রানী পদ্মাবতীকে বাঁচাতে দুই রাজপুত যোদ্ধার অবদান আজও ভোলার নয়
রাজেশ রায়:- স্বাধীনতা কী, দেশপ্রেম কী, বীরত্বের সংজ্ঞা এবং নারীর সম্মান কী করে করতে এর উত্তর খুঁজতে জাপান বা ইউরোপের কোন সভ্যদেশে যাবার প্রয়োজন নেই আমাদের ভারতবর্ষে এমন হাজার হাজার উদাহারন আছে। তবে রাজস্থানের মাটি যেন একটু বেশীই পবিত্র। এই পবিত্র ভূমিতেই জন্ম হয়েছে বাপ্পা রাওয়াল, প্রিথ্বীরাজ চৌহান, মহারানা প্রতাপ, রানা সাঙ্গার মতন কালজয়ী বীরের। এটা সেই ভূমি যেখানে আলাউদ্দীন খিলজীর হাত থেকে সম্মান বাঁচাতে মহারানী পদ্মাবতী তার ১৬০০০ সহচরীর সাথে জহর করে নেয়। কৃষ্ণ সাধিকা মীরাবাঈের জন্ম এখানেই। ভারতবর্ষের বিগত ১০,০০০ বছরের ইতিহাসে ভারত কখনও কাউকে আক্রমন করেনি। যে ধর্মের, যে জাতের লোকই ভারতবর্ষে এসেছে তাকেই এই মহান দেশ শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির ধ্বনির মত প্রেমের ভাবে আপন করে নিয়েছে। অতিথি দেব ভবো রীতি ভারতবর্ষে বহু প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। কিন্তু সাপকে যতই দুধ খাওয়ানো হোকনা কেন সাপ ছোবল মারবেই। ঠিক এমনটাই হয় রাজস্থানের রানা রতন সিং এর সাথে। যুদ্ধ এড়াবার জন্য, লাখ লাখ মানুষের প্রান বাঁচাবার জন্য যে খিলজীকে অভ্যার্থনা যে রতন সিং তিনি জানতেও পারেননি তিনি কী ভুল করতে যাচ্ছেন। যে আলাউদ্দিন খিলজী তার কাকা জালালউদ্দিনকেও ছাড়েনি তাঁকে ভরসা করাই উচিৎ নয়। রানা রতন সিং যখন আলাউদ্দিনকে দুর্গের দরজা অবধি পৌঁছে দিতে যান তখন ছলনা করে তাকে বন্দি করে দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন দিল্লী থেকে চিঠি আসে দশ দিনের মধ্যে রানী পদ্মাবতী যদি দিল্লী না আসে তাহলে রানা রতন সিং এর কাটা মাথা চিতরো আসবে। এখান থেকেই শুরু হয় পন্ডিত নরেন্দ্র মিশ্রের কালজয়ী রচনা গোরা বাদল।
দিল্লী থেকে খবর আসতেই চিতোরে এই সংবাদ দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়ে। তবে রাজপুতদের কাছে এধরনের সংবাদ নতুন কীছু নয়। বলিদান, সাহস ও বীরত্বের জন্য রাজপুত যোদ্ধাদের খ্যাতি গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। কিন্তু সবার মনে একটাই ভাবনা দিল্লীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব কে দেবে। রানী পদ্মাবতী জানতেন এই যুদ্ধে একমাত্র নেতৃত্ব দিতে পারে পূর্বতন সেনাপতি গোরা ও তার ভাইপো বাদল। পূর্বতন বলা হচ্ছে কারন বলা হয় আলাউদ্দিন খিলজী রানী পদ্মাবতীর রূপের খ্যাতি শুনে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে কোনরকমে যুদ্ধ এড়াবার জন্য রানা রতন সিং আয়নায় একবার মহারানী পদ্মাবতীর মুখ দেখতে দেয় আলাউদ্দিন খিলজীকে। রানার এই প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধীতা করেছিল সেনাপতি গোরা। তার বক্তব্য ছিল মহারানী পদ্মাবতী চিতোরের অহঙ্কার। তার মুখের দিকে কোন আততায়ী তাকলে তার মাথা কেটে রনচন্ডীকে অর্পন করা হবে। কিন্তু আসন্ন যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা ভেবে রানা রতন সিং কুটনৈতিক কারনে গোরার এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। সেজন্য রাজপুত স্বভিমানের কারনে সেনাপতি গোরা চিতর ছেড়ে জঙ্গলে চলে যান। মহারানী পদ্মাবতী জানতেন গোরাকে ফিরিয়ে আনতে হলে তাঁকেই যেতে হবে। সেজন্য তিনি তার রক্ষকদের নিয়ে নিজেই জঙ্গলে যান।
মহারানীকে দেখে অভিমানি গোরা বলেন তিনি একজন সামান্য তুচ্ছ প্রজা, রাজনীতি, কুটনীতি বোঝেননা। রাজপ্রসাদ তার জন্য নয় তিনি শুধু মর্যাদার জন্য যুদ্ধ করেন। স্বয়ং মহারানী পদ্মাবতী ঘোড়া থেকে নেমে গোরার সামনে নতমস্তক হয়ে ক্ষমা চান এবং সমস্ত কথা জানান। এবার সব অভিমান ভুলে গোরা বলেন ওঠেন আপনি সিসোদিয়া কূলের জগদম্বা, স্বয়ং একলিঙ্গের জ্যোতি স্বরূপা, যতক্ষন গোরার কাঁধের উপর মস্তক আছে ততক্ষন স্বয়ং মহাকালও রানার মাথা কাটতে পারবে না, আপনি নিশিন্ত মনে রাজমহল থেকে সব দেখুন, এবার খিলজী দেখবে রাজপুত তরোয়ালের ধার, রানা সশরীরে ফিরে না আসা অবধি গোরা মরবে না, মাথা কেটে গেলেও একপ্রহর গোরা যুদ্ধ করবে, একলিঙ্গের শপথ মহারানা ফিরে আসবে, মহাপ্রলয়ও তা রুখতে পারবেনা। বলা হয় পিতমহ ভীষ্মের পর গোরার এই প্রতিজ্ঞা ছিল সবচেয়ে ভীষন।
গোরা রাজপ্রাসাদে ফিরে আসে এবং একা মহা চতুর পরিকল্পনা তৈরি করে। সাতশো পালকি তৈরি করা হয়। মহারানী পদ্মাবতী গোরাকে নিজে হলুদ তিলক পড়ান অশ্রুভেজা চোখে। সেনাপতি গোরা মাটিকে প্রনাম করে ঘোড়ায় ওঠেন, তিনি জানতেন হয়ত নাও ফেরা হতে পারে। হর হর মহাদেব বলে সাতশো পালকিতে সাতশো জন যোদ্ধা সাথে পালকি বাহক ৪ জন করে মানে প্রায় ৩৫০০ সেনা ছদ্মবেশে অগ্রসর হয় দিল্লীর দিকে। ওদিকে দিল্লিতে আলাউদ্দিন খিলজীকে খবর পাঠানো হয় মহারানী পদ্মাবতী দিল্লি আসছে এবং সাথে আরও সাতশো সখী আসছে তার সাথে। ওদিকে দিল্লিতে গিয়ে দূত খবর দেয় আলাউদ্দিনকে মহারানী পদ্মাবতী আসছে কিন্তু ওনার একটা শর্ত আছে শেষবারের মতন রানা রতন সিং এর সাথে একবার দেখা করার। খুশীতে পাগল হয়ে যাওয়া আলাউদ্দিন দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। মহারানী পদ্মাবতীর পালকিতে একজন কামার ছিল, পরিকল্পনা ছিল যখন রানার সাথে পদ্মাবতীর দেখা করানো হবে তখন ওই কামার রানার শেকল খুলে দেবে এবং স্বয়ং সেনাপতি গোরা আরও দশটি পালকি নিয়ে পাহাড়া দেবে।
বলিউডের সিনেমা পদ্মাবতীতে দেখানো হয়েছে মহারানি পদ্মাবতী দিল্লি গিয়েছিলেন কিন্তু পন্ডিত নরেন্দ্র মিশ্র এবং ঐতিহাসিকরা জানান মহারানী জাননি বরং একজন কামার গিয়েছিলেন। আসলে বলিউড সব সময় আনাদের সংস্কৃতিকে বিকৃত করে দেখায় বলে মত সামরিক বিশেষজ্ঞদের। গোরা তার ভাইপো বাদলকে ডেকে বলেন রানা রতন সিংকে কারাগার থেকে মুক্ত করে যখন নিয়ে যাওয়া হবে তখন কেউ বাধা দিলে তার সাথে মোকাবিলা করতে, দেহ থেকে রক্ত ঝড়লেও মাথা কেটে গেলেও মেবারের সম্মান রক্ষা করতেই হবে। একের পর এক পাহারাদারের মাথা কেটে গোরা কারাগারে পৌঁছায় এবং রানা রতন সিংকে মুক্ত করে। কিন্তু বলেনা কোন যুদ্ধ বলিদান ছাড়া হয় না। ঠিক তখনই খিলজী সেনা রাজপুতদের উপর আক্রমন করে। আসলে খিলজী সেনাপতি মহম্মদ জাফর প্রথম থেকেই সন্দেহ করছিল কিন্তু যখন জানতে পারে পদ্মাবতী আসেনি তখন হাজার হাজার খিলজী সেনা আক্রমন শুরু করে। ভিষন যুদ্ধ হয় রাজপুত ও খিলজীদের মধ্যে। জাফর ও গোরার মধ্যেও প্রবল যুদ্ধ চলে। জাফর ছলনা করে যুদ্ধের নিয়ম ভেঙে গোরার হাঁটুতে আঘাত করে গোরার মাথা কেটে দেয় কিন্তু বিনা মস্তকের গোরার শরীর মাটিতে পড়বার আগে তরোয়ালের এক কোপে জাফরের দুই টুকরো করে দেয়। ইতিহাস সাক্ষী আছে প্রবল প্রতাপশালী খিলজী সেনাপতি মহম্মদ জাফরের দুই টুকরো করেছিল গোরার মস্তকহীন দেহ। কাকার মৃত্যু দেখে বাদল নিজেও ভয়ানক যুদ্ধ করে কিন্তু অনেক বীরত্বের পর তিনিও বীরগতি প্রাপ্ত হন তবুও রানা রতন সিং কে এতটুকু ছুঁতে পারেনি খিলজী সেনা। বিশাল খিলজী সেনার সামনে কয়েক হাজার মেবারি সেনা সেদিন যে বীরত্ব দেখিয়েছিল তার কথা যুগ যুগান্তর ধরে ইতাহাসের পাতায় স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে। গোরা ও বাদলের এই বলিদানে যেন স্বয়ং ভারত মাতা কেঁদেছিল। মাথা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবার পরও এক রাজপুতের শরীরও তার স্বভিমানের জন্য লড়াই করে তার বাস্তব উদাহারন গোরা বাদল। ভারত মায়ের এই মহান পুত্রদের কারনে ভারতের মাটিকে চন্দন বলা হয়।