পৃথিবী

আন্তর্জাতিক আইনকে পাত্তা দিচ্ছে না চীন! জাপানের সাথে আবারও সমস্যা

রাজেশ রায়: একটা সময়ে দক্ষিন ভারতে সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল চোল সাম্রাজ্য। ভারতের প্রথম নেভিও এদের তৈরি। বর্তমান ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ সহ শ্রীলঙ্কা চোল সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। তাহলে আমরা কী বর্তমানে বলতে পারি এই দেশ গুলো ভারতের অংশ? আচ্ছা ঘটনার কথা বলি ভারতে আরও একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল কুষান সাম্রাজ্য। এদের কেন্দ্র মথুরায় হলেও, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সহ মধ্য এশিয়া হয়ে চীন জিন জিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত কুষান সাম্রাজ্যে বিস্তৃত ছিল। এবার কী তাহলে আমরা বলতে পারি এসব জয়গা আমাদের দিয়ে দিতে হবে এখন?? এসব কথা শুনে সবার মনে এসব আবার হয় নাকী!! দেখুন এমনই ঘটনা ঘটছে পূর্ব চীন সাগরে। আজ এব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করব। আজ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্রতিটি দেশের নির্দিষ্ট সীমানা রয়েছে। কিন্তু চীন এসব না মেনে সেই পূর্ব কালের ঘটনা টেনে বিতর্ক তৈরি করছে।

এই বিতর্কের সূত্রপাত সেনকাকু দ্বীপকে ঘিরে। পূর্ব চীন সাগরে অবস্থিত এই দ্বীপকে জাপান, চীন ও তাইওয়ান এই তিন দেশই নিজেদের বলে দাবি করে। সেনকাকু নাম জাপান ব্যবহার করে, চীন একে দয়াউ এবং তাইওয়ান তিয়াউতাই বলে। এটি আসলে ছোট ছোট অনেক দ্বীপের সমষ্টি। আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষাবিদদের ধারনা অনুযায়ী এব্যাপারটা যদি না মেটে তাহলে ভবিষ্যতে এখানে চীন ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধ হতে পারে। জাপান যুদ্ধে নামলে তাকে সাহায্য করতে আমেরিকা আসবে, এভাবে আশেপাশের দেশ গুলোও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। আচ্ছা এবার প্রথমে জানা যাক চীন কেন এই এলাকা নিজেদের বলে দাবি করছে? চীনের দাবি ১৮০০ সালের দিকে পূর্ব চীন সাগরে তিনটি সাম্রাজ্য ছিল চীনের কুইং সাম্রাজ্য, রিউকিউ দ্বীপে রিউকিউ সাম্রজ্য এবং জাপান। সেনকাকু দ্বীপ এই কুইং সাম্রাজ্য ও রিউকিউ সাম্রাজ্যের মাঝে অবস্থিত। চীন দাবি করে ১৮৭৯ সালে জাপান অবৈধ ভাবে রিউকিউ দখল করে নেয় এবং এই এলাকাকে ওকিনামা প্রদেশ নামে ঘোষনা করে। এজন্য চীন ১৮৮৫ সালের কিছু প্রমান দেয়। ১৮৮৫ সালে তৎকালীন রিউকিউ দ্বীপের প্রধান জাপানের বিদেশমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানায় জাপান যেন সেনকাকু দ্বীপ যে জাপানের সেজন্য কিছু ল্যান্ড মার্ক রাখে। কিন্তু জাপান কুইং সাম্রাজ্যের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে ভেবে এমন কিছু করে নি। যার জন্য চীন দাবি করে সেনকাকু দ্বীপ কখনও জাপানের ছিলই না সেজন্য জাপান তখন নিজেদের ল্যান্ড মার্ক দেয় নি।

১৮৯৫ সালে সিনো জাপান যুদ্ধ হয় যাতে জাপান সেনকাকু দ্বীপ সহ তাইওয়ান ও পূর্ব চীনের বহু অংশ দখল করে নেয়। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপান প্রচুর শক্তিশালী ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর ১৯৫১ সালে সান ফ্রান্সিসকো চুক্তি অনুযায়ী জাপানকে তার মূল ভূখন্ড ছাড়া বাকী সমস্ত অধিকৃত জায়গা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। চীন সবচেয়ে খুশি হয় এই চুক্তিতে কারন চীন তাদের জায়গা ফেরত পেয়েছিল কিন্তু জাপান সেনকাকু দ্বীপকে দেয়নি। এর জন্য জাপান জানায় সান ফ্রান্সিসকো চুক্তিতে অধিকৃত জায়গা জাপান ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু সেনকাকু দ্বীপ জাপান কখনও অবৈধ ভাবে দখল করে নি। এর সাপেক্ষে জাপান বলে তারা রিউকিউ দ্বীপ দখল করেছিল কিন্তু সেনকাকু দ্বীপে না চীনের না রিউকিউয়ের কারও কোন ল্যান্ডমার্ক ছিল না, তাহলে ফাঁকা জায়গা যে আগে দখল করবে সেটা তার। জাপান প্রমান হিসাবে ১৯২০ সালে এক চাইনিজ ডিপ্লোমাটের চিঠি দেখায় যেখানে ওই চাইনিজ ডিপ্লোমাট জাপনা সরকারকে ধন্যবাদ দিচ্ছে সেনকাকু দ্বীপে আটকে পড়া কিছু চাইনিজ জেলেকে উদ্ধার করার জন্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাপান দাবি করে সেনকাকু চীনের হলে জাপানকে কেন ধন্যবাদ দেওয়া হল। এছাড়াও জাপান ১৯৭০ সালের চাইনিজ বইয়ে সেনকাকু দ্বীপের কথা লেখা আছে সেটাও প্রমান দেখায়। কারন চীনে সেসময় এখনকার মতন কমিউনিস্ট সরকারই ছিল সুতরাং ভুল হবার কথা না। এখানে একটা কথা জানা দরকার। চীন, তাইওয়ান ও জাপানের মধ্যে যে সেনকাকু দ্বীপ কে নিয়ে এত বিতর্ক তার সূত্রপাত কিন্তু ১৯৭১ সালে হয়। ১৯৭১ সালে এমন কী হল যার জন্য এই বিতর্ক তৈরি হল সেটা জানা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই দ্বীপ আমেরিকার দখলে ছিল।

১৯৭১ সালে আমেরিকা এই দ্বীপ জাপানকে দিয়ে দেয় যা চীন ও তাইওয়ান সহ্য করতে পারে নি, এছাড়া এটা শোনা গেছে যে এই দ্বীপের আশেপাশে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের ভান্ডার আছে যার জন্য তিন দেশের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়। ১৯৯০ সালে চীন ও তাইওয়ানের মানুষ রাস্তায় নেমে আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে কারন আমেরিকা এই দ্বীপ জাপানকে দিয়ে দেয় বলে। এই সময় জাপানের কিছু ব্যাবসায়ী এই দ্বীপ জাপান সরকারের থেকে লিজে নেয় যাতে এখানে সামুদ্রিক খাবারের ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করা যায়। ২০১২ সালে জাপান লিজ শেষ হবার আগেই দ্বীপ কিনে নেয় কারন ততদিনে এই দ্বীপ নিয়ে বিতর্ক আরও বেড়ে যায়। ২০১২ সালে জাপানের সেনকাকু দ্বীপে চাইনিজ ও তাইওয়ানের কিছু লোক জোর করে নিজেদের দেশের পতাকা নিয়ে পৌঁছে যায়, তখন ১৪ জন চাইনিজকে গ্রেফতার করে জাপান, এরপর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আরও সবচেয়ে বড় সমস্যা সেটা হচ্ছে চীন বর্তমানে অর্থনৈতিকের পাশাপাশি মিলিটারি সুপার পাওয়ার। ১৯৯০ সালের চীন আর এখনকার চীনের মধ্যে প্রচুর পার্থক্য। একসময় জাপান চীনের তুলনা ব্যাপক আর্থিক শক্তিশালী দেশ ছিল কিন্ত চীন এখন জাপানকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে এই অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। যার জন্য এখানে জাপান আমেরিকার সাহায্য চেয়েছে। এবার আপনাদের মনে হতে পারে আমেরিকা তো জাপানে পরমানু বোম্ব ফেলেছিল তাহলে জাপান আমেরিকার এত বন্ধুত্ব কীসের। দেখুন আন্তর্জাতিক রাজনীতি এসব ব্যাপারের উপর চলে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জপান পুনর্গঠনের আমেরিকা সাহায্য করেছিল, এই এলাকায় আমেরিকাও স্বার্থ আছে। 

এবার অনেকের মনে হতে পারে তাইওয়ান কেনো কিছু বলছে না, দেখুন আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী দুটো বড় শক্তির যুদ্ধে তৃতীয় পক্ষের সর্বদা লাভ হয়। ২০২০ সালে তথ্য অনুযায়ী চীনের জনসংখ্যা যেখানে ১৪০ কোটি সেখানে জাপান ও তাইওয়ানের ১২. ৬ কোটি ও ২.৩৬ কোটি। সুতরাং চীনের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করবার ক্ষমতা তাইওয়ানের নেই। এদিকে ১৯৪৫ থেকে চীন তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ বলেই মনে করে। চীন এর জন্য এক চীন নীতি চালু করেছে যাতে প্রত্যেক বিদেশী কোম্পানিকে চীনে ব্যাবসা করতে হলে তাইওয়ান যে চীনের অংশ তা স্বীকার করতে হবে। এজন্য তাইওয়ানের সাথে বহু দেশের স্ট্রাটেজিক সম্পর্ক থাকলেও মজবুত ডিপ্লোমেটিক সম্পর্ক নেই কারন চীনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। তাইওয়ান এর জন্য জাপানের সাথে তাদের সম্পর্ক মজবুত করছে কারন জাপান ও আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে সুতরাং তাইওয়ানের জন্য এটা সবচেয়ে বড় সুযোগ। তাইওয়ান জাপানের সাথে চুক্তি করে ফিসারিজ ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করছে এখানে ২০১৩ সাল থেকে। এবার অনেকের ধারনা হতে পারে তাইওয়ান ছোট দেশ কী করতে পারবে!!  তাহলে আপনাদের জাপান ও তাইওয়ানের মধ্যে একটা হিসাব দিই। জাপানের সেনাবাহিনীর সংখ্যা যেখানে ২,৪৮,০০০ সেখানে তাইওয়ানের ২,৯০,০০০. জাপানের যুদ্ধবিমান যেখানে ৪৬৬ সেখানে তাইওয়ানের ৫০১. সুতরাং তাইওয়ান যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে জাপানের অর্থনীতি, নৌবাহিনী অনেক বেশী শক্তিশালী। তার উপর জাপানের সাথে আমেরিকার সমর্থন রয়েছে। চীনের জন্য এই জায়গা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারন এই এলাকা যদি জাপানের অধীনে থাকে তাহলে চীনের উপর চাপ বাড়বে। তাছাড়া গল্ফ দেশ গুলো থেকে তেল পূর্ব চীন সাগর হয়ে চীনে আসে, সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে জাপান কোনদিন এখানে ব্লক করে দিলে চীনে শক্তির সংকট হয়ে যাবে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছে চীন যদি সেনকাকু দ্বীপের কাছে মিলিটারি পাওয়ার বাড়াতে আসে তাহলে আমেরিকা জাপানকে সমর্থন করবে। সুতরাং সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে ভবিষ্যতে এখানে আমেরিকা, জাপান ও চীনের মধ্যে বড় ঝামেলার সম্ভাবনা রয়েছে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published.