পৃথিবী

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইয়ামেনের হুথী বিদ্রোহীদের। যুদ্ধ বিরাট আকার ধারন করবে

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বে আবারও একটি রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে ইসরায়েল হামাসের যুদ্ধের মাধ্যমে। ইসরায়েলের জন্মলগ্ন থেকেই আরব দেশগুলো ইসরায়েল বিরোধী এবং একাধিক বার আরব দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের যুদ্ধও হয়েছে কিন্ত প্রতিবারই শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে আরব দেশগুলো। যার কারনে বর্তমানে বেশীরভাগ আরবদেশই সরাসরি ইসরায়েলের বিরোধীতা করেনা। বিগত দুই দশকে প্যালেস্টাইনের গাজাপট্টিতে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে হামাস, যাদের লক্ষ্য ফিলিস্তিনের ভূমি ইসরায়েলের থেকে পুনরুদ্ধার করা। এই সংগঠনই গত ৭ অক্টোবর অতর্কিত ভাবে ইসরায়েল আক্রমন করে যাতে এক হাজারের বেশী ইসরায়েলি নাগরিকের মৃত্যু হয়। এই হামাসকে আমেরিকা ও ইউরোপীয় সংগঠন সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে ঘোষনা করেছে। হামাসের আক্রমনের পরই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহু হামসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে, তারপর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম তিন সপ্তাহ ধরে গাজাপট্টিতে ক্রমান্বয়ে বোম্বিং করে যাচ্ছিল ইসরায়েলের বায়ুসেনা। তবে গত ৩-৪ দিন ধরে গাজাপট্টিতে সেনা অভিযান শুরু করে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। ইরান বহুদিন ধরেই ইসরায়েলের সেনা অভিযানের বিরোধীতা করে আসছিল। ইরান ইসরায়েলকে গাজাপট্টিতে সেনা অভিযানের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিল। সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারনা ইসরায়েলের সেনা অভিযানকে কেন্দ্র করে পশ্চিম এশিয়ায় দীর্ঘকালীন অস্থিরতা তৈরি হতে চলেছে।

ইসরায়েল গাজাপট্টিতে সেনা অভিযান শুরু করেছে এবং হামাস সদস্যদের গোপন আস্তানা খুঁজে খুঁজে ধ্বংস করছে। এরই বিরুদ্ধে ইরান এবার ছায়াযুদ্ধ শুরু করেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। ইয়ামেনের হুথী বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে, এই হুথী বিদ্রোহীদের সহায়তা করছে ইরান। ইসরায়েল থেকে ইয়ামেনের দূরত্ব প্রায় ১৯০০ কিলোমিটার, মাঝে সৌদি আরব, জর্ডান ও লোহিত সাগর রয়েছে। এত দূর থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে হুথীরা। লোহিত সাগরের একপাশে রয়েছে সৌদি আরব এবং অন্যদিকে মিশর ও সুয়েজ খাল। সৌদি আরব ও মিশরকে আলাদা করেছে আকাবা উপসাগর যা লোহিত সাগরেরই একটি অংশ। এই আকাবা উপসাগরের শেষপ্রান্তে জর্ডান ও ইসরায়েলের সীমানা রয়েছে। আকাবা উপসাগরের তীরে দক্ষিন ইসরায়েলের প্রথম শহর ইলাত, এর ঠিক পাশেই রয়েছে জর্ডানের আকাবা বন্দর। এই ইলাত শহর লক্ষ্য করেই ব্যালিস্টিক মিসাইল ফায়ার করে হুথী বিদ্রোহীরা ইয়ামেন থেকে। তবে ইলাত শহরে পৌঁছানোর আগেই মিসাইল ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েলের অ্যারো এয়ারডিফেন্স সিস্টেম। 

ইসরায়েল জানিয়েছে হুথীদের মিসাইল তাদের আকাশ সীমায় পৌঁছানোর আগেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সাধারনত সবসময় ইসরায়েলের আয়রন ডোম এয়ারডিফেন্স সিস্টেমের কথাই শোনা যায় তবে আয়রন ডোম শর্ট রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, অ্যারো লং রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। ইসরায়েলের কাছে বেশ কয়েক প্রকারের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে যা ইসরায়েলকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা প্রদান করে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহু জানিয়েছে ইরান সম্ভবত সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়ামেন ও ইরাক থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছায়া যুদ্ধ চালাতে পারে যার ফলে এই যুদ্ধ আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে। যদিও হুথীদের কাছে যেসব মিসাইল আছে তাতে ইসরায়েলের তেমন কিছু ক্ষতি হবেনা কারন ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী। তবে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়ামেন থেকে ইসরায়েল লক্ষ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে মিসাইল আসে তাহলে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও সমস্যায় পড়তে পারে, ঠিক এটাই হয়েছিল গত ৭ অক্টোবর যখন হামাস ইসরায়েল লক্ষ্য করে প্রায় পাঁচ হাজার রকেট ফায়ার করেছিল, আয়রন ডোম সিস্টেম অধিকাংশ রকেট ধ্বংস করলেও বেশ কিছু রকেট ইসরায়েলে এসে আঘাত হানে যাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রীতিমতো ছায়াযুদ্ধ শুরু করেছে ইরান। প্যালেস্টাইনের হামাস, ইয়ামেনের হুথী এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ নামক সংগঠনকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে ইরান, আবার সিরিয়া সীমান্তেও সেনা পাঠানোর হুমকী দিয়েছে ইসরায়েলকে ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরেই সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, ইরান বহুদিন ধরেই চায় মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে কিন্ত ইরানের সেই রাস্তায় সবচেয়ে বড় বাধা সৌদি আরব। আমেরিকার সাহায্যে আধুনিক অস্ত্র ও যুদ্ধবিমানে সুসজ্জিত সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা বাহিনী। যার কারনে ইরান সরাসরি সৌদি আরবের সাথে লড়াই না করে ইয়ামেনে হুথীদের মাধ্যমে ছায়া যুদ্ধ চালায় সৌদি আরবের সাথে। ইয়ামেনের হুথী বিদ্রোহীরা সৌদি আরব ও আমেরিকারও বিরোধী। প্রায়ই সৌদি আরবের বিমানবন্দর, তৈল শোধনাগার লক্ষ্য করে রকেট  ফায়ার করে হুথীরা। দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের সাথে হুথীদের বিবাদ রয়েছে। সৌদি আরব মূলত সুন্নি মুসলিম অধুষ্যিত দেশ এবং ইরান শিয়া মুসলিম দেশ। ইসলাম ধর্মে শিয়া সম্প্রদায় সংখ্যালঘু। শিয়া মুসলিমদের একটি বড় অংশ রয়েছে ইরাকে এবং আজারবাইজানে। ইয়ামেনেও শিয়া সম্প্রদায়ের একটি বড় জনগোষ্ঠী আছে। পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত ইয়ামেন দেশটার ৯৯ শতাংশ জনসংখ্যাই ইসলাম ধর্মের। ইয়ামেনে ৬৫ শতাংশ সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের এবং ৩৫ শতাংশ শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে। 

২০১৫ সালের পর থেকে ইয়ামেন দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ইয়ামেনের বেশীরভাগ অঞ্চলে হুথীদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। হুথী নিয়ন্ত্রিত ইয়ামেনের রাজধানী সানা এবং অন্য অঞ্চলের রাজধানী এডেন যাকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে। শিয়া সম্প্রদায়ের একটি বিভাগ হচ্ছে জায়েদি। হুথীরা এই জায়েদি সম্প্রদায়ভুক্ত। ইয়ামেনের শিয়া সম্প্রদায় ইরাক ও ইরানের শিয়া সম্প্রদায়ের থেকে খানিকটা আলাদা। একটা সময় উত্তর ইয়ামেনে শক্তিশালী ছিল জায়েদিরা। ইয়ামেনে এক হাজার বছর ধরে জায়েদি সুলতানদের শাসন ছিল। ১৯৬২ সালে শেষ জায়েদি সুলতান ইমাম আহমেদের হত্যা হয়ে যাওয়ার পর দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায়। ১৯৬২- ৭০ সালে ইয়ামেনে হওয়া গৃহযুদ্ধে জায়েদিদের ক্ষমতা অনেকাংশে কমে যায় । 

