ভারতবর্ষ চাইলে চীনের তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসের সাপ্লাইকে বন্ধ করে দিতে পারে
রাজেশ রায়:– কখনও কী ভেবে দেখেছেন একটি সংকীর্ণ জলপথ কীভাবে গ্লোবাল পাওয়ার হাউস কে চ্যালেঞ্জ করতে পারে? হ্যাঁ আজ কথা বলা হচ্ছে সমুদ্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংকীর্ণ জলপথ মালাক্কা প্রনালী সম্পর্কে। বিশ্বের সমুদ্র বানিজ্য ও এনার্জি পরিবহন বিশেষ কিছু চোক পয়েন্টের মাধ্যমে হয় যা দুটি সমুদ্র বা ফাইনাল গন্তব্যের পথকে যুক্ত করে। এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ চোক পয়েন্ট হল মালাক্কা প্রনালী যা দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর পরিবেষ্টিত এবং বহু যুগ ধরে এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য পথ এটি। প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারতমহাসাগরের মাঝে আবস্থিত এই মালাক্কা প্রানালী বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যাস্ততম বানিজ্য পথ এবং এশিয়া মহাদেশের লাইফলাইন। ইউএস এনার্জি ইনফর্মেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বক্তব্য অনুযায়ী এখান দিয়ে প্রতি বছর ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ক্রুড অয়েল পরিবহন হয়। এই এলাকা চীনের জন্য বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ কারন ইউরোপ মধ্য প্রাচ্য ও আফ্রিকার সাথে বানিজ্যের জন্য চীনের উপর নির্ভরশীল রয়েছে। চীনের ৭৮ শতাংশ এনার্জি এখান দিয়েই পরিবহন হয়। বিগত তিন দশকে চীন এখান দিয়ে বানিজ্য করে নিজের আর্থিক উন্নতি করেছে যথেষ্ট। চীনের জন্য এই মালাক্কা প্রনালী এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে বলা হয় এটি হচ্ছে চীনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এটা খুব ভাল মতই জানে ভারত। ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্যকে কাউন্টার করতে ভারত তার পূর্ব উপকূল থেকে মালাক্কা প্রনালী পর্যন্ত নেভিকে শক্তিশালী করছে এবং ভারত চাইলে মালাক্কা প্রনালীকে ব্লক করে পশ্চিম থেকে আসা চীনের তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসের সাপ্লাইকে বন্ধ করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য অনুযায়ী মালক্কা প্রনালী নিয়ে এশিয়ার এই দুই শক্তিশালী দেশের পদক্ষেপ ভবিষ্যতে বড় আন্তর্জাতিক সংকটের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু ভারত কী সত্যিই মালাক্কা প্রনালী ব্লক করতে পারবে? চীন কী ভারতের এই পদক্ষেপকে কাউন্টার করতে পারবে?? চীনের কাছে কী মালাক্কা প্রনালীর বিকল্প কীছু ব্যবস্থা আছে? আজ এসব ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
মালাক্কা সুপ্রাচীন কাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক পথ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর আশেপাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর রয়েছে। প্রাচীন কালে রোমান, গ্রীক, চাইনিজ ও ভারতীয় ব্যাবসায়ীদের জন্য এই পথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সাত থেকে তেরো শতকে শ্রীবিজয়া নামে একটি বৌদ্ধিক সামুদ্রিক ও বানিজ্যিক সাম্রাজ্য এই এলাকাকে নিয়ন্ত্রন করত। নিজের সময়ে শ্রীবিজয়ে অনেক মিলিটারি আক্রমনের হাত থেকে মালাক্কা প্রনালীকে রক্ষা করে এখানের বানিজ্য পথ কে নিরাপত্তা দিয়েছিল। এরপর আসে ভারতের চোল সাম্রাজ্য যারা মালাক্কা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন পুরোপুরি ভারতের পক্ষে এনেছিল। এরপর ধীরে ধীরে মালাক্কাতে একে ও জোহর নামে মুসলিম সুলতানরা রাজত্ব করতে থাকে। তারপর সময়ের আবর্তনে ইউরোপীয়ানরা মালাক্কা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই লড়াই শুরু করে যেমন ১৫১১ সালে পর্তুগীজরা মালাক্কা নিজেদের দখলে আনে আবার ১৬৪০ সালে ডাচ বা নেদারল্যান্ডস পর্তুগালদের হারিয়ে মালাক্কা তাদের অধীনে নিয়ে আসে। এরপর আসে ইংল্যান্ড যারা এই এলাকা পুরোপুরি নিজেরাই নিয়ন্ত্রন করতে থাকে। সিঙ্গাপুরকে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর করে এই এলাকা দিয়ে ব্রিটিশ জাহাজ আফিম নিয়ে দক্ষিন পূর্ব এশিয়া হয়ে চীনে যেত।
১৮২৪ সালে ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে মালাক্কা প্রনালীকে নিয়ে সন্ধি হয়। এরপর উনিশ শতকের মাঝামাঝি নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে, যার কারনে এই এলাকা অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে কিন্তু ১৯৮০ আসতে আসতে আবারও মালাক্কা প্রনালী গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীক পথ হিসাবে পরিচিতি পায়। চীন যত তার সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে ভারতও মালাক্কা প্রানালীকে নিয়ন্ত্রনের জন্য প্রয়জনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। দুবছর আগে ভারত ও চীনের সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ হয়ে গিয়েছিল। লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে দুই পক্ষের সেনাই হাতিহাতিতে জড়িয়ে পড়েছিল, এরও কয়েক বছর আগে ডোকলামেও দুই পক্ষের মধ্যে বিবাদ হয়েছিল। চীন ভারত মহাসাগরে তাদের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে, সাথে সাথে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মায়নমারের মত দেশের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক রেখেছে যা ভারতকে ভাবিয়ে তুলেছে। এজন্য ভারত তাদের নেভিকে ব্যাপক শক্তিশালী করে তুলছে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য মালাক্কা প্রনালীর কাছে লম্বোক ও সুন্দা এলাকায় আশপাশের জাহাজকে ক্রমান্বয়ে ট্রাকিং করছে ভারত এবং ভারতীয় নেভি চাইলে এখানের বানিজ্যিক জাহাজ গুলোকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ঘুরিয়ে দিতে পারে। তারা এটাও বলছে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে মালাক্কা প্রনালীর কাছে অবস্থিত আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে ব্যবহার করে ভারত মালাক্কা প্রনালীকে চীনের জন্য ব্লক করে দিতে পারে। পারস্য উপসাগর, অ্যাঙ্গোলা ও ভেনিজুয়েলা থেকে প্রচুর তেল মালাক্কা প্রনালী হয়েই চীনে আসে। একজন চাইনিজ আধিকারিকদের মধ্যে এই এলাকা নিয়ে একটও ভয় থেকেই থাকে। ২০০৩ সালে তৎকালীন চাইনিজ রাষ্ট্রপতি হু জিনতাও এই পরিস্থিতিকে মালাক্কা ডিলেমা আখ্যা দিয়ে বলে এই এলাকা বিশেষ কীছু শক্তি নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল ভারত ও আমেরিকার দিকে। এই এলাকায় ক্রমাগত ভারতীয় নেভির উপস্থিতি চীনের কপালে ভাজ ফেলেছে এবং ভারত ক্রমাগত তার নেভির উন্নয়ন করো যাচ্ছে। বিখ্যাত নেভাল লেখক এবং হারপুন ওয়ার গেম সিরিজের রচয়িতা ল্যারি বন্ডের দাবি যদি ভারতকে মালাক্কা প্রনালী ব্লক করতেই হয় তবে ভারতকে তাদের যুদ্ধজাহাজ মালাক্কা প্রনালীর সামনে দাড় করাতে হবে।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হচ্ছে ভারতের কারনে বাধ্য হয়ে চীন মালাক্কা প্রনালীর বিকল্প কীছু পথ খুঁজছে। যার একটি হতে পারে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর, যা চীন পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর বা সিপিইসি এর আওতায় তৈরি করা হয়েছে। চীনে পাকিস্তানে ৭.২ বিলিয়ন ডলারের রেলপথ তৈরি করছে যা গোয়াদর, কাশগড় এবং চীনকে যুক্ত করবে। চীন এই বন্দরে তাদের মাল খালাস করে রেলপথে দেশে নিয়ে যেতে পারবে। তবে গোয়াদার বন্দর কে কাউন্টার করার জন্য ভারতীয় বায়ুসেনা যথেষ্ট, এছাড়াও ইন্ডিয়ান নেভিও চাইলে গোয়াদারকে কাউন্টার করতে পারবে। চীনের জন্য আরও একটি বিকল্প হল আর্কটিকের উত্তর সমুদ্র পথ। উত্তর মেরু বা সুমেরুী আশপাশের এলাকা কে আর্কটিক অঞ্চল বলা হয়। এখানে আটলান্টিক মহাসাগর রয়েছে। রাশিয়া, স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ, কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড এই আর্কটিক বলয়ে রয়েছে। চীন এই এলাকায় আশেপাশের দেশ গুলোর সাথে যৌথভাবে একটি পোলার সিল্ক রোড তৈরির চেষ্টা করছে। ২০১৮ সালে এই বিষয়ে চীন তাদের আর্কটিক নীতি প্রকাশ করে। ২০১৩ সালে চীন সর্বপ্রথম এই এলাকায় তাদের জাহাজ পাঠায়। তবে এখানে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে এখানের তীব্র ঠান্ডা, শীতকালে প্রায় তাপমাত্রা মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে চলে যায়। তার সাথে সমুদ্রের কীছু অংশ জমে যায়, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এ কারনে এখানে হিমবাহ গলে বড় বড় বরফের স্তর এখানে সমুদ্রে ভাসতে থাকে। এই জন্য এই এলাকায় বরফ কেটে জাহাজ চলানো তুলনামূলক যথেষ্ট ব্যায়বহুল ও কষ্টসাধ্য। যার জন্য চীন ২০১৮ ফিনল্যান্ডের একের আর্কটিক কোম্পানি থেকে একটি আইসব্রেকার কেনে যার নাম সিউ লং। এছাড়া চীন ইউরোপ পর্যন্ত সরাসরি রাস্তা তৈরির চেষ্টা করছে যার জন্য চীন কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিআরআই বা বর্ডার রোড ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্ট শুরু করেছে। চীন মালাক্কা প্রনালীর কাছে মালয়েশিয়াতে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর এবং ইসতিমাস অফ ক্রাতে একটি ক্যানেল তৈরি করছে যা মালাক্কা প্রনালী কে বাইপাস করবে। তবে চীন যাই করুক বিকল্প পথে বানিজ্য করলে চীনের খরচ অনেকটাই বাড়বে।
ভারতীয় নেভিকে মালাক্কা প্রনালীকে ব্লক করতে হলে, বিশেষ করে চীনের মতো শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে, তাহলে ভারতে শক্তিশালী নেভাল পাওয়ার হতে হবে। ভারতীয় নেভিতে এখনও কীছু গ্যাপ রয়েছে। যেমন ২০১৯ এ জানানো হয় ভারত ২০২৭ এর মধ্যে ভারতীয় নেভিতে ১৭৫ টি জাহাজ থাকবে যেটা প্রথমে থাকার কথা ছিল ২০০ টি। মালাক্কা প্রনালী দিয়ে শুধু চীন বানিজ্য করে না, আমেরিকার অনেক বন্ধু দেশও এখান দিয়ে বানিজ্য করে সুতরাং মালাক্কা প্রনালী কে ব্লক করতে গেলে চীন সহ অনেক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফলে বিষয়টি চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে আন্তর্জাতিক হয়ে যাবে, সেক্ষেত্রে ভারতকে যথেষ্ট চাপে পড়তে হবে। মালাক্কা প্রনালীর পাশে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরেরে সাথে ভারতের যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক আছে, তাই ব্লক করতে গেলে এই সব দেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক খারপ হতে পারে। তবে এর মানে এটা নয় যে ভারত এই এলাকায় নিজের উপস্থিতি রাখতে পারবে না। আসলে ভারত কুটনৈতিক ভাবে বহুদিন ধরেই দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশ সাথে সংযোগ রেখে চলছে যার মধ্যে আসিয়ান দেশ গুলো অন্যতম। ভারত আসিয়ান দেশ গুলোর সাথে রীতিমতো নেভাল এক্সারসাইজ করে যার নাম মিলান। এছাড়া সিঙ্গাপুর ও ভারতীয় নেভির মধ্যে সিমবেক্স এবং সিঙ্গাপুর, ভারত ও থাইল্যান্ড নেভির মধ্যে সিটমেক্স এক্সারসাইজ হয়। ভারত বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড সহ অনেক দেশের সাথেই ভাল সম্পর্ক বজায় রেখেছে। অর্থাৎ সরাসরি যুদ্ধের থেকে কুটনৈতিক ভাবে চীনকে চাপে রাখা। ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতের কাছে সবচেয়ে বড় সুবিধা। ২০০১ সালে ভারত এখানে সেনা, বায়ুসেনা ও নৌসেনার যৌথ কমান্ড তৈরি করছে। আন্দামানের দুটি প্রধান সুবিধা আছে। প্রথমত প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করা কোন জাহজাকে ভারত এখান থেকে নজরে রাখতে পারে। দ্বিতীয়ত এর কাছেই বঙ্গোপসাগর থাকায় ভারতীয় পরমানু সাবমেরিন সহজেই এখানে আসতে পারে। এছাড়া ভারতের কোয়াডের মতন জোট রয়েছে এবং এশিয়ান দেশ গুলোর সমর্থন রয়েছে সুতরাং ভারত চাইলে যৌথভাবে চীনকে কাউন্সিল করতে সক্ষম।