ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করতে কি প্ল্যান করেছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দারা?
ইরানের ভেতরে সে দেশের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী ফাখরিজাদেহকে হত্যা করেছিল ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা। হত্যার আগে এমন নজরদারি চালানো হয়েছিল, যাতে তার নিঃশ্বাসের শব্দও টের পেতো মোসাদের গোয়েন্দারা।
ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মহসেন ফাখরিজাদেহ হত্যায় ইসরাইয়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ জড়িত ছিল বলে দাবি করেছে বিশ্বের প্রাচীনতম ইহুদি পত্রিকা জুইশ ক্রনিকলস। ব্রিটিশ এই পত্রিকাটি বলছে, ফাখরিজাদেহকে হত্যার আগে এমন নজরদারি চালানো হয়েছিল, যাতে তার নিঃশ্বাসের শব্দও টের পেতো মোসাদের গোয়েন্দারা।
জুইশ ক্রনিকল- এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেহরানের উপকণ্ঠে মহসেন ফাখরিজাদেকে হত্যায় অংশ নেন মোসাদের ২০ জন গোয়েন্দা। প্রায় এক টন ওজনের একটি দূর নিয়ন্ত্রিত বন্দুকের সাহায্যে তাকে হত্যা করা হয়। ইসরায়েলের একটি গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি বলছে, ইরানের পরমাণু কেন্দ্র থেকে গোপন নথি হাতে পাওয়ার পরই মহসেনকে হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় ইসরায়েল।
ইরান পরমাণু বোমা বানাতে পারলে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা থাকতো মহসেন ফাখরিজাদের। মহসেন দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষণা ও উদ্ভাবন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর একদল আততায়ীর হামলায় নিহত হন তিনি। ইরান দাবি করে আসছিল, এই হামলার পেছনে ইসরায়েল জড়িত। তবে এখনও পর্যন্ত হামলার দায় স্বীকার করেনি এই ইহুদি রাষ্ট্রটি।
গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে জুইশ ক্রনিকলস তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, প্রায় আট মাস ধরে প্রস্তুতি নেয়ার পর মহসেন ফাখরিজাদেহকে উদ্দেশ্য করে হামলা চালায় মোসাদের গোয়েন্দারা। আততায়ী দলটিতে ইরানের কয়েকজন নাগরিকও ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫৯ বছর বয়সী ফাখরিজাদেহকে হত্যায় ১৩টি বুলেট খরচ করে মোসাদ। এর সবকটিই নিখুঁতভাবে তার মাথায় বিদ্ধ হয়। মোসাদ জানিয়েছে, ফাখরিজাদেহকে ছাড়া ওই হামলায় অন্য কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হননি। হামলার সময় তার স্ত্রী ও ১২ জন দেহরক্ষীও গাড়িবহরে ছিলেন।
জুইশ ক্রনিকলসকে গোয়েন্দাসূত্রটি জানিয়েছে, বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচাতে ‘অত্যন্ত নিখুঁত’ হামলা চালাতে সক্ষম বন্দুক ব্যবহার করা হয়েছিল। এর প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশ প্রায় আট মাস ধরে ইরানে গোপনে পাচার করা হয়েছিল। হামলার আগে এক টন ওজনের বন্দুকটিকে একটি নিসান গাড়ির ওপরে স্থাপন করা হয়। এরপর রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে দূর থেকে ফাখরিজাদেহর গাড়ির ওপর গুলি চালানো হয়। তিনি মারা গেছেন নিশ্চিত হওয়ার পরই বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিসান গাড়িটিকে উড়িয়ে দেয় ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। এরপরই সেখান থেকে সরে পড়ে তারা।
ফাখরিজাদেহকে হত্যার পর ইরান দাবি করছিল, তাকে স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত অস্ত্রের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি কিছু গণমাধ্যম দাবি করেছিল, হত্যায় ৬২ জন বন্দুকধারী অংশ নিয়েছিল। জুইশ ক্রনিকল- এর প্রতিবেদনে এমন দাবিকেও নাকচ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এটি এখন প্রমাণিত যে, ইরানের ভূমিতেই দীর্ঘ কয়েক মাস প্রস্তুতি নিয়ে তাদের শীর্ষ বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে মোসাদ।
জুইশ ক্রনিকল এটিও দাবি করেছিল, ফাখরিজাদেহকে হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা না থাকলেও অভিযানের ব্যাপারে জানত দেশটি। পত্রিকাটির মতে, ইরানের বিরোধী পক্ষকে দমনেই সরকার শক্তি খরচে ব্যস্ত থাকায় দেশটির মাটিতে এমন অভিযান চালাতে সক্ষম হয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়লের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাকব নাগেলের মতে, ফাখরিজাদেহতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম পরমাণু বোমা বানানোর কাজ করছিলেন এমন প্রমাণ আছে মোসাদের কাছে।
জ্যাকব নাগেল বলেন, ‘তিনি (ফাখরিজাদেহ) এই বিষয়ে খুব সিরিয়াস ছিলেন। তিনি যে পরিকল্পনা করেছিলেন, তা বাস্তবায়ন করেই ছাড়তেন। তাই কেউ একজন সিদ্ধান্ত নিল যে, দুনিয়াতে ফাখরিজাদেহর সময় শেষ হয়ে এসেছে।’ জুইশ ক্রনিকল- এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্তত দুই বছর আগে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে বিপুল পরিমাণ গোপন নথি চুরি করতে সক্ষম হয় ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। ৩২টি বিশালাকৃতির সিন্দুক থেকে এই নথিগুলো চুরি করা হয়।
প্রায় ৫০ হাজার পৃষ্ঠার কাগজপত্র ও ১৬৩ সিডিতে ইরানের গোপন পরমাণু কর্মসূচির বিস্তারিত লেখা ছিল। এই নথিগুলো ইসরায়েলের একটি গোপন জায়গায় সংরক্ষিত আছে। দেশটির সরকারের কয়েকটি সূত্র জুইশ ক্রনিকলকে জানিয়েছে, ইরানের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি না করতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে প্রভাবিত করতে এই নথিগুলো ব্যবহার করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে এটি বোঝানোর চেষ্টা করা হবে, পরমাণু ইস্যুতে ইরানকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা উচিত হবে না।
ইসরায়েলের দাবি, ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে করা যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি ইরানের পরমাণু কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে সহায়তা করেছিল। ইসরায়েলের মতে, ইরানের গোপন নথিগুলো প্রমাণ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা চুক্তির বর খেলাপ করেছিল দেশটি। একই নথি দেখিয়ে ইরান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রকে ট্রাম্পের নীতিতে অটল থাকার ব্যাপারে প্রভাবিত করতে চায় ইসরায়েল।
২০১৮ সালে এই নথিগুলো হাতে পাওয়ার পরই মহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় ইসরায়েল। দেশটির গোয়েন্দাসূত্র জুইশ ক্রনিকলকে জানিয়েছে, এই নথিগুলোর বেশিরভাগই ফাখরিজাদেহ নিজ হাতে লিখেছিলেন। পরমাণু কর্মসূচির সবকিছুই চলছিল তার নির্দেশনা অনুযায়ী। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে শুরু করে কর্মী নিয়োগ পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যাপারে নিজে সিদ্ধান্ত নিতেন ফাখরিজাদেহ।
২০২০ সালের মার্চ মাস। পুরো বিশ্ব তখন করোনাভাইরাস মহামারিতে নাকাল। এ সময়ই ফাখরিজাদেহকে হত্যার চূড়ান্ত পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু করে মোসাদ। ইসরায়েল থেকে চোরাপথে সংস্থাটির একদল গোয়েন্দা ইরানে প্রবেশ করে। গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে জুইশ ক্রনিকলস বলছে, ‘পুরো দলটির কাজ নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এমনকি প্রত্যেক মিনিটে তারা কি করবে, সেটি পর্যন্ত। আট মাস তারা ফাখরিজাদেহর ওপর নিবিড় নজরদারি জারি রাখা হয়।’
