ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ইসরায়েলের থেকেও বেশী শক্তিশালী হতে চলেছে!
বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ ভারতবর্ষ। পাকিস্তান ও চীনের মতো প্রতিবেশী থাকার কারনে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত নিজেকে সামরিক ভাবে শক্তিশালী গড়ে তুলছে প্রতিনিয়ত। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তত থাকতে এবং আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার জন্য ভারত নিজস্ব প্রযুক্তিতে লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করছে। এই মহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে চলা ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধকে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক সমস্যা বলা হচ্ছে। এই যুদ্ধে ইসরায়েলের তৈরি আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তার কার্যকারিতা বারবার প্রমান করছে সফল ভাবে। হামাস ও হিজবুল্লাহের ছোঁড়া রকেট বারংবার ধ্বংস করছে আয়রন ডোম সিস্টেম। ভারত যে নতুন লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করছে তাকে ভারতের নিজস্ব আয়রন ডোম সিস্টেম বলা হচ্ছে যা ২০২৮- ২০২৯ এর মধ্যে ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত হবে।
ভারতের কাছে বর্তমানে নিজস্ব তৈরি লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নেই, ভারত রাশিয়ার তৈরি এস ৪০০ লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ব্যবহার করে আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য। ২০১৮ সালে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে পাঁচ রেজিমেন্ট এস ৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের চুক্তি হয়, এগুলোই লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হিসাবে ব্যবহার হয় বর্তমানে। ইতিমধ্যেই তিন ইউনিট এস ৪০০ ভারতে চলে এসেছে বাকী দুই ইউনিট রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য আসতে দেরী হচ্ছে।
হামাস ইসরায়েল যুদ্ধে আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সাফল্যতা ইসরায়েলকে নিশ্চিত অনেক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছে। যদিও গত ৭ অক্টোবর হামাসের মিসাইল হামলায় ও আক্রমনে প্রায় এক হাজারের বেশী সাধারন ইসরায়েলি নাগরিকের প্রান গেছে। হামাস গত ৭ অক্টোবর একসাথে পাঁচ হাজার রকেট ছোঁড়ে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে গাজাপট্টি থেকে যার অধিকাংশ আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংস করে দিয়েছিল কিন্ত একসাথে এত রকেট আটকানো সম্ভব নয় যার কারনে বেশ কিছু রকেট ইসরায়েলের ভূখন্ডে আঘাত করে ও বহু মানুষের মৃত্যু হয়। তবে আয়রন ডোম সিস্টেম না থাকলে এর থেকেও বহুগুন ক্ষতি হত ইসরায়েলের। পুরো আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে রয়েছে রেডার সিস্টেম যা ইসরায়েলের দিকে আগত মিসাইল, রকেটকে খুঁজে বের করে, দ্বিতীয় ভাগে থাকা কন্ট্রোল ইউনিট রকেটের গতিপথকে বিশ্লেষন করে আয়রন ডোমকে নির্দেশ দেয় কোন রকেট গুলোকে ধ্বংস করতে হবে।
হামাস ও হিজবুল্লাহ ইসরায়েল লক্ষ্য করে আনগাইডেড রকেট ফায়ার করে এদের মধ্যে অনেক রকেটই ইসরায়েলের এমন জায়গায় আঘাত করার সম্ভবনা থাকে যেখানে জনবসতি নেই, সেইসব রকেট গুলো আয়রন ডোম সিস্টেম ধ্বংস করেনা। কারন আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমে ব্যবহৃত হওয়া তামির মিসাইলের প্রচুর দাম, এক একটি তামির মিসাইলের দাম প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলার, সেই তুলনায় হামাসের একটি আন গাইডেড রকেটের দাম ৩০০ থেকে আটশো ডলার। একবার কন্ট্রোল ইউনিট নির্দেশ দিয়ে দেওয়ার পর তৃতীয় ভাগে থাকা আয়রন ডোম লঞ্চারের তামির মিসাইল আকাশেই ইসরায়েলের দিকে আগত রকেটকে ধ্বংস করে দেয়। এই আয়রন ডোম সিস্টেমের মতোই ভারত নিজস্ব প্রযুক্তিতে লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরির জন্য একটি প্রজেক্ট শুরু করেছে যার নাম দেওয়া হয়েছে প্রজেক্ট কুশা।
ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা ডিআরডিও এই প্রজেক্টের দায়িত্বে রয়েছে। এই প্রজেক্টে ২১,৭০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হতে সময় লাগবে ২০২৮- ২০২৯ সাল। এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রুজ মিসাইল, স্টেলথ যুদ্ধবিমান, ড্রোনকেও ধ্বংস করতে সক্ষম হবে। ভারতের এই নতুন লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ইসরায়েলের আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের থেকেও শক্তিশালী হবে এবং রাশিয়ার এস ৪০০ এবং আমেরিকার প্যাট্টিয়ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হবে। এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সার্ভিসে এলে আত্মনির্ভর ভারতের জন্য একটি বড় মাইলফলক হবে।
ডিআরডিও এর তৈরি এই লং রেঞ্জ সারফেস টু এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বা এলআর স্যাম সিস্টেমের রেডার ১৫০ কিলোমিটার, ২০০ কিলোমিটার এবং ৩৫০ কিলোমিটার দূর থেকেই টার্গেটকে খুঁজে নিয়ে লঞ্চারকে নির্দেশ দেয় মিসাইল ফায়ার করার। এই সিস্টেমের একটি মিসাইল ফায়ারে সম্ভাব্য টার্গেট ধ্বংসের নিশ্চয়তা ৮০ শতাংশ এবং পরপর দুটি মিসাইল ফায়ার করা হলে সম্ভাব্য টার্গেট ধ্বংসের নিশ্চয়তা ৯০ শতাংশ। এই সিস্টেমে ব্যবহৃত সারভিলেন্স রেডার ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও নিশ্ছিদ্র করে তুলবে। এলআর স্যামের রেডার ভারতের অন্যান্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের রেডারের সাথে সংযুক্ত করে একটি সংযুক্ত এয়ার কম্যান্ড এবং কন্ট্রোল সিস্টেম তৈরি করা সম্ভব হবে। ইসরায়েলের আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের ভারতীয় ভার্সন এই এলআর স্যাম নিশ্চিত ভাবেই ভারতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে।
এই প্রজেক্ট সফল হলে ভারত আমেরিকা, রাশিয়া, ইসরায়েল, চীন, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মতো গুটি কয়েক দেশের মধ্যে হবে যাদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি দীর্ঘ পাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে। ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু পাকিস্তান ও চীন। বিশেষ করে চীনের বিরুদ্ধে ভারতের লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দরকার। চীন নিজেও রাশিয়ার এস ৪০০ সিস্টেম ব্যবহার করে এবং চীন নিজস্ব প্রযুক্তিতে বেশ কিছু এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করেছে যদিও সেগুলো এস ৪০০ এর মতো আধুনিক নয়।
২০২০ তে ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষের পর থেকেই ভারত ও চীনের কুটনৈতিক সম্পর্কে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। চীন প্রায়ই তাদের মানচিত্রে আকসাই চীন এবং অরুনাচল প্রদেশকে তাদের অংশ হিসাবে দেখায়। চীন পাকিস্তানের সবচেয়ে ভালো বন্ধু এবং পাকিস্তানকে প্রচুর সমরাস্ত্র বিক্রি করে যার কারনে ভবিষ্যতের দ্বিমুখী যুদ্ধের কথা ভেবে ভারতের এলআর স্যামের মতোন প্রজেক্ট খুবই দরকারী।
ভারতের এলআর স্যাম ইসরায়েলের তৈরি আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের থেকে আধুনিক হবে। আয়রন ডোম একটি শর্ট রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যার রেঞ্জ ৭০ কিলোমিটার। অন্যদিকে এলআর স্যাম একটি লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যার ভিন্ন ভিন্ন টার্গেটের ক্ষেত্রে রেঞ্জ আলাদা। যুদ্ধবিমান ধ্বংসের ক্ষেত্রে এলআর স্যামের রেঞ্জ ২৫০ কিলোমিটার এবং এয়ার রিফিউলারের ক্ষেত্রে এলআর স্যামের রেঞ্জ ৩৫০ কিলোমিটার। যেখানে আয়রন ডোম সিস্টেম রকেট, আর্টিলারি সিস্টেম, ছোট ড্রোন সিস্টেম ধ্বংস করতে সক্ষম সেখানে ভারতের এলআর স্যাম ক্রুস মিসাইল, যুদ্ধবিমান ধ্বংস করতেও সক্ষম। এলআর স্যামের সবচেয়ে বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে এটি স্টেলথ টার্গেট ধ্বংস করতেও সক্ষম যা আয়রন ডোম পারেনা।