অজিত দোভাল এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে এতো গুরুত্ব কেন দেওয়া দিচ্ছে ইউরোপের দেশ গুলি?
রাজেশ রায়:– আজ এমন এক লোকের কথা বলব যে পর্দার পেছনে থেকে ভারতের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে চলেছে। সাধারনত কোন দেশের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর কথা সবাই বলে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোন সিদ্ধান্ত একা নেন না, এর পেছনে অনেক মাথা কাজ করে। এই মহূর্তে ভারতের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা বিদেশমন্ত্রী হচ্ছেন এস জয়শঙ্কর বা সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর। এনার জন্য গোটা বিশ্বে ভারতের অবস্থান অনেক শক্ত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে এনার প্রশংসা করেন। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান দুই স্তম্ভ হচ্ছে জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। কিছুদিন আগেই ইউক্রেন থেকে ভারতীয় ছাত্রদের উদ্ধারের জন্য অপারেশন গঙ্গা মিশন করা হয়েছিল তা,সম্পূর্ণ এনার মাথা থেকেই এসেছে। আজকে এই সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্করের জীবন কাহিনী সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করব।
৯ জানুয়ারী, ১৯৫৫ সালে দিল্লিতে জন্ম হয় সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্করের। ওনার পিতা কে না কিষ্ন জয়শঙ্কর ও মাতা সুলোচনা জয়শঙ্কর। ওনার পিতা নিজেও একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার ছিলেন যিনি অটল বিহারি বাজপেয়ীর কার্গিল কমিটির সদস্যও ছিলেন। আদতে জয়শঙ্কর পরিবার তামিলনাড়ুর বাসিন্দা কিন্তু ওনার বাবা সিভিল সার্ভিস অফিসার হওয়ায় উনি দিল্লিতেই বড় হয়েছেন। তামিল হলেও উনি খুব সাবলিল হিন্দি বলেন। হিন্দি ছাড়াও তিনি তামিল, ইংরাজী, জার্মান সহ অনেক ভাষাই জানেন। যদি শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা বলা হয় তাহলে সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর দিল্লির এয়ারফোর্স সেন্ট্রাল স্কুল থেকে পাশ করার পর দিল্লির সেন্ট স্টিফান কলেজ থেকে কেমিস্ট্রিতে গ্রাজুয়েট হন। তার লক্ষ্য ছিল আইআইটিতে যাওয়া কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিল্লির জহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সের উপর এমএ করেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর এমফিল ও পিএইচডি করেন। নিউক্লিয়ার ডিপ্লোম্যাসিতে তার দক্ষতা অসাধারণ। ১৯৭৭ সালে তিনি প্রথমে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। তার প্রথম পোস্টিংই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে।
সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর এমনই একজন ব্যাক্তি যিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, চীন তিন জায়গাতেই ছিলেন দীর্ঘদিন ভারতীয় প্রতিনিধি হিসাবে। এই ফিল্ডে তার অভিজ্ঞতা ৩৮ বছর বা প্রায় চার দশকের। শুধু মোদী সরকারই নয় বরং এর আগে মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ও তাকে খুব পচ্ছন্দ করতেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পর তার পোস্টিং হয় আমেরিকাতে। আমেরিকার পর উনি যান শ্রীলঙ্কায়৷ শ্রীলঙ্কারয় সেসময় তামিল টাইগারদের সাথে গৃহযুদ্ধ চলছিল, ওনার প্রধান কাজ ছিল ভারতীয় শান্তি রক্ষা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া। ১৯৮৫ সালে যখন আমেরিকাতে ফাস্ট সেক্রেটারি হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন তখন তারাপুর পরমানু কেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফুয়েল নিয়ে আমেরিকার সাথে একটু সমস্যা হয়ে গেছিল ভারতের। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে ফুয়েল হিসাবে দরকার ইউরেনিয়াম। তখন ইউরেনিয়াম আনার জন্যও আমেরিকার অনুমতি লাগত। এস জয়শঙ্কর সেসময় আমেরিকার সাথে ঝামেলা দারুন ভাবে মেটান। এরপর তিনি শ্রীলঙ্কা যান, সেখান থেকে ১৯৯৬-২০০০ সাল অবধি তার জাপানে পোস্টিং হয়। ১৯৯৮ সালে পোখরানে ভারতের পরমানু বোম্ব টেস্ট করাকে সেসময় জাপান সমর্থন করেছিল। জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের রাজনৈতিক উত্থান সবে শুরু হয়েছে তখন, বলা হয় শিনজো অ্যাবেকে ভারতীয় রাজনীতিবিদ দের সাথে পরিচায় তিনিই করান। ২০০১ থেকে ২০০৪ অবধি চেক রিপাবলিককে তার পোস্টিং হয়। ২০০৭ থেকে ২০০৯ অবধি সিঙ্গাপুরে পোস্টিং হয় এস জয়শঙ্করের যেখানে তিনি সিঙ্গাপুরের সাথে ভারতের বানিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করেন৷ তাছাড়া সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটিতে ভারতীয় ছাত্রদের স্কলারশিপ সহ পড়ার সুযোগ করতেও তার বড় ভূমিকা ছিল। ২০০৭ সালে আমেরিকার সাথে ভারতের ১২৩ পাতার ঐতিহাসিক নিউক্লিয়ার চুক্তি হয় যার পুরো কৃতিত্ব ছিল জয়শঙ্করের। সেসময় ভারতের ক্ষমতায় ছিল মনমোহন সিং এর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার।
আমেরিকার সাথে এই চুক্তি মানতে পারেনি কমিউনিস্ট দল যার জন্য তারা কংগ্রেস থেকে সমর্থন সরিয়ে নেয় এবং মাত্র একটা সিটের জন্য কংগ্রেস কোনও রকমে ক্ষমতায় টিকে গেছিল। আচ্ছা এখানে কথা বলি জয়শঙ্কর জাপানে থাকার সময় স্থানীয় এক জাপানি মহিলা কিওকো কে বিবাহ করেন। এনাদের দুই ছেলে ধ্রুব ও অর্জুন এবং মেয়ে মেধা রয়েছে। সিঙ্গাপুরের পর জয়শঙ্কর চীনে যান। সেসময় চীনের সাথে ভারতের একটু বেশীই সমস্যা ছিল যেমন চীন ভারত বিরোধীদের ভিসা দিত, ভারতের কিছু অংশ নিজেদের বলে দাবি করত। জয়শঙ্কর এসব অত্যন্ত সুকৌশলে মোকাবিলা করেন। সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর প্রথম কোন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত যিনি প্রায় সাড়ে চার বছরের দীর্ঘ সময় চীনে ছিলেন। ২০১৩ এর ২৩ ডিসেম্বর নিরুপমা রাও এর পর তাকে জয়শঙ্করকে আবার আমেরিকাতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ করা হয়। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এস জয়শঙ্করকে ভারতের বিদেশ সচিব হিসাবে নিয়োগ করা হয়। ২০১৯ সালে তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কার পান। বিদেশ সচিবেরও একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। ২০১৬ সালে ওনার অবসর নেবার কথা কিন্ত কেন্দ্রীয় সরকার ওনাকে আরও দুবছর বিদেশ সচিব করে রাখেন। অবশেষে ২০১৮ তে তিনি অবসর নেন। ভারতে সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী বিদেশ সচিব অবসর নেবার পরবর্তী দুই বছর কোথাও কোন কাজ করতে পারবে না একে কুলিং পিরিওড বলে। তবে মোদী সরকার এটা কমিয়ে এক বছর করে। ২০১৯ সালে টাটা সন্সের হয়ে তাদের গ্লোবাল করপোরেট অ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট হন এস জয়শঙ্কর।
২০১৯ এ আবারও ক্ষমতায় আসে বিজেপি সরকার। তখন ঠিক করা হয় নতুন বিদেশমন্ত্রী কে হবে কারন সুষমা স্বরাজের অকাল প্রয়ানে তার সমতুল্য যোগ্য ব্যক্তিত্ব দরকার ছিল। তখন এস জয়শঙ্করকে ভারতের নতুন বিদেশমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ করা হয়। জয়শঙ্কর কোন নির্বাচন লড়েননি সেজন্য ছয় মাসের মধ্যে রাজ্যসভা থেকে নির্বাচন করে তাকে নিয়োগ করা হয়। ২০১৫ সালে ইয়ামেন থেকে ভারতীয়দের উদ্ধারের জন্য অপারেশন রাহাত চালানো হয়, যদিও সেসময় বিদেশমন্ত্রী স্বর্গীয়া সুষমা স্বরাজ ছিলেন কিন্তু পুরো পরিকল্পনা বিদেশ সচিব হিসাবে এস জয়শঙ্করের ছিল। সম্প্রতি ইউক্রেনে অপারেশন গঙ্গার আওতায় ৯০ টি বিমান ভারত সহ অনেক বিদেশি ছাত্র দের ফেরানো হয়। এইসময় আমেরিকা, চীন, ইংল্যান্ড সব বড় বড় দেশ তাদের বিমান পাঠাতে অস্বীকার করে কিন্তু ভারত এগিয়ে আসে। সম্প্রতি আমেরিকা জানায় ভারতে মানবিক অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে এর জবাবে জয়শঙ্কর বলেন আমেরিকাতেও মানবিক অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে কীছুদিন আগেই আমেরিকাতে একজন শিখকে খুন করা হয়েছে। আমেরিকা ভারতকে বলে রাশিয়া থেকে তেল না নিতে এর জবাবে ভারত জানায় ভারত এক মাসে যা তেল কেনে ইউরোপ একদিনে এর থেকে বেশী এনার্জি কেনে রাশিয়া থেকে। তার এইসব বক্তব্য প্রমান করে ভারতের বিদেশনীতি কতটা শক্তিশালী। চীনকেও ছাড়েননি তিনি। প্যারিসে হওয়া ইন্দো প্যাসিফিক সামিটে তিনি বলেন চীন বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকী। এস জয়শঙ্কর তার শান্ত স্বভাব ও ক্ষুরধার মস্তিষ্কের জন্য বিখ্যাত। তার মত বিদেশমন্ত্রীর জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে ভারত শক্ত অবস্থানে রয়েছে।