থ ছাত্র, আমেরিকা সেখানকার ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। এরপরই সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৭৯-৮৯ পর্যন্ত টানা দশবছর সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯৩ এ ভেঙে যায়। এরপর আফগানিস্তানে জন্ম হয় আরও দুটি জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা ও মুজাহিদ্দন। ওসামা বিন লাদেন এই আল কায়েদার নেতা ছিলেন। ১৯৫৭ সালে সৌদি আরবের রিয়াদে জন্ম হয় ওসামা বিন লাদেনের, অত্যন্ত ধনী পরিবারের ছেলে ওসামা তালিবানের পক্ষে যোগ দেয়। ১৯৮৮ সালে লাদেন তালিবান থেকে আলাদা হয়ে আলকায়েদা নামক সংগঠন তৈরি করে। এই ওসামা বিন লাদেন কে এক প্রকার আমেরিকাই তৈরি করেছিল। কিন্তু বলে না সাপুড়ের মৃত্যু সাপের হাতেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন কে হারানোর পর তালিবান আমেরিকা কে অগ্রাহ্য করতে শুরু করে। আলকায়েদা সরাসরি আমেরিকার বিরোধীতা করতে শুরু করে। সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা ঘটে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। এই দিন আল কায়েদার কিছু সদস্য একটি বিমান হাইজ্যাক করে সোজা আমেরিকার টুইন টাওয়ারে আক্রমণ করে পুরো ধ্বংস করে দেয়। প্রায় ৩০০০ লোকের মিত্যু হয় এতে। এরপরই তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জর্জ ডাব্লু বুশ অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম শুরু করে, যার উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানে আল-কায়দা ও তালিবানের উপর বোম্বিং করা।
এরপরই শুরু হয় লাদেনকে খোজার কাজ কারন টুইনটাওয়ার ধ্বংসের পরিকল্পনা লাদেনেরই ছিল। আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ জানায় লাদেন আফগানিস্তানের তোরাবোরা এলাকার পাহড়ে লুকিয়ে আছে। কিন্তু আফগানিস্তানে গিয়ে যুদ্ধ করা এতটা সোজা ছিলা না কারন আফগানিস্তানে ভূ প্রকৃতি, এত উঁচু পাহাড় চারদিকে। তাছাড়া আল-কায়দা কে সাহায্য করত পাকিস্তান। ওসামা বিন লাদেন কে খোঁজার কাজ শুরু হয়। লাদেন সরাসরি ইন্টারনেটের সাহায্যে কোন মেসেজ দিত না কারন সিগন্যাল ট্রাক হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। লদেন কুরিয়ারের মাধ্যমে মেসেজ পাঠাত, একজন লোক গিয়ে মেসেজ নিয়ে আসত। সিআইএ অনেক খুঁজে ২০০২ সালে লাদেনের একজন কুরিয়ার বাহকের নাম জানতে পারে, যার নাম ছিল আবু আহমেদ আল কুয়েতি। শুধু নামটাই জানা গেছিল, আসল ব্যক্তির কোন তথ্য আমেরিকা বহুবছর চেষ্টা করেও পায় নি। অনেক মানুষকে জিজ্ঞাসা করেও, গ্রেফতার করেও আবু আল কুয়েতির কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি। এরপর জানা যায় আবু আল কুয়েতি নাকী মারা গেছে ২০০১ সালে! এক ঝটকায় সিআইএ এর এত বছরের পুরো পরিশ্রম মাটিতে মিশে যায়। আবার প্রথম থেকে শুরু হয় অনুসন্ধান। জানা যায় আবু আল কুয়েতি মরে নি, এটা অন্য ব্যক্তি। অনেক পরে পাকিস্তান সরকার জানায় আবু আল কুয়েতির আসল নাম ইব্রাহিম সাইদ, যাইহোক এটা পরের ব্যাপার।
অনেক চেষ্টার পর এটা জানা যায় ওসামা বিন লাদেন হয়ত পাকিস্তানে আছে। দেখুন লাদেন এত বছর ধরে গোটা দুনিয়া কে বোকা বানিয়ে রেখেছিল, সবাই জানত
লাদেন আছে আফগানিস্তানে কিন্তু লাদেন ছিল পাকিস্তানে। সমস্ত অনুসন্ধানের পর আমেরিকার সিআইএ লাদেন হয়ত পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে আছে, তবে এই ব্যাপারে তারা নিশ্চিত না, লাদেনের পাকিস্তানে থাকার সম্ভবনা ৭০ শতাংশ। এইসময় একজন পাকিস্তান আমেরিকান সরকারকে জানায় ২৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে সে লাদেনের খবর দিতে পারবে।
সিআইএ সমস্ত স্যাটেলাইট ইমেজ ও অনুসন্ধান করে অ্যাবটাবাদের একটি বাড়ির উপর সন্দেহ করে। আশেপাশের ফাকা জায়গার মাঝে পুরো কেল্লার মত বিশাল একটি বাড়ি। সবচেয়ে অদ্ভুদ ব্যাপার বাড়ি থেকে কেও বেরোয় ও না তেমন, কেউ ঢোকেও না। শুধু কিছু মহিলা বোরখা পড়ে বেরোয় মাঝেমধ্যে। সিআইএ বাড়িটির আশেপাশে ঘর ভাড়া নেয়, সেখানে তাদের এজেন্টরা ২৪ ঘন্টা নজরদারি করতে থাকে। এছাড়াও ওই এলাকায় সিআই এর বহু এজেন্ট বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়। সিআইএ নকল ভ্যাকসিনেশন পোগ্রাম ও করে। এত দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর সিআইএ ৮০%-৯০% নিশ্চিত হয় ওসামা বিন লাদেন হয়ত এই বাড়িতেই লুকিয়ে আছে। কিন্তু তারা নিশ্চিত ছিল না লাদেনই আছে কীনা তবে তারা এতটুকু নিশ্চিত ছিল যে বাড়িতে কোন বড় টার্গেট আছে।
আমেরিকার সমস্ত মিলিটারি ডিপার্টমেন্ট, সিআইএ সহ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার মধ্যে একটি বড় মিটিং হয়, অ্যাবটাবাদে অপারেশনের জন্য৷ কোন একটি দেশে তো হঠাৎই আক্রমন করা যায় না, কারন সে সেময়ে পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার মোটামুটি ভাল সম্পর্ক ছিল। তাছাড়া অ্যাবটাবাদ পাকিস্তানি মিলিটারি এলাকা। সেক্ষেত্রে বাড়িতে লাদেন না থাকলে ঝামেলা হতে পারে। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে, আন্তর্জাতিক স্তরে আমেরিকার বদনামও হত। অনেক ব্যপারে আলোচনা হয়।
অ্যাবটাবাদের অবস্থান আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে ছিল। অ্যাবটাবাদ থেকে পাকিস্তানের মিলিটারি অ্যাকডেমি ছিল ১.৫ কিলোমিটার দূরে। এবার আফগানিস্তানে সেসময় আমেরিকার সেনাবাহিনী মজুত ছিল। আফগানিস্তানের বাগ্রান এয়ারবেস থেকে অ্যাবটাবাদ কাছেই ছিল। আমেরিকার পরিকল্পনা ছিল বাগ্রাম এয়ারবেস থেকে জালালাবাদ শহর হয়ে তারা অ্যাবটাবাদে অভিযান চলাবে। এই পুরো অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিশ্বের সেরা স্পেশাল অপারেশন স্পেশালিষ্ট আমেরিকার নেভি সীলস এর উপর। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাও এই অপারেশনের জন্য সবুজ সংকেত দিয়ে দেয়। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার। এই মিশনের জন্য ব্যবহার করা হয় আমেরিকার স্পেশাল অপারেশনাল ব্ল্যাকহক স্টেলথ হেলিকপ্টার। ১ মে, ২০১১ এর রাতে বাগ্রাম এয়ারবেস থেকে আমেরিকার ৫ টি ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার ও ৭৯ জন নেভিসিলস ক্যামন্ডো অভিযান শুরু করে। জালালাবাদ হয়ে ৯০ মিনিটে অ্যাবটাবাদে প্রবেশ করে নেভিসীলস রাতের অন্ধকারে। একটা কথা বলে রাখা ভাল যে ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার পাকিস্তানে প্রবেশ করার আগে আমেরিকান নৌবাহিনীর EA-18 G গ্রোলিয়ার বিমান পাকিস্তানের সমস্ত রেডার জ্যাম করে দেয় যাতে পাকিস্তান বুঝতেই পারে নি তাদের আকাশে আমেরিকান হেলিকপ্টার প্রবেশ করেছে। এরপরে মাত্র ৪০ মিনিটে নেভিসীলস অভিযান শেষ করে। ওসামা বিন লাদেন কে মাথায় গুলি মেরে হত্যা করে নেভি সীলস আফগানিস্তানে ফিরে আসে। এই অভিযান চলাকালীন লাদেন ছাড়াও ওই বাড়িতে ৪ জন পুরুষ, ৫ জন মহিলা ও ১৩ জন বাচ্চাকে পাওয়া যায়, এছাড়াও প্রচুর গোপন নথিপত্র পাওয়া যায়।
হলিউডের জিরো ডার্ক থার্টি বলে একটা সিনেমা আছে। ওখানে এই ঘটনা পুরো বিস্তারিতরিত ভাবে দেখানো হয়েছে।