ভারত

কাশ্মীরের অশান্ত পরিবেশের জন্য কেন নেহেরুকে দোষ দেওয়া হয়?

সুমিতঃ আজ থেকে চুয়াত্তর বছর আগে, ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের ঠিক কয়েকদিন পরেই, অক্টোবর মাসে নয়াদিল্লি, করাচি এবং জম্মু- কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে এক ব্যাপক কূটনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা দেখা যায়। 

সেই সময় ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েরই ইচ্ছা ছিল জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজ নিজ দেশের অন্তর্ভুক্ত করা কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের হিন্দু শাসক মহারাজা হরি সিং কোনো পক্ষের আবেদনই সাড়া দিতে ছিলেন নারাজ। ওই একই সময়ে আবার পুঞ্চ এবং শ্রীনগরে শুরু হয়েছিল মহারাজা বিরোধী বিক্ষোভ।

স্ট্যান্ডস্টিল এগ্রিমেন্ট

১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইন উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশদের বিদায়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার সাথে সাথে দেশভাগকেও করেছিলো নিশ্চিত। ক্ষমতা হস্তান্তরের এই গোটা প্রক্রিয়াটি যথাসম্ভব সহজ করার জন্য, ভারতে ক্ষমতাসীন ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ৩ জুন একটি এগ্রিমেন্ট তৈরি করে যাতে ” দেশভাগের পর দুই দেশে নতুন ব্যবস্থাপনা তৈরি হওয়ার আগে ব্রিটিশ শাসনাধীন উপমহাদেশে রাজ্য ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেমন ছিলো তা অপরিবর্তিত থাকবে।”

ভৌগোলিকভাবে, জম্মু ও কাশ্মীর আদপে ভারতের তুলনায় পশ্চিম পাঞ্জাব এবং ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের নিকটবর্তী ছিলো। ওই অঞ্চলের সাথে কাশ্মীর বেশ কয়েকটি অস্থায়ী যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত ছিল। যেমন মূল ভূখণ্ড থেকে ট্রেনে করে জম্মু যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিলো শিয়ালকোট হয়ে। এছাড়া এই শিয়ালকোট-জম্মু সড়ক এবং শ্রীনগর-মুজাফফরাবাদের ঝিলম ভ্যালি সড়ক দিয়েই মূলত পেট্রোল, কেরোসিন, ময়দা, চিনি ইত্যাদির ব্যবসা বাণিজ্য চলতো। 

১৯৪৭ সালের ১২ই আগস্ট জম্মু-কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সাথেই একটি স্ট্যান্ডস্টিল চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে চেয়েছিল। জানানো হয়েছিলো “জম্মু ও কাশ্মীর সরকার বিদায়ী ব্রিটিশ সরকারের সাথে ভারত এবং পাকিস্তানের যাবতীয় চুক্তি এবং ব্যবস্থাপনাকে নীরদ্বিধায় স্বাগত জানাতে রাজি”

পাকিস্তান প্রস্তাবটি গ্রহণ করে এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী জনক সিংহের কাছে একটি যোগাযোগ বার্তা পাঠায়। ভারত অপরদিকে এভাবে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে,পরিবর্তে মহারাজাকে আলাদা করে আরও আলোচনার জন্য দিল্লিতে তার প্রতিনিধি পাঠাতে বলে। বার্তা পাঠানো হয় “কাশ্মীর এবং ভারতের মধ্যে স্ট্যান্ডস্টিল চুক্তি সম্পন্ন করার আগে উক্ত বিষয়ে একান্ত আলোচনার জন্য আপনি বা আপনার অনুদৃত কোন মন্ত্রী যদি দিল্লিতে আসতে পারেন তবে ভারত সরকার একান্তই বধিত হবে। বর্তমান চুক্তি এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য প্রারম্ভিক এক পদক্ষেপ বাঞ্ছনীয়”। কিন্তু আলোচনার জন্য জম্মু কাশ্মীরের কোনো প্রতিনিধিই দিল্লি সফরে আসেননি।