১৯৮০ সাল থেকে ইয়ামেনে সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতায় সুন্নি সম্প্রদায়ের প্রভাব বাড়ছিলো ইয়ামেনে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করবার জন্য হুসেন বাদরেদ্দিন আল হুথী নামে এক ব্যাক্তি ১৯৯০ সালে হুথী গোষ্ঠী তৈরি করে। ২০০৪ সালে ইয়ামেন সেনাবাহিনী আল হুথীকে হত্যা করে তার পর থেকেই তার অনুগামীরা ইয়ামেনের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহের নাম দেওয়া হয় হুথী বিদ্রোহ এবং আল হুথীর অনুগামীদের হুথী বিদ্রোহী বলা হতে থাকে। ২০০৪ থেকে ২০১০ এর মধ্যে হুথী বিদ্রোহী এবং ইয়ামেন সরকারের মধ্যে ছয়টি বড় সংঘর্ষ হয়। ইয়ামেন সরকারকে আমেরিকা ও সৌদি আরব সহায়তা করে। তখন থেকে এই হুথীরা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ করে আসছে। কিন্ত শেষপর্যন্ত ২০১০ সালে ইয়ামেন সরকার বাধ্য হয় হুথীদের সাথে সন্ধি করতে। 

২০১৪ সালে হুথীরা বিদ্রোহ করে ইয়ামেনের রাজধানী সানা ঘিরে ফেলে এবং দেশটির রাষ্ট্রপতি আবদরাব্বুহ মনসুর হাদীকে ২০১৫ সালে ক্ষমতাচ্যুত করে। আবদরাব্বুহ মনসুর হাদী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ২০১৫ সাল থেকে ইয়ামেনের অধিকাংশ অঞ্চল হুথীদের নিয়ন্ত্রনেই রয়েছে। হুথীরা নিজেদের ইয়ামেনের আসল শাসক হিসাবে ঘোষনা করেছে। লোহিত সাগরে ইয়ামেনের একটি বন্দর এবং ইয়ামেনের উত্তর পার্বত্যঞ্চল হুথীদের নিয়ন্ত্রনে আছে, এখান থেকেই সৌদি আরবের উপর আক্রমন করে হুথীরা। সৌদি আরব মিসাইল ফায়ার করলেও হুথীদের তেমন কোন ক্ষতি হয়না কারন ইয়ামেনের উত্তরে পার্বত্য অঞ্চল প্রাকৃতিক ঢাল হিসাবে কাজ করে হুথীদের। এখন এই হুথীরা প্যালেস্টাইনের হামাসের পক্ষে যোগ দিয়েছে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। এই হামাস এবং হুথী উভয়কেই অস্ত্র এবং অর্থ সাহায্য করে ইরান। 

ইয়ামেনের হুথীরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করায় সমস্যায় পড়েছে সৌদি আরব। বিগত এক বছর ধরে সৌদি আরব ও ইয়ামেনের মধ্যে শান্তি রয়েছে, গত এক বছরে হুথীরা সৌদি আরবে আক্রমন করেনি। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এই অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে। হুথীরা ইয়ামেনের একদম উত্তরাঞ্চল থেকে ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে ব্যালিস্টিক মিসাইল ফায়ার করছে। ইয়ামেনের উত্তারাঞ্চল থেকে ইসরায়েলের দূরত্ব প্রায় ১৯০০ কিলোমিটার, মাঝখানে সৌদি আরব ও জর্ডান রয়েছে। হুথীদের মিসাইল সৌদি আরবের আকাশসীমা দিয়েই ইসরায়েলের দিকে যাচ্ছে। মাঝখানে কোন জায়গায় লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলে সৌদি আরবে সেই মিসাইল হামলার সম্ভবনা রয়েছে যার কারনে সৌদি আরবও চিন্তিত হয়ে পড়েছে। হুথীদের হামলার পরেই ইসরায়েলের একটি যুদ্ধজাহাজ ইয়ামেনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। ইতিমধ্যেই ভূমধ্যসাগরে আমেরিকার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার গ্রুপ ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড মোতায়েন রয়েছে। আমেরিকা আগেই সব দেশকে সতর্ক করেছিল ইসরায়েল হামাস যুদ্ধে অন্য কোন দেশ যেন না জড়ায়, স্বাভাবিকভাবেই এবার ইয়ামেনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারে আমেরিকা। ইসরায়েল হামাস যুদ্ধ ধীরে ধীরে একটি ঘাতক যুদ্ধের রূপ নিচ্ছে যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.