পৃথিবী

আর্মেটিসের মন্দিরের মতো প্রাচীন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য

সভ্যতার বিবর্তনে মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রতিটি যুগেই এমন কিছু অসাধারন স্থাপত্য নির্মান করা হয়েছে যা মানুষকে মুগ্ধ করে দেয়, এসব স্থাপত্য দেখে মনে হয় এরকম স্থাপত্য আর কোনওদিনও নির্মান করা সম্ভব হবেনা। ২০০৭ সালের হিসাবে চীনের মহা প্রাচীর, জর্ডানের পেত্রা, রোমের কলোসিয়াম, মেক্সিকোর চিচেন ইতজা, পেরুর মাচুপিচু, ভারতের তাজমহল এবং ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অবস্থিত ক্রাইস্ট দ্য রিদিমারের মূর্তিকে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য বলে ঘোষনা করা হয়। আধুনিক বিশ্বের এই সপ্তম আশ্চর্যের মতো প্রাচীন কালেও এরকম সাতটি স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়।

১) অলিম্পিয়ার জিউসের মূর্তি:— প্রাচীন গ্রীসে সমস্ত দেবতার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হত জিউসকে। গ্রীক পূরানে জিউসকে আকাশ ও বজ্রের দেবতা বলা হয়েছে। গ্রীসে জিউসের অনেক মন্দির রয়েছে তবে অলিম্পিয়াতে তৈরি জিউসের মন্দির ছিল সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই মন্দিরে জিