ইরানের ক্ষমতার পেছনেও রয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন। অবাক করা বিষয়
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয় যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্নতা লাভ করে। বর্তমানে চীন, রাশিয়ার মতোন আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ থাকা সত্ত্বেও আক্ষরিক অর্থে বিশ্বে সুপার পাওয়ার দেশ একটাই তা হল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। সিআইএর মতোন ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক এবং অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তির কারনে বাকী সমস্ত দেশের থেকে আমেরিকা অনেক এগিয়ে। সিআইএ বিশ্বের প্রথম দুই শ্রেষ্ঠ ইনটেলিজেন্স সংস্থার একটি। সিআইএর প্রচুর গোপন অপারেশনের মধ্যে একটি হচ্ছে অপারেশন এজেক্স।
১৯৫৩ সালে ইরানে ক্ষমতার পালাবদল হয় একেই বলা হয় অপারেশন এজেক্স। এর পেছনে ছিল আমেরিকা ও ব্রিটেন। যদিও আমেরিকা দীর্ঘদিন এই ঘটনার কথা স্বীকার করেনি তবে ২০১৩ সালে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর তথ্যে পরিস্কার হয়ে যায় ১৯৫৩ সালে ইরানে অপারেশন এজেক্সের পেছনেও আমেরিকা ছিল। তবে অপারেশন এজেক্সে আমেরিকার থেকে বেশী ব্রিটিশদের ভূমিকা ছিল। বহুদিন ধরে ইরানে ব্যবসা করতে করতে অভ্যস্ত ব্রিটিশরা সহজে ইরান ছেড়ে যেতে চাইছিলো না, ১৯৫৩ সালে অপারেশন এজেক্সের সময়ও ব্রিটিশরা চলে যায়নি। শেষপর্যন্ত ১৯৭৯ সালে ইরানে বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশরা চলে যায়।
উনবিংশ শতকে ইরানে সবচেয়ে বেশী প্রভাব ছিল ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের, পরে অবশ্য ইরানে ব্রিটিশ প্রভাবই ছিল সম্পূর্ন। ব্রিটিশরা একটা সময় বিশ্বের বহু দেশকেই উপনিবেশ করেছিল, ঠিক তেমনি উনবিংশ শতকের প্রথমে ইরানেও যায় ব্রিটেন৷ ইরানকে একটা সময় পার্সিয়া বলা হত, ১৯৩৫ সালের পর পার্সিয়া নাম বদলে ইরান আসে। ইরানে তেলের ভান্ডার আছে যার দিকে নজর পড়ে ব্রিটিশদের। ইরান থেকে তেল নেওয়ার জন্য ব্রিটিশরা রীতিমতো তেলের কোম্পানিই তৈরি করে। ১৯০১ সালে পার্সিয়ার কাজার রাজবংশের শাসক মোজাফফর আল দিন শাহ ব্রিটিশ ব্যাবসায়ী উইলিয়াম নক্সের সাথে ৬০ বছরের পেট্রোলিয়াম খোঁজার চুক্তি করে। ১৯০৭ সালে উইলিয়াম নক্স তার অংশ ব্রিটিশ তেল সংস্থা বার্মা তেল সংস্থাকে বিক্রি করে দেয়। পরে ব্রিটেন অ্যাংলো পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানি বা এপিওসি নামে একটি সংস্থা তৈরি করে ইরানে। ব্রিটেন উৎপাদিত তেল থেকে মাত্র ১৬ শতাংশ ইরানকে দিত এবং ৮৪ শতাংশ ব্রিটেন নিজে নিয়ে নিত। এর ফলে ধীরে ধীরে ইরানের সাধারন মানুষ গরীব হতে শুরু করে। ব্রিটিশরা ইরানিদের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসাবে ব্যাবহার করত। সাধারন মানুষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কিছু বলতেও পারতনা কারন ইরানের রাজা স্বয়ং ব্রিটিশদের সমর্থন করত।
১৯০৬ সালে ইরানে পার্সিয়ান সাংবিধানিক বিদ্রোহ হয় যাতে ইরানে সংবিধানের স্থাপনা হয়। কাজার রাজবংশের রাজা ছিল পশ্চিমাপন্থি যার কারনে ইরানে বিদ্রোহ হয়ে সংবিধান স্থাপনা হয় অর্থাৎ রাজা কোন আদেশ দিলে তা প্রথমে সংসদে পাশ হত তারপর কার্যকরী হত। কিন্তু ১৯০৬ সালে ইরানে সংবিধান তৈরির পেছনেও ব্রিটিশদের ভূমিকা ছিল, সংবিধানে এমন ভাবে আইন তৈরি করা হয় যাতে ব্রিটিশরা বেশী সুবিধা পায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইরানে ব্রিটিশ প্রভাব আরও বাড়তে থাকে। ১৯২৫ সালে ইরানের নতুন শাসক হয় রেজা শাহ যে আরও বেশী ব্রিটিশপন্থি ছিল। ইরানে তামাকের একচেটিয়া ব্যাবসা শুরু করে ব্রিটেন। ইরান একটি শিয়া মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ায় অনেক মানুষই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠাতে শুরু করে কারন ব্রিটিশরা ইরানের সংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু ইরানের রাজা ব্রিটিশ পন্থি হওয়ায় সাধারন মানুষের প্রতিবাদে তেমন কোন লাভ হয়নি।
১৯৩৫ সালে রেজা শাহ পার্সিয়া নাম পরিবর্তন করে ইরান রাখে। রেজা শাহ তার বিরুদ্ধে হওয়া সমস্ত বিদ্রোহ কোঠোর হস্তে দমন করতো, ১৯৪০ সালে রেজা শাহ ইরানের গনতান্ত্রিক দল ন্যাশানাল ফ্রন্টের প্রধান মহম্মদ মোসাদ্দেককে জেলে পাঠায় কারন মহম্মদ মোসাদ্দেক ব্রিটিশ বিরোধী প্রচার করতো। ১৯৩৯ সালে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইরান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল কিন্তু তাও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরান আক্রমন করে কারন সোভিয়েতদের তেল দরকার ছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ট্রান্স ইরান রেললাইন তৈরি করে যাতে খুব সহজে ইরান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পর্যন্ত তেল নিয়ে যাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরানে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবি উঠতে শুরু করে। ইরানে রাজা রেজা শাহকে হত্যার চেষ্টাও হয়।
১৯৪৯ থেলে ১৯৫২ অবধি ইরানে বেশ কয়েকবার নির্বাচন হয়, প্রথমে ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয় মহম্মদ মোসাদ্দেক কিন্তু পরে আবার নির্বাচনে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয় জেনারেল আলি রাজমারা কিন্ত তাকে হত্যা করে দেওয়া হয়। এরপর আবার প্রধানমন্ত্রী হয় মহম্মদ মোসাদ্দেক। এবার প্রধানমন্ত্রী হয়েই ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে তিনি একটি আইন পাশ করে জানান ইরানের সমস্ত তেল ভান্ডারের নিয়ন্ত্রন ইরান সরকারের কাছে থাকবে।
ব্রিটিশরা প্রথম থেকেই মহম্মদ মোসাদ্দেকের বিরোধী ছিল তার উপর ইরানের তেল ভান্ডার থেকেও ব্রিটিশদের সরিয়ে দেওয়ায় ব্রিটিশরা ক্ষিপ্ত হয়ে ইরানের উপর বানিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয় অর্থাৎ ইরান কাউকে তেল বিক্রি করতে পারতোনা, সেসময় ব্রিটিশ নৌবাহিনীও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ইরানের সমস্যা ছিল তেল শোধনাগার পরিচালনা করার মতোন দক্ষ লোক তাদের ছিলনা যার কারনে ইরান অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। বাধ্য হয়ে মহম্মদ মোসাদ্দেক ব্রিটিশদের সাথে আলোচনায় বসে এবং তেলের লভ্যাংশের ভাগ অর্ধেক দাবি করে কিন্তু ব্রিটেন সরাসরি জানায় আগের মতোই চলবে অর্থাৎ ৮৪ ভাগ লভ্যাংশ ব্রিটেন নেবে এবং ১৬ ভাগ ইরান পাবে।
মহম্মদ মোসাদ্দেক এই প্রস্তাব বাতিল করে দিয়ে আমেরিকার কাছে সহায়তা চায়। এদিকে ব্রিটেন ইরানে বিদ্রোহের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল করতে আমেরিকার সহায়তা চায়৷ কিন্তু তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি হ্যারি এস ট্রুম্যানস রাজি হয়না ব্রিটিশদের প্রস্তাবে। হ্যারি এস ট্রুম্যানসের আশঙ্কা ছিল আমেরিকা ইরানের বিরোধীতা করলে ইরান সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সাহায্য চাইবে এবং সোভিয়েতের প্রভাব শুরু হবে মধ্য এশিয়ায়। কিন্তু হ্যারি এস ট্রুম্যানের পর আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার ব্রিটিশদের প্রস্তাবে সম্মত হয়, শুরু হয় অপারেশন এজেক্সের পরিকল্পনায়। আমেরিকা তাদের ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ এবং ব্রিটেন তাদের ইনটেলিজেন্স সংস্থা এমআইসিক্সকে কাজে লাগায় ইরানের লোককে মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে। ইরানের তেল ভান্ডারকে জাতীয়করন করার ফলে এবং ব্রিটিশের সরিয়ে দেওয়ায় ইরানে তেল উৎপাদন কমে যায় এবং ইরানের আর্থিক ক্ষতি হয় যার কারনে মানুষ গরীব হয়ে যায়। এটাকেই কাজে লাগায় সিআইএ এবং এমআইসিক্স। ১৯৫৩ সালের ১০ জুন বেইরুটে সিআইএ এবং এমআইসিক্স এজেন্টরা অপারেশন এজেক্স শুরু করবার আগে অন্তিম পর্যায়ের বৈঠক করে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার অপারেশনের সবুজ সংকেত দিয়ে দেয়। প্রোপাগান্ডা ছড়াতে শুরু করে সিআইএ, আমেরিকার প্রথম সারির কাগজে মহম্মদ মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে প্রচার হতে থাকে। ইরানে রীতিমতো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷ মহম্মদ মোসাদ্দেকের সমর্থক গোষ্ঠী ও বিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়। ইরানে এত বিশাল বিক্ষোভ, হিংস্র দাঙ্গা হয় যে বহু মানুষের মৃত্যু হয়।
রেজা শাহ ঘোষনা করে মহম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে বলা হয় রেজা শাহের এই বক্তব্য লিখে দিয়েছিল সিআইএ। রেজা শাহ ব্রিটেনের সাহায্যে মহম্মদ মোসাদ্দেকে ক্ষমতা থেকে হটানোর চেষ্টা করে কিন্তু প্রথম প্রচেষ্টা ব্যার্থ হওয়ায় রেজা শাহ বাগদাদ পালিয়ে যায়৷ তবে দ্বিতীয় চেষ্টায় আমেরিকা ও ব্রিটেন সফল হয় মহম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলতে। আমেরিকা ও ব্রিটেনপন্থি জেনারেল জাহিদিকে ইরানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা করা হয়।