রোমাঞ্চকর সিনেমাও হার মানাবে পুতিনের জীবনকাহিনী
রাজেশ রায়:– সময়টা ১৯৯১-৯২ এর, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়, ছোট ছোট অনেক দেশ তৈরি হয়। এই সময় রাশিয়া জুড়ে ব্যাপক দুর্নীতি, মাফিয়ারাজ শুরু হয়। নতুন রাশিয়ান প্রসিডেন্ট বরিস ইয়ালসেন ও দুর্নীতিবাজ ছিলেন। ঠিক এমন সময় সামনে এসে ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন রাশিয়া কে অর্থনৈতিক ভাবে, রাজনৈতিক দিক দিয়ে অনেক শক্তিশালী তৈরি করে। এই মহূর্তে পুতিন বিশ্বের অন্যাতম শক্তিশালী লিডার বলা হয়। এটাও বলা হয় ভ্লাদিমির পুতিন এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড়লোক ব্যাক্তি এলন মাস্কের থেকেও কিন্তু পুতিন কোনওদিন সব তথ্য প্রকাশ করে নি। এক সময় গরীব, বেকার থাকা পুতিন নিজের ক্ষমতায় রাশিয়ান ইনটেলিজেন্স এজেন্সি(গুপ্তচর সংস্থা) কেজিবির এজেন্ট হন সেখান থেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন। পুতিন যে সময় রাজনীতিতে আসেন তখন জার্মানির বার্লিন ওয়াল ভেঙে গিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানও এক হয়ে যায়। কিন্তু ১৯৯১ এ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়ে ১৫ টি দেশ তৈরি হয় যার শোক কোনওদিন ভুলতে পারে নি পুতিন, সেইসময় একে “গ্রেটেস্ট ট্রাজেডি ” বলেন। বলা হয় পুতিনের কাছে ২০ টি প্যালেস, ৪৩ টি বিমান ও ১৫ টি হেলকপ্টার আছে কিন্তু এব্যাপারে সঠিক কোন তথ্য কেউ জানে না।
১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লেলিনগ্রাদ শহরে ওনার জন্ম হয়। এই শহরে ১৯১৭ সালে লেলিন বিপ্লবের সূচনা করেছিল যার জন্য এই শহরের নাম লেলিনগ্রাদ, বর্তমানে এই শহরের নাম সেন্ট পিটার্স বার্গ। পুতিনের আরও দুই ভাই ছিল পিটার ও অ্যালবার্ট যারা পুতিনের জন্মের আগেই মারা যায়। পুতিনের বাবা একজন যোদ্ধা ছিল যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার হয়ে অসাধারণ যুদ্ধ করেছিলেন, তিনি রাশিয়ান সাবমেরিনে কাজ করতেন। পুতিনের মা একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। পুতিনের পরিবার লেলিনগ্রাদে একটি ছোট ঘরে থাকতেন। ছোট থেকে পুতিন তেমন কোন সুযোগ সুবিধা পান নি। মাত্র ১৬ বছর কেজিবির অফিসে যান। তিনি অত্যন্ত সিনেমা দেখতে ভালবাসেন, স্পাই, ইনটেলিজেন্স মুভি ছোট থেকেই দেখতেন যার জন্য তার মনে স্পাই বা গুপ্তচর হওয়ার তীব্র ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বয়স কম হবার জন্য কেজিবি অফিসাররা তখন তাকে ফিরিয়ে দেয়।
সাত বছর পর আইনের ডিগ্রি পুরন করে তিনি আবার কেজিবির সাথে যুক্ত হন। পুতিন পড়াশোনার পাশাপাশি জুডো প্রাকটিস করতেন। তার ব্ল্যাক বেল্টও আছে। অত্যন্ত ধুরন্ধর বুদ্ধির অধিকারী পুতিন লোককে ইমপ্রেস করতে সিদ্ধহস্ত কেজিবিতে থাকার সময়ই তিনি এ বিদ্যা রপ্ত করেন। এরজন্য তিনি সমস্ত বিশ্ব লিডারদের সহজেই ইমপ্রেস করে ফেলেন। প্রাক্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ পর্যন্ত পুতিনকে দেখে ইমপ্রেস হয়েছিলেন। তবে একমাত্র হিলারি ক্লিন্টনই পুতিনকে পচ্ছন্দ করত না। পুতিন মস্কোর সবচেয়ে ভাল কেজিবি স্কুলে ভর্তি হন। এরপর তাকে পোস্টিং দেওয়া হয় জার্মানি তে। সেইসময় জার্মানি দুইভাগে ভাগ ছিল পূর্ব জার্মানি যার নিয়ন্ত্রণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে এবং পশ্চিম জার্মানির নিয়ন্ত্রণ ছিল আমেরিকার হাতে।
