দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এশিয়া এবং ইউরোপে। এমন কথা কেন বলা হচ্ছে?
বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘাতক যুদ্ধ বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে। এর থেকে নৃশংস যুদ্ধ কখনও হয় নি। বিশ্বের প্রায় ৭০ দেশ এতে অংশ নিয়েছিল। প্রায় ৫ থেকে ৬ কোটি মানুষ এতে মারা গেছিল যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি সাধারণ মানুষ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল হিটলারের পাগলামোর জন্য যার খেসারত দিতে হয়েছিল জার্মানিকে। জার্মানি দীর্ঘদিন এর জন্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে ছিল। ১৯৮৯ সালে জার্মান ওয়াল ভেঙে যাবার পর জার্মানি স্বাধীনতা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের বড় বড় অংশ ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা সহ প্রশান্ত মহাসাগরে হয়েছিল। আসুন যানা যাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেন হয়েছিল? এশিয়া ও ইউরোপে তখন কেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল?
১) সাম্রাজ্যবাদ:— আঠারো শতক থেকেই গোটা বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাম্রাজ্য ছিল। এইসব দেশকে শোষন করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করত ব্রিটেন ও ফ্রান্স। এসব থেকে ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশের সাম্রাজ্য তৈরির লোভ জাগে। ১৯৩৯ সালের আগে জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় সাম্রাজ্য তৈরির।
২) ভারসাইলের চুক্তি:– প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারন লুকিয়ে ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর, এই বিশ্ব যুদ্ধের সম্পূর্ণ দায়ভার জার্মানির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ১৯২০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ৯০ বছর ধরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হওয়া আর্থিক লোকসান, যা প্রায় ২৬৯ বিলিয়ন ডলার, জার্মানিকে শোধ করতে বাধ্য করা হয়। ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা জার্মানিকে ব্যাপক অপমান করে। ভারসাইলের চুক্তি অনুযায়ী জার্মানির উপর অনেক অন্যায় শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয় বলে মনে করেন একাধিক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। যেমন জার্মানি ১ লাখের বেশী সেনা রাখতে পারবে না, এছাড়াও জার্মানির একটি বড় অংশ ছিনিয়ে নিয়ে ফ্রান্স, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, লিথিওনিয়াকে দিয়ে দেওয়া হয়। যার জন্য জার্মানির মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। অ্যাডলফ হিটলার এরই সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় এসেই এই চুক্তি বাতিল করে দেয়।
৩) বিতর্কিত সীমানা:– প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একই ভাষার এবং একই জাতির লোকেদের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। যেমন কিছু জার্মান লোক চেকস্লোভিয়া, কিছু পোল্যান্ড, কিছু ডেনমার্কের অংশ হয়ে যায় এই ঘটনায় ধীরে ধীরে জার্মানির মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
৪) স্বৈরাচারী শাসন:– প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ জুড়ে স্বৈরাচারী শাসকদের উদ্ভব হয়। জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার ও ইটালিতে বেনিটো মুসোলিনি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ইটালি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করেছিল কিন্তু প্যারিস শান্তি সম্মেলনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিতে যাওয়া দেশ গুলো যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স অনেক ভূখন্ড দখল করে কিন্তু ইটালি তেমন কিছুই পায়নি। যার জন্য ইটালি ক্ষুব্ধ ছিল। ইটালি ও জার্মানি এ জন্য লিগ অফ নেশনস ছেড়ে দেয়। জাপানে সেনাবাহিনীর প্রধানের কাছেই সমস্ত ক্ষমতা ছিল এবং জাপানও সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে। ১৯৩৬ সালে স্পেনে হওয়া গৃহযুদ্ধে ফ্রাঙ্কো সমস্ত ক্ষমতা দখল করে। ফ্রাঙ্কো কে সাহায্য করে হিটলার ও মুসোলিনী।
৫) লিগ অফ নেশনসের ব্যার্থতা:– ১৯২০ সালে লিগ অফ নেশনস তৈরি করা হয়েছিল যাতে ভবিষ্যতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতন যুদ্ধ না হয় এবং বিশ্বে শান্তি বজায় থাকে কিন্তু ১৯৩১ সালে জাপান চীনের মান্চুরিয়া দখল করে, ১৯৩৫ সালে ইটালি ইথিওপীয়া দখল করে। ভারসাইলের চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি ও ফ্রান্সের মাঝে রাইনল্যান্ড নানে একটি জায়গা আছে যেখানে জার্মানি সেনা রাখতে পারত না। কিন্তু হিটলার এখানে সেনা পাঠায়। এসব কারনেই লিগ অফ নেশনসের অস্তিত্বে প্রশ্ন এসে যায়।
৬) গ্রুপ তৈরি :– প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতন আবারও ইউরোপ দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। ফ্রান্স জার্মানির চারিদকে দেশ গুলোকে নিয়ে জার্মান বিরোধী জোট গঠন করে, যাতে ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যোগ দেয়। এদিকে জার্মানি, ইটালি ও জাপান জোট গঠন করে।
৭) মিলিটারি পাওয়ার বৃদ্ধি:– প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে সীমিত সেনাবাহিনী ও কম অস্ত্র রাখবার চেষ্টা করা হচ্ছিল কিন্তু জার্মানি ফ্রান্সের আক্রমনের ভয়ে নিজেদের সেনা বাড়াতে থাকে। অন্যদিকে ফ্রান্স ও তাদের সেনা বাড়াতে থাকে। ইটালি নিজেদের সৈন্য বৃদ্ধি করতে থাকে এবং ব্রিটেনের মত গোটা বিশ্বে সাম্রাজ্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে জাপানও ১৯ শতকের শুরুতেই নিজেদের সেনা বাড়াতে থাকে।
৮) দি গ্রেট ডিপ্রেসন :– ১৯২৯-৩৯ অবধি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা বা গ্রেট ডিপ্রেসন দেখা যায়। চারিদিকে বেকার, অনাহারে থাকা লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। হিটলার এর জন্য ভারসাইলের চুক্তি কে দায়ী করে এবং এইসব লোকেদের সেনাতে ভর্তি করা হয়।
১৯৩৮ আসতে আসতে ভারসাইয়ের চুক্তির অনেক শর্ত কমিয়ে আনা হয়েছিল এবং ততদিনে জার্মানি একটি শক্তিশালী দেশ হিসাবে তৈরি হয়ে গেছিল। এইজন্য ইতিহাসবিদদের মতে হিটলারই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার জন্য প্রধান দায়ী। ১৮৮৯ সালে জার্মানির এক গরীব পরিবারে জন্ম হয় হিটলারের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হয়ে অংশ নিয়েছিল হিটলার, সেখানে তার বীরত্ব দেখে জার্মান সরকার তাকে অনেক মেডেল দিয়েছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে যায়, যা অত্যন্ত দুঃখী করেছিল হিটলারকে। এরএর ১৯১৯ সালে জার্মানির ওয়ার্কিং পার্টির সদস্য হয় হিটলার এবং ধীরে ধীরে নেতা হয়ে ওঠে এই দলের। এরপর এই দলের নাম পাল্টে হয় ন্যাশনাল সোশালিস্ট পার্টি। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই দল জার্মানির মানুষের মধ্যে তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু এই সময় বিশ্বজুড়ে হওয়া গ্রেট ডিপ্রেশন জার্মানিতে ব্যাপাক প্রভাব ফেলে। জার্মানির ব্যাঙ্কগুলো দেওলিয়া হয়ে যায় এবং লোক বেকার হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় হিটলার একের পর এক ভাষনে জার্মানির মানুষের মনে প্রভাব ফেলতে থাকে। যার ফলে ১৯৩৩ সালে জার্মানির সাধারণ নির্বাচনে হিটলারের দল ৩৭ শতাংশ ভোট পায় এবং জার্মানির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হিডেনবারগ হিটলারকে জার্মানির চ্যান্সেলর নিয়োগ করেন। সমস্ত মন্ত্রীমন্ডলের মধ্যে সবচেয়ে সেরা পদ হচ্ছে চ্যান্সেলর। কিন্তু হিটলার এটুকুতেই সন্তুষ্ট ছিলনা। ক্ষমতায় এসে হিটলার তার দলের বিরুদ্ধে যাওয়া লোকেদের হয় জেলে ভরে দেয় নাহলে মেরে ফেলে অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতন কেউ ছিলনা।
১৯৩৩ সালের ৩ মার্চ জার্মানিতে “অ্যানাবেলিং অ্যাক্ট” পাশ হয়। এই অনুযায়ী জার্মানিতে হিটালারের নাজি দল ছাড়া বাকী সব দলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। জার্মানির অর্থনীতি, সেনা, ব্যাঙ্ক, মিডিয়া সবের উপর নাজি দলের অধিকার এসে যায়। হিটলার সেসময় জার্মান সমাজকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে। যেমন নীল চোখের অধিকারী নর্ডিক আর্য জার্মানদের সমাজের উপরের তলায় স্থান দেওয়া হয়েছিল এবং সবচেয়ে নীচের তলায় ছিল ইহুদিরা। সেসময় রং, রূপ, জাতি অনুযায়ী ইউরোপে প্রায় ৫২ রকমের সমাজ বিভক্ত ছিল। হিটলারের লক্ষ্য ছিল যত বেশী সম্ভব জায়গা দখল করে সেখানে জার্মান বসতি স্থাপন করা। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে জার্মানি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সময় নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন ১৯৩৭ সালে চীন-জাপানের যুদ্ধের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। অন্যদিকে বেশীরভাগ ইতিহাসবিদের ধারনা ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। এশিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত হয়েছিল চীন ও জাপান যুদ্ধের কারনে। জাপান একের পর এক জায়গা দখল করতে থাকে ১৯ শতকের শুরু থেকেই। ১৯১০ সালে জাপান কোরিয়া দখল করে। ১৯৩১ সালে জাপান চীনের মান্চুরিয়া দখল করে সেখানে তাদের সরকার বসায় একে মান্চুকাও বলা হত। ১৯৩৭ সালে চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। চীনের কমিউনিস্ট ও জাতীয়তাবাদ এই দুই দলের মধ্যে লড়াই শুরু হয়। এই সুযোগে জাপান চীনের বেজিং সহ সাংহাই, হংকং দখল করে নেয়। শুরু হয় চীন জাপান যুদ্ধ।
এবার ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিটা জানা যাক। জার্মানি রেইনল্যান্ড দখল করে নেয় যা ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে ছিল। এরপর জার্মানি ও ইটালির মধ্যে ১৯৩৬ সালে একটি চুক্তি হয় যাতে বলা হয় যুদ্ধের সময় উভয় উভয়কে সাহায্য করবে। একে রোম বার্লিন অ্যাক্সিস বলা হয়। এখানে রোম ইটালির রাজধানী ও বার্লিন জার্মানির রাজধানী। অ্যাক্সিস নামের জন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও ইটালির জোটকে অ্যাক্সিস পাওয়ার বলা হয়। একইভাবে জাপানের সাথেও জার্মানির চুক্তি হয় যাকে জার্মানি জাপান প্যাক্ট বলা হয়। এরপর ১৯৩৮ পর্যন্ত দুই বছর জার্মানি চুপচাপ ছিল কিন্ত ১৯৩৮ সালের ১১ মার্চ জার্মানি অস্ট্রিয়া আক্রমণ করে এবং মাত্র ২ দিনে অর্থাৎ ১৩ মার্চ পুরো অস্ট্রিয়া দখল করে নেয়। কারন হিটলারের বক্তব্য ছিল অস্ট্রিয়া কোনওদিন আলাদা দেশ ছিলই না বরং অস্ট্রিয়া জার্মানির অংশ। মার্চ মাসেই হিটলার চেকস্লোভিয়ার সুদেতানল্যান্ডকে দখল করে নেয়। কারন সুদেতানল্যান্ড জার্মানিরই অংশ ছিল যা ভারসাইলের চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৩৮ সালে মিউনিখ শহরে ইটালি, জার্মানি, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মাধ্যমে এক চুক্তি অনুযায়ী পুরো সুদেতানল্যান্ড কে জার্মানির বলে অফিসিয়াল ঘোষনা করা হয় যাকে মিউনিখ প্যাক্ট বলা হয়। সবাই ভেবেছিল জার্মানি বোধ হয় এবার থেমে যাবে কিন্তু হিটলার অন্যরকম ভাবছিল। ১৯৩৯ সালে মার্চে পুরো চেকস্লোভিয়া আক্রমন করে দখল করে নেয় জার্মানি। জার্মানি একের পর এক প্রতিবেশী দেশগুলোকে দখল করে নেওয়ায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির প্রতিবেশী রোমানিয়া ও পোল্যান্ডের সাথে চুক্তি করে সাহায্য করার। এছরই ২৩ আগস্ট জার্মানির বিদেশমন্ত্রী রিব্রেনতোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদেশমন্ত্রী মলোতোভের মধ্যে একটি চুক্তি হয় যাকে মলোতোভ রিবেনত্রোপ প্যাক্ট বলা হয়। চুক্তি অনুযায়ী এই দুই দেশ কখনও উভয়কে আক্রমণ করবেনা বলেই জানানো হয় কিন্তু এই চুক্তিতে একটি গোপন ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল যার খবর কেউ জানত না তা হচ্ছে এই চুক্তি অনুযায়ী দুজনে মিলে আক্রমণ করে পোল্যান্ডকে দুই ভাগে ভাগ করে নেওয়া হবে। ঠিক সাতদিন বাদ ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে দেয়, যা অফিসিয়ালি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। এর ঠিক দুদিন বাদ ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কারন তারা পোল্যান্ডের সাথে চুক্তি করেছিল সাহায্য করার।
১৭ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডের উপর আক্রমন করে। ২০ দিন পর ৬ অক্টোবর পোল্যান্ড হেরে যায় এবং পোল্যান্ডকে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দুভাগ করে নেওয়া হয়। ৩০ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ডকে আক্রমণ করে যাকে উইন্টার ওয়ার বা শীত যুদ্ধ বলা হয়। ১২ মার্চ, ১৯৪০ ফিনল্যান্ড আত্মসমর্পন করে। ইউরোপকে দখল করার জন্য অ্যাডলফ হিটলার একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছিল যাকে ব্লিজক্রিগ আর্মি বলা হত। এটি একটি জার্মান শব্দ যার অর্থ মোবাইল বা ভ্রাম্যমান সেনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হত কী সেনা পায়ে হেঁটে যুদ্ধে যেত ফলে কোন দেশ দখল করতে অনেক সময় লাগত। হিটলারের এই ব্লিজক্রিগ প্ল্যান অনুযায়ী প্রথমে যুদ্ধবিমান গিয়ে বোম্বিং করে সামনে সবকিছু ধ্বংস করে দিত। এরপর পেছনে গাড়িতে করে জার্মান সেনা যেত। এতে একদিনে ২০০-৩০০ কিলোমিটার দখল করা যেত। এইভাবেই ৯ মার্চ জার্মানি ডেনমার্ক আক্রমণ করে এবং মাত্র ১ দিনে দখল করে নেয়। এখান থেকে জার্মানি নরওয়ে আক্রমণ করে এবং ৯ জুন নরওয়ে দখল করে নেয় জার্মানি। এরপর মে মাসে হিটলার একে একে লাক্সেমবারগ, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস দখল করে। একমাত্র সুইডেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল। এরপর ১০ জুন ১৯৪০ এ জার্মানি ও ইটালি দুদিক থেকে ফ্রান্স আক্রমণ করে।
মাত্র ৪ দিনে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস দখল করে জার্মানি এবং ২১ জুন পুরো ফ্রান্স দখল হয়ে যায়। সেসময় ইউরোপের সুপার পাওয়ার ফ্রান্সের পতন ঘটে মাত্র ১১ দিনে যা বিশ্বে হিটলারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কারন অস্ট্রিয়া থেকে শুরু করে মাত্র ১ বছরে জার্মানি ৯ দেশ দখল করে নেয় ফলে সবাই হিটলারকে ভয় খেতে শুরু করে। ইউরোপে তখন হিটলারের একজন শত্রুই বাকী ছিল তা হচ্ছে ব্রিটেন। এবার জার্মানি ব্রিটেন আক্রমণ করে। যাকে ব্যাটেল অফ ব্রিটেন বলা হয়, এটা পৃথিবীর প্রথম কোন যুদ্ধ যেখানে আকাশযুদ্ধ হয়েছিল। দুই দেশের যুদ্ধবিমান দুই দেশে বোম্ব ফেলত। এতে কারও কোনও লাভ হয়নি। তাই কিছু সময় পরে এই যুদ্ধ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নও একের পর এক দেশ দখল করতে থাকে। ফিনল্যান্ড দখলের পর ১৯৪০ সালের ১৪ জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাল্টিক দেশ গুলোর উপর আক্রমণ করে। বাল্টিক দেশগুলোর মধ্যে তিনটি দেশ আসে লাটাভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়া। ৩ আগস্ট এই তিনটি দেশই দখল করে নেওয়া হয়। এদিকে ১৩ সেপ্টেম্বর ইটালি লিবিয়া থেকে মিশর আক্রমণ করে। সেসময় লিবিয়া ইটালির এবং মিশর ব্রিটেনের অধীনে ছিল। কিন্তু মিশরে ব্রিটেন ইটালিকে হারিয়ে দেয়। হিটলার নাজি সেনা পাঠায় লিবিয়ায় এবং আবার মিশর আক্রমণ করে, এবার মিশরে ব্রিটেন পরাস্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার আগেই ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে ইটালি আলবেনিয়া দখল করে নেয় এবং ১৯৪০ সালের অক্টোবরে আলবানিয়া থেকে গ্রীস আক্রমণ করে দখল করে নেয়।
২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪০ জার্মানি, জাপান ও ইটালির মধ্যে ট্রাইপারটাইট চুক্তির মাধ্যমে জোট গঠন হয় অর্থাৎ অ্যাক্সিস পাওয়ারের জন্ম হয়। চুক্তি অনুযায়ী এই দেশগুলো কখনও নিজেদেরকে আক্রমণ করবে না এবং একে অন্যকে সাহায্য করবে। এরপর ধীরে ধীরে হাঙ্গেরি, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া অ্যাক্সিস পাওয়ারে যোগ দেয় এবং ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল যুগোস্লাভিয়াকে আক্রমণ করে এবং ১৭ এপ্রিল যুগোস্লাভিয়া আত্মসমর্পন করে। এভাবে ব্রিটেন ও সুইজারল্যান্ড কে বাদে গোটা ইউরোপ জুড়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে জার্মানি ও ইটালি। সুইজারল্যান্ড প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও অংশ নেয়নি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও না। এবার হিটলারের নজর গিয়ে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর। হিটলার চাইছিল নাজি জার্মানির জন্য বিশাল শস্য ক্ষেত্র যা একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ছিল যা এখন ইউক্রেনে। একটা জিনিস বড়ই অদ্ভুত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানি দুজনে মিলেই চুক্তি করে পোল্যান্ড দখলের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সূচনা করেছিল কিন্তু হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন কে বিশ্বাস করত না। এবার সোভিয়েত ইউনিয়ন কে দখল করা এত সহজ নয় কারন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়ানক ঠান্ডা পরিবেশে একমাত্র সেখানকার লোকেরাই লড়াই করতে সক্ষম। সতেরো শতকে নেপোলিয়ন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি নিজেও সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে ঠান্ডার কারনে হেরে গেছিল। এটা হিটলার ভালোভাবেই জানত। যারজন্য হিটলার একটি পরিকল্পনা তৈরি করল।
হিটলার তার অধিকৃত সমস্ত দেশের সেনাকে নিয়ে যৌথভাবে সোভিয়েত আক্রমনের পরিকল্পনা করে। একমাত্র বুলগেরিয়া আসেনি। একে অপারেশন বারবারোসা বলা হয়। ইতিহাসে এতবড় অপারেশন কোনওদিন হয়নি। অপারেশন বারবারোসাতে হিটলার প্রায় ৩৮ লাখ সেনা, ৩৫০০ ট্যাঙ্ক, ৩০০০ যুদ্ধবিমান, ৬ লাখ গাড়ি ও ৭ লাখ ঘোড়া জোগাড় করেছিল। ২২ জুন, ১৯৪১ অপারেশন বারবারোসার সূচনা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে ঠান্ডা শুরু হয় ডিসেম্বর মাস থেকে, তাই হিটলার ২২ জুন থেকে ডিসেম্বররের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখল করা তিনটি বাল্টিক দেশ লাটাভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া সহ সোভিয়েতের লেলিনগ্রাদ শহর, যার আজকে নাম সেন্ট পিটাসবারগ, রাজধানী মস্কো দখল করে নেয়। কিন্তু এইসময় জাপান প্রশান্ত মহাসাগরে একটা ভুল করে বসে। এইসময় গোটা এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল।
জাপান একে একে এসব জায়গায় আক্রমন করে মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়ানিউগিনি হয়ে অস্ট্রেলিয়াতেও বোম্বিং করে। কারন এই সময় জাপান,জার্মানি ও ইটালির চুক্তি হয়েছিল। আর জার্মানির শত্রু মানে জাপানেরও শত্রু। এইসময় মায়ানমার থেকে আসামে আক্রমন করে জাপান ও নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোসের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ যা ব্যাটেল অফ ইম্ফল ও ব্যাটেল অফ কোহিমা নামে খ্যাত। কিন্তু এখানে ব্রিটিশ সেনার কাছে পিছু হটে জাপান। এই নিয়ে একটি ওয়েব সিরিজও আছে যার নাম ফরগোটন আর্মি। এভাবে জাপান প্রশান্ত মহাসাগরে প্রায় সমস্ত দেশ ও দ্বীপ দখল করে কারন জাপানের নৌবাহিনী খুব শক্তিশালী ছিল। জাপানের সমস্ত তেল আসত আমেরিকা থেকে। আমেরিকা জাপানকে তেল সহ সব জিনিস রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ফলে জাপান ১৯৪১ সালের ৭ ও ৮ ডিসেম্বর আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দর আক্রমণ করে বসে যা জাপানের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার সবচেয়ে বড় নৌবন্দর ও সেনা ঘাটি ছিল এই হাওয়াই দ্বীপের পার্ল হারবার বন্দর। জাপানের আক্রমনে আমেরিকার ২৫০০ সেনা সহ অনেক জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায় ফলে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যালায়েড ফোর্সের তরফে অংশ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান, জার্মানি ও ইটালির জোটকে অ্যাক্সেস পাওয়ার এবং আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জোটকে অ্যালায়েড পাওয়ার বলা হত। আমেরিকা তাদের সেনা নামায় ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসে জাপানের সাথে যুদ্ধের জন্য। এদিকে জার্মানি ও ইটালিও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জাপানের সাথে আমেরিকার সরাসরি যুদ্ধ হয় প্রশান্ত মহাসাগরের ওয়েক দ্বীপে যেখানে জাপান জিতে যায়। এরপর ১৯৪২ সালের ৭ জানুয়ারি ফিলিপিন্সে আমেরিকা ও জাপান সেনার মধ্যে যুদ্ধ হয় যাকে ব্যাটেল অফ বাটান বলা হয়, এখানেও জাপান জিতে যায়।