ডোগরা ও শেখ আবদুল্লাহ

১৮৬৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং রাজকীয় ডোগরা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা গুলাব সিং-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে ব্রিটিশ সর্বোত্তমত্বের অধীনে আনা হয়েছিল। তিনি ৭.৫ মিলিয়ন নানকশাহী রুপি প্রদান করে কাশ্মীর উপত্যকা,বাল্টিস্তান, কার্গিল এবং লেহ সমন্বিত লাদাখ উইজারাত ক্রয় করে নিজের শাসনাধীন জম্মুতে যোগ করেন। পরবর্তীকালে ডোগরার যুদ্ধে শিখদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি গিলগিট এবং পামিরি এলাকা সহ সমগ্র গিলগিট উইজারাত নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। 

ডোগরাদের বিরুদ্ধে একাধিক বিদ্রোহ সংঘঠিত হয়েছিল সেই সময়;বিশেষত ১৮৬৫,১৯২৪ এবং ১৯৩১ সালে। কিন্তু ১৯৩১ সালের পরে, সেখানে রিডিং রুম পার্টি নামক এক ছোটো বামপন্থী মুসলিম বুদ্ধিজীবী দলের নেতৃত্বে সরকার বিরোধী আন্দোলন আলাদা মাত্রা পায়। শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর মুসলিম সম্মেলন অর্থাৎ পরবর্তীকালের নেশনাল কনফারেন্সের অগ্রদূত ছিলো এটাই। অ্যালিস্টার ল্যাম্বের মতে এটিই ছিলো ১৯৪৭ সালের “বার্থ অফ এ ট্র্যাজেডি” এর প্রেক্ষাপট। উন্নত শাসন ব্যবস্থার জন্য আবদুল্লাহর ক্রমাগত আন্দোলন এবং তার গণআবেদন তৎকালীন মহারাজার কাছে  এক সহজ লক্ষ্যবস্তু করে তোলে তাকে। ফলে, ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে বারংবার গ্রেপ্তার করা হয় তাকে।

কাশ্মীর যোগদানে সমস্যা

ভারত থেকে ব্রিটিশদের প্রস্থান জম্মু ও কাশ্মীরে মূলত দুটি বড় প্রভাব ফেলেছিল।

এক, মহারাজা তার গ্যারান্টার, ব্রিটিশদের হারিয়েছিলেন, যারা ১৯৩১ সালের মতো তার বিরুদ্ধে হওয়া কোনো রকম বিদ্রোহ বা আগ্রাসন দমনের মাধ্যমে তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেনি।

দুই, বহিরাগত কোনো রকম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাজা হরি সিং কাশ্মীর সীমান্তে নিশ্চিদ্র নজরদারি চালিয়ে যেতে পারেননি।

১৫ আগস্টের পর মহারাজার অবস্থানকে উইলিয়াম নরম্যান ব্রাউন তার ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান বইয়ে “অনিশ্চিত” বলে উল্লেখ করেছেন। ব্রাউন লিখেছেন “ভারতের গণতন্ত্রীকরণ চলায় ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া তার একেবারেই অপছন্দ ছিলো আবার পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ায় সেখানে যোগদান দেওয়ারও মোটেই ইচ্ছা ছিল না তার… তিনি নিজ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার কথা ভেবেছিলেন।”

এদিকে মহারাজের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল চারিদিকে। শেখ আবদুল্লাহকে বন্দী করা হয় কারাগারে। জওহরলাল নেহেরু, বল্লভভাই প্যাটেল এমনকি ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও তাকে কারাগার থেকে মুক্তি না দেওয়া হলে জনগণের মনে প্রতিষ্ঠান বিরোধী রোষ বাড়তে থাকে ক্রমশ। সব মিলিয়ে ক্রমশ মহারাজার ওপর চাপ বাড়তে থাকে। 

অপরদিকে, ভারতের সাথে জম্মু- কাশ্মীরের স্ট্যান্ডস্টিল চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা সেভাবে না এগোনোয় পাকিস্তান ভেবে নেই কাশ্মীর শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার একান্ত সচিব খুরশীদ হাসান খুরশিদকে শ্রীনগরে পাঠান মহারাজাকে পাকিস্তানে যোগদানের একটি দলিল স্বাক্ষরের বিষয়ে আশ্বস্ত করতে। খুরশিদের হাত দিয়ে মহারাজকে পাঠানো জিন্নাহর লেখা চিঠিতে বলা হয়েছিল যে মহামান্য একজন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নেতা যার একাই ইচ্ছা মত রাষ্ট্রে যোগদান করার ক্ষমতা রয়েছে;  তার কারো সাথে পরামর্শ করার দরকার নেই; তিনি যেনো শেখ আবদুল্লাহ বা ন্যাশনাল কনফারেন্সে নিয়ে বেশি চিন্তা না করেন।

কিন্তু, কোনো রকম প্রত্যুত্তর না পেয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের সাথে স্ট্যান্ডস্টিল চুক্তি স্বাক্ষরের ১২ দিনের মধ্যেই অর্থাৎ, ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ফের মহারাজার উদ্দেশ্যে একটি সতর্কতা লিখে পাঠায়: “কাশ্মীরের মহারাজা হিসাবে যেকোনো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসে গেছে। আপনার সামনে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগদানের পথ খোলা আছে। যদি যোগদানে ব্যর্থ হন তবে, অনিবার্য ভাবেই জম্মু কাশ্মীরে কিছু সম্ভাব্য সমস্যা তৈরি হবে।”এই সতর্কতা মহারাজাকে বেশ শঙ্কিত করে তোলে, এবং পাকিস্তান ও জম্মু- কাশ্মীরের মধ্যে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ বিনিময় হতে থাকে। অন্যদিকে জওহরলাল নেহেরু এবং মহাত্মা গান্ধী প্রথম থেকেই চাইছিলেন কাশ্মীর ভারতে যোগদান করুক। নেহরুর এমনিতেই কাশ্মীরে শিকড় রয়েছে এছাড়া শেখ আবদুল্লাহর সাথে বন্ধুত্ব তাকে আরো কাশ্মীরের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো। কিন্তু, ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সেই সময় হায়দ্রাবাদের বেশ কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। নিজাম পাকিস্তানে যোগ দিতে চাইছিলেন তাই সরকারের মূল মনোযোগ তখন ছিলো সেখানেই। ইতিহাসবিদ রাজমোহন গান্ধীর মতে ১৯৪৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বল্লভভাই প্যাটেল ভারতের প্রথম প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলদেব সিংকে পাঠানো একটি চিঠিতে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ‘ কাশ্মীর যদি অন্য ডোমিনিয়নে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সেই সত্যকেই নির্দ্বিধায় মেনে নেবেন তিনি।’

উপজাতীর আক্রমণ

ভিক্টোরিয়া স্কোফিল্ডের ‘কাশ্মীর ইন কনফ্লিক্ট: ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড দ্য আনএন্ডিং ওয়ার’ বই অনুসারে জানা যায় -১৯৪৭ সালের জুন মাসে, প্রায় ৬০,০০০ জন প্রাক্তন সেনা সদস্য (বেশিরভাগই পুঞ্চের) মহারাজার বিরুদ্ধে এক নো-ট্যাক্স অভিযান শুরু করে। পরে ১৪ এবং ১৫ আগস্টে এটিই ক্রমে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে পরিণত হয়। পুঞ্চের মুসলমানরা পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করতে আরম্ভ করলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মহারাজা পুঞ্চে সামরিক আইন জারি করলে সেখানকার মুসলমানদের ক্রোধ আরো খানিকটা বেড়ে যায়। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানের NWFP উপজাতির গোলাবারুদ রপ্তানি এবং ব্যক্তিগত সহায়তায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠে।

১৯৪৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল হেনরি লরেন্স স্কট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক গোপন অনুপ্রবেশের অভিযোগ তুলে মহারাজারকে সরাসরি পাকিস্তানের সাথে আলোচনায় বসে সমস্যাটি উত্থাপন করতে পরামর্শ দেন। ওই একই দিনে, জম্মু ও কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী জনক সিং আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে “তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ” দাবি করেছিলেন।

কিন্তু, পাকিস্তানও অপরদিকে জম্মু- কাশ্মীর প্রশাসনের বিরুদ্ধে এই একই ধরনের অভিযোগ তুলে দাবি জানায়, জম্মু থেকে হিন্দুরা শিয়ালকোটে অনুপ্রবেশ করছে।

ক্লান্ত হয়ে মহারাজা হরি সিং শেষ পর্যন্ত শেখ আবদুল্লাহকে মুক্তি দেন। তিনি তার প্রথম জনসভার শুরুতেই পরিষ্কার ভাবে জানান “কাশ্মীরিদের দাবি স্বাধীনতা”।  সঙ্গে জিন্নাহকে কটাক্ষ করে তিনি বলেছিলেন: “ মিঃ জিন্নাহ বা মুসলিম লীগ কিভাবে আমাদের পাকিস্তানে যোগ দিতে বলতে পারে? প্রতিটি সংগ্রামে তারা আমাদের বিরোধিতা করেছে। আমাদের বর্তমান ‘কাশ্মীর ছাড়ো’ সংগ্রামের বিরুদ্ধেও জিন্নাহ অপপ্রচার চালিয়ে বরংবার বলেছেন যে এই রাজ্যে কোনো ধরনের সংগ্রাম নেই। এমনকি আমাদের গুন্ডা বলে অভিহিত করতে পর্যন্ত ছাড়েননি তিনি।” 

অক্টোবরের গোড়ার দিকে, মহারাজা ফের জম্মু সীমান্ত প্রদেশের কয়েকশ কিলোমিটার ভিতরে পাকিস্তানী উপজাতিদের অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগ জানান।  পাকিস্তান সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে তার বদলে পুঞ্চের মুসলিম জনসংখ্যার ওপর জম্মু – কাশ্মীর বাহিনী দ্বারা সংঘটিত সন্ত্রাস ও নৃশংসতার প্রতি মহারাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করে পরামর্শ দেন- জম্মু-কাশ্মীরের মধ্যে এবং সীমান্তের ওপারে জাতিগত ও ধর্মীয় অস্থিরতা থেকেই এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে।

ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য টাইমস এবং দ্য স্পেক্টেটরের কয়েকটি প্রতিবেদন ছাড়া এই সময়ে জম্মু ও পুঞ্চের হিংসাত্মক পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না।

জম্মু ও কাশ্মীর আইনসভার সদস্য পুঞ্চের এক তরুণ আইনজীবী, জমি মালিক এবং মহারাজের এক সময়ের আইনী কর্মকর্তা সর্দার ইব্রাহিম খান আশ্চর্যজনক ভাবে আন্দোলনের প্রধান হিসাবে আবির্ভূত হন।  তিনি পুঞ্চের বিভিন্ন উপদলকে একত্রিত করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সহ পাকিস্তানের মুসলিম লীগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। রাওয়ালপিন্ডিতে “আজাদ কাশ্মীর” সরকার প্রতিষ্ঠায় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

কাশ্মীর ও পাকিস্তানের সম্পর্ক যত তলানীতে থাকতে থাকে ততো পাকিস্তানের সন্দেহ বাড়তে থাকে যে মহারাজা হরি সিং ভারতে যোগ দেবেন। সেই সঙ্গে মুসলিম লীগের প্রতি শেখ আবদুল্লাহর বিদ্বেষও বেশ ভাবাচ্ছিল পাকিস্তানকে। সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান বলপ্রয়োগ করে কাশ্মীর দখলের সিদ্ধান্ত নেয় কারণ রাজ্যটির ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে, তাদের আশঙ্কা ছিলো যে কাশ্মীর ভারতের হাতে চলে গেলে, পাকিস্তান নিজেদের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা সঠিকভাবে কার্যকর করতে পারবে না।  ডক্টর সঞ্জয় কুমারের লেখা ‘ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক- অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যত’ নামক একটি একাডেমিক পেপার অনুসারে, পাকিস্তানের ব্রিগেডিয়ার-ইন-চার্জ মেজর জেনারেল আকবর খান বলেছিলেন: “কাশ্মীরের পাকিস্তানে যোগদান সাধারণ এক চাহিদা বা আকাঙ্খার বিষয় নয়, বরং পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটি নিতান্তই এক প্রয়োজনীয়তা।”

অপারেশন গুলমার্গ

১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তান NWFP থেকে উপজাতিদের একত্রিত করে ‘অপারেশন গুলমার্গ’ শুরু করে। প্রায় ২,০০০ উপজাতি, পাকিস্তানি সেনা জেনারেলদের সরাসরি নির্দেশে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দলে দলে মোটর-বাসে এবং পায়ে হেঁটে মুজাফফরাবাদে প্রবেশ করে।

আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত হানাদারদের কাছে মহারাজার বাহিনীর হাতে থাকা ন্যূনতম প্রতিরোধ তাসের ঘরের মতোই ভেঙ্গে পড়ে। পাকিস্তান উরি এবং বারামুল্লা দখল করে নিলে শ্রীনগরের পতন ছিলো আসন্ন। এমন পরিস্থিতিতে আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে ২৪ অক্টোবর, মহারাজা হরি সিং পাকিস্তানী আগ্রাসন রোধ করতে সামরিক সহায়তার জন্য ভারতের কাছে আবেদন জানান।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে.কে. নন্দার বই ওয়ার উইথ নো গেইন্স থেকে জানা যায় ২৫ অক্টোবর মাউন্টব্যাটেনের নেতৃত্বে ভারতের প্রতিরক্ষা কমিটির বৈঠকে নেহেরু, প্যাটেল, বলদেব সিং, মন্ত্রী গোপালস্বামী আয়ঙ্গার এবং সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনীর ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফের উপস্থিতিতে কাশ্মীরের অনুরোধটি বিবেচনা করা হয়। বৈঠকের শেষে কমিটি ঠিক করে যে শ্রীনগরের স্থানীয় জনগণকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে যথাসম্ভব প্রতিরক্ষা দিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাশ্মীর সরকারের অনুরোধ মাফিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ কাশ্মীরে পাঠানো দরকার।

তবে, জ্যোতি ভূষণ দাস গুপ্তের বই জম্মু ও কাশ্মীর অনুসারে, মাউন্টব্যাটেন সেই সময় সতর্ক করেছিলেন এই বলে যে “কাশ্মীর প্রথমে যোগদানের প্রস্তাব না দিলে ভারত থেকে কোনো রকম সৈন্য পাঠানো বিপজ্জনক হবে”। তার  যুক্তি ছিলো তা না হলে এর ফলে শুরু হবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে যোগদানকে অস্থায়ী হিসাবে বিবেচনা করা উচিত এবং কাশ্মীরে যখন আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন কাশ্মীরের ভবিষ্যত কি হওয়া উচিত সে বিষয়ে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়াই হবে শ্রেয়।

প্রতিরক্ষা কমিটির রাজ্য মন্ত্রকের সচিব ভি.পি. মেননকে ওই একই দিনে শ্রীনগরে “অন-দ্য-স্পট স্টাডি” করতে পাঠানো হয়।  তিনি অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পরের দিন নয়াদিল্লিতে ফিরে আসেন এবং কাশ্মীরে সেনা পাঠানোর পরামর্শ দেন। হানাদারদের হাত থেকে কাশ্মীরকে বাঁচাতে ভারতের সাহায্য সর্বোচ্চ প্রয়োজনীয় বলেই বিবরণ দেন তিনি।

ইতিমধ্যে, জম্মু ও কাশ্মীরের নতুন প্রধানমন্ত্রী, মেহর চাঁদ মহাজন, সতর্কবার্তা পাঠান যে  “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ২৫ তারিখ সন্ধের মধ্যে বিমান পেলে আমরা ভারতে যাব, অন্যথায় পাকিস্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করব।” মেননকে এই সময় পুনরায় জম্মুতে নিয়ে যাওয়া হয় মহারাজাকে ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবগত করার জন্য এবং মহারাজা অবশেষে ২৬ অক্টোবর ভারতীয় নেতাদের সাথে একত্রিত হয়ে ভারতে যোগদানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে মেনন মহাজনের সাথে দিল্লিতে ফিরে আসেন।

যোগদানের চুক্তি

প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ এবং বৈদেশিক বিষয়ে জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতের সীমিত প্রবেশাধিকারের অনুমতি দেয় যোগদানের এই চুক্তি।

চুক্তির ক্লজ ৪-এ, কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসাবে যোগদানের কথা ঘোষণা করেন।

ক্লজ ৫ এ যোগদানের যাবতীয় শর্তাবলী ঘোষণা করে বলা হয় কোনো আইনসভার সম্মতি ছাড়া এই সম্পর্কিত কোনো শর্ত বা আইন সংশোধন বা পরিবর্তন করা যাবে না। 

অনুচ্ছেদ ৬ এ ঘোষণা করা হয়েছিলো ভারতীয় ইউনিয়ন রাজ্যে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের কোনো ক্ষমতা রাখে না, এবং বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল যে আইনানুসারে দাবি করা না হলে ইউনিয়ন জম্মু ও কাশ্মীরে জমি ক্রয় করতে পারবে না।

অনুচ্ছেদ ৭ এ বলা হয়েছিলো মহারাজাকে ভবিষ্যতে ভারতীয় সংবিধান গ্রহণ করতে হবে না এবং ভারত সরকার জোর করে মহারাজাকে তা করতে বাধ্যও করতে পারে না।

অনুচ্ছেদ ৮ এ স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছিল “এই চুক্তি কোনো মতেই মহারাজার সার্বভৌমত্বকে প্রভাবিত করবে না”। অপরদিকে অনুচ্ছেদ নম্বর ৯এ স্পষ্ট যে তিনি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের হয়েই সেই নথিতে স্বাক্ষর করছেন৷  সুতরাং, এবার থেকে ভারত সরকার মহারাজাকে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের আইনী প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকার করছে।

চুক্তির পরবর্তী স্থিতি

উপজাতীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অবশেষে শ্রীনগরে পাঠানো হয়েছিল। শেখ আবদুল্লাহ কর্তৃক তৈরি মিলিশিয়ারাও সেই সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারা প্রশিক্ষিত হয়েছিল।

১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি নেহেরু আনুষ্ঠানিকভাবে জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুটিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যান।

এই সময় পাকিস্তান দাবি করেছিল যে জম্মু- কাশ্মীরের যুদ্ধ আদপে সংঘটিত হচ্ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং “আজাদ কাশ্মীরের সৈন্যদের” মধ্যে। অথচ ওই বছরের মে নাগাদ, ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করে যেই ক্রমশ পুঞ্চ ও পশ্চিম পাঞ্জাব সীমান্তের দিকে এগোতে আরম্ভ করে ওমনি পাকিস্তান প্রকাশ্যে “আজাদ কাশ্মীর আর্মি” কে সাহায্য করার জন্য সৈন্যদের একত্রিত করতে আরম্ভ করে।

১৯৪৮ সালের ১৩ আগস্ট, ভারত ও পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের কমিশন পাকিস্তানি সৈন্য ও উপজাতীয় মিলিশিয়া প্রত্যাহার, এরপর ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার;  এবং একটি গণভোটের মাধ্যমে একটি যুদ্ধ বিরতি চুক্তির ঘোষণা করে।

যাইহোক, যুদ্ধবিরতি অনুসরণ করে, কোন পক্ষই তাদের সৈন্যবাহিনীকে প্রত্যাহার করেনি এবং গণভোটও শেষ পর্যন্ত কখনোই হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.