১৯৬১ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মাঝে বার্লিন ওয়াল ছিল। ১৯৮৯ সালে এই দেওয়াল ভাঙ্গা হয়। সেই সময় জার্মানির লোক রাশিয়ান ইনটেলিজেন্স এজেন্সি কেজিবির উপর ক্ষেপে ছিল, বার্লিন ওয়াল ভাঙ্গার সময় প্রায় এক হাজার লোক কেজিবির অফিস ঘিরে ফেলে বলে ভেতরে যারা আছে তাদের সবাইকে হত্যা করা হবে। ভেতরে তখন পুতিন একা ছিল। পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত গোপন নথি পুড়িয়ে দিয়ে শান্ত ভাবে বাইরে বেড়িয়ে ভিড়ের সামনে গিয়ে বলে ভেতরে রাশিয়ার বন্দুকধারী কম্যান্ডো আছে যদি কেউ ভেতরে যায় বাঁচবে না। পুতিনের এই একটি ট্রিকে সব ভিড় ফাঁকা হয়ে যায়। ভাবুন আপনি পুতিনের জায়গায় থাকলে কী করতেন? কতটা ঠান্ডা মাথার ভাবুন।
বার্লিন ওয়াল ভেঙে যাবার পর ২ বছরের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়ে ১৫ টি দেশ তৈরি হয়:– রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, কিরঘিসস্তান, মলডোবা, তাজাখিস্তান, তুর্কমিনিস্তান, উজবেকিস্তান, এস্তোনিয়া, লাটাভিয়া, লিথুয়ানিয়া কাজখিস্তান। এই সমস্ত দেশের মানুষরা বিদ্রোহ শুরু করে তাদের দাবি ছিল তাদের সমস্ত টাকা মিলিটারির খাতে ব্যায় করা হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত সুবিধা রাশিয়া একা ভোগ করে বাকী ১৪ টি দেশ তেমন সুবিধা পায় না। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গোর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দিয়ে ১৫ টি দেশ তৈরি করে। এই ঘটনা ভ্লাদিমির পুতিনের মনে তীব্র প্রভাব ফেলে। তিনি পূর্ব জার্মানি থেকে সেন্ট পিটাসবারগে চলে আসেন। কিন্ত মনে মনে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেই পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নের মতন বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করার। রাশিয়া তৈরি হওয়ার পর তার প্রেসিডেন্ট হন বরিস ইয়ালসেন, প্রায় অর্ধ পাগল এই ব্যাক্তি রাশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম খারাপ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বরিস ইয়ালসেন যে সময় প্রেসিডেন্ট হন সেসময় রাশিয়ার সাধারণ মানুষ অত্যন্ত গরীর ছিল তার শাসনকালে মাফিয়া রাজ, অপরাধমূলক কাজকর্ম অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। রাশিয়ার সাধারণ মানুষ আরও গরীব হতে শুরু করে। তাই দরকার ছিল বরিস ইয়ালসেনের বিকল্প। ততদিনে ভ্লাদিমির পুতিন ধীরে ধীরে রাজনীতিতে আসতে শুরু করেন। মার্চ, ১৯৯৭ এ প্রেসিডেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসের ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ নিযুক্ত হন এবং কন্ট্রোল ডিরেক্টরের প্রধান হন। জুলাই, ১৯৯৮ এ তিনি ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের ডিরেক্টর হন। মার্চ, ১৯৯৯ এ তিনি রাশিয়ান ফেডারেশনের সিকিউরিটি কাউন্সিলের সিকিউরিটি হন। বরিস ইয়ালসেনের উপর ক্রমশ চাপ বাড়ছিল এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ক্রমশ বাড়তে থাকে যার জন্য বাধ্য হয়ে বরিস ইয়ালসেন ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে ভ্লাদিমির পুতিন কে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। কিন্তু সেই বছরই ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়ালসেন পদত্যাগ করেন তখন ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার অ্যাক্টিং প্রেসিডেন্ট হন। অবশেষে ২০০০ সালের ৭ মে ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