বিষয়টি এমন যেন ফাখরিজাদেহর প্রতিটি নিঃশ্বাসের খবরও গোয়েন্দারা জানতো। তারা যেন তার সঙ্গেই থাকতো, ঘুমাতো, জেগে থাকতো, ঘুরে বেড়াতো। ‘কোনো সকালে যদি ফাখরিজাদেহ তার দাড়িগোঁফ কামাতেন, তাহলে আফটার শেভের গন্ধ পর্যন্ত গোয়েন্দারা পেয়েছে।’ ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ ফাখরিজাদেহ এমন সব সুযোগসুবিধা ভোগ করতেন, যা অন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের নাগালের বাইরে ছিল। ইরানের অন্যতম অবকাশ অঞ্চল আবসারদে একটি ভিলা ছিল তার। প্রত্যেক শুক্রবার তেহরান থেকে সেখানে বেড়াতে যেতেন ফাখরিজাদেহ।
মোসাদের গোয়েন্দারা জানতেন, ফাখরিজাদেহ কোন পথে যাতায়াত করেন, কত গতিতে তার গাড়ি চলে এবং গাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য ফাখরিজাদেহ কোন দরজাটি ব্যবহার করেন। হত্যার দিন একটি কালো রঙের গাড়িতে চড়ে স্ত্রীকে নিয়ে ভিলার দিকে যাচ্ছিলেন ফাখরিজাদেহ। তাদের পাহারা দিচ্ছিল ১২ দেহরক্ষীর একটি গাড়িবহর। এদের অজ্ঞাতসারেই মোসাদের গোয়েন্দারা রাস্তা থেকে নিচে মাটিতে বসে অপেক্ষা করছিল। খেয়াল করছিল তাদের প্রত্যেক গতিবিধি এমনকি নড়াচড়া পর্যন্ত।
ফাখরিজাদেহের গাড়িটি আগে থেকে ঠিক করা জায়গা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরনিয়ন্ত্রিত অস্ত্রের বোতামে চাপ দেন গোয়েন্দারা। অত্যন্ত নিখুঁত বন্দুকটির ১৩টি বুলেট ফাখরিজাদের মাথায় বিদ্ধ হয়। জুইশ ক্রনিকলসের কাছে গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, হামলা এত নিখুঁত ছিল যে, ফাখরিজাদেহর থেকে দশ ইঞ্চি দূরে বসা তার স্ত্রীও আহত হননি। ইরান দাবি করেছিল, ফাখরিজাদেহর নিরাপত্তা প্রধানও হামলায় আহত হয়েছিলেন। তবে এমন দাবি নাকচ করে দিয়েছে মোসাদের সূত্রটি।
হামলার পরই বন্দুকবহনকারী গাড়িটিকে উড়িয়ে দিয়ে নিরাপদে সরে পড়তে সক্ষম হন গোয়েন্দারা।
জুইশ ক্রনিকল- এর মতে, নিজেদের মাটিতে এমন হালমার পরে লজ্জায় পড়ে যায় ইরান। এমনকি মোসাদের শীর্ষ অনেক কর্মকর্তাও এমন সফলতা আশা করেননি।
ইরান জানিয়েছে, ফাখরিজাদেহকে হারানোর ক্ষতি সামলে উঠতে আরও ছয় বছরের মতো সময় লাগবে তাদের। ইসরায়লের মতে, ফাখরিজাদেহ মারা না গেলে হয়ত পরমাণু বোমা বানাতে আর মাত্র তিন মাস সময় লাগতো ইরানের। গোয়েন্দা সূত্রটি জুইশ ক্রনিকলসকে জানিয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়িত ছিল না। এটি পুরোপুরি একটি ইসরায়েলি অপারেশন। এই হত্যা কোনোভাবেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ঘটেনি। নিরাপত্তার স্বার্থেই এমন অভিযান চালানো হয়েছে।
‘যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র নেই। কারণ হামলা হয়েছে বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পরেই। তবে এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা আঁচ দিয়েছিল ইসরায়েল। ঠিক যেভাবে তারা ইরানি জেনারেল সোলেইমানিকে হত্যার আগে ইসরায়েলকে জানিয়েছিল।’ নিজেদের ‘রক্ষার স্বার্থে’ ভবিষ্যতে ইসরায়েল ইরানের ওপর এরকম আরও হামলা চালাবে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সূত্রটি।
সূত্রটি বলছে, ‘পরিস্থিতি সংকটপূর্ণ হলে আমরা কারও অনুমতির অপেক্ষায় থাকবো না।’ এর আগে ২০১০ ও ২০১২ সালে আরও চারজন ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী খুন হন। এর জন্যও ইসরায়েলকে দায়ী করে আসছে ইরান। ২০১৮ সালে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নির্দিষ্ট করে মহসেন ফাখরিজাদেহর নাম উল্লেখ করেছিলেন। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে পরমাণু বোমার জনক রবার্ট ওপেনহাইমারের সঙ্গে তুলনা করেছিল।