পুতিন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হবার সময় অনেক মানুষ বিরোধিতা করে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তাদের সবাইকে হয় জেলে ভরা হয় না হয় তারা উধাও হয়ে যান। এটা শুধু ইঙ্গিত ছিল ভবিষ্যত দিন কেমন হতে চলেছে, পুতিন কেমন ভাবে রাশিয়া শাসন করতে চলেছে? পুতিনের নামে বলা হয় তিনি একজন একনায়ক তন্ত্রে বিশ্বাসী, স্বৈরাচারী শাসক, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ তা প্রমান করতে পারেন নি। আজ পর্যন্ত বহু মানুষ চেষ্টা করেছিল তার বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ জোগাড় করতে কিন্তু তারা কেউই জীবিত থাকে নি।
পুতিনের জীবনে অন্যতম বড় ঘটনা হল চেচিনিয়ার যুদ্ধ। চেচেনিয়াতে দুটো যুদ্ধ হয়েছিল। প্রথমে চেচেনিয়া সম্পর্কে একটু জানা যাক। চেচেনিয়া নর্থান ককেশাস অঞ্চলে একটা প্রদেশ যারা সবসময় বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এমনকী পনেরো শতকে অটোম্যান তুর্কী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও।
১৯৫৭ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হন নিকিতা ক্রুশ্চেভ তিনি চেচেনিয়াদের ১৯৫৮ সালে অনেক স্বাধীনতা দেন। কিন্তু ১৯৯০-৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর অন্যান্য অনেক দেশের মতন চেচেনিয়া ও স্বাধীনতা ঘোষনা করে। সেখানে রীতিমতো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। রাশিয়ার সেনা ১৯৯৪ সালে চেচেনিয়া তে প্রবেশ করে। যাকে চেচেনিয়ার প্রথম যুদ্ধ বলা হয়। উভয়পক্ষের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হয় যাতে অন্তত এক লক্ষ মানুষ মারা যায়। অবশেষে ১৯৯৬ সালে খাশিয়াভুরুত চুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধ শেষ হয় রাশিয়া সেখানে নিজেদের সংবিধান চালু করে। কিন্ত ১৯৯৬ সালের ১৬ নভেম্বর রাশিয়ার রাজধানী মস্কো তে সিরিয়াল বোম্বিং হয়। এরপর রাশিয়া তে মাঝেমাঝেই চেচেনরা আক্রমন করতে থাকে।
১৯৯৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মস্কোর একটি বিল্ডিং এ বিস্ফোরণ হয় যাতে প্রায় ৬৮ জন লোক মারা যায়, মোট তিনটি বোম্ব বিস্ফোরণ হয় এবং চার নম্বর বোম্ব ডিফিউজ করে রাশিয়ান সেনা। সবাইকে বলা হয় চেচেনরা এই বোম্ব লাগিয়েছে কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটা রাশিয়ান সিক্রেট সার্ভিস কেজিবির প্ল্যান যার নেপথ্যে ছিল ভ্লাদিমির পুতিন। আসলে পুতিনের লক্ষ ছিল পুরো চেচেনিয়া দখল করা কিন্ত হঠাৎ করে তো কাউকে আক্রমণ করা যায় না তার জন্য কারন লাগে। সেইজন্য এই পরিকল্পনা। এরপর রাশিয়ান সেনা চেচেনিয়া আক্রমণ করে। হেলিকপ্টার, মিসাইল সব চালানো হয়, পূর্ণ শক্তিতে চেচেনদের দমন করে চেচেনিয়ার পূর্ন ক্ষমতা নিজের হাতে নেয়। এই যুদ্ধ পুতিমকে রাতারাতি রাশিয়ার জনগনের সামনে জাতীয় বীর তৈরি করে এবং তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়ে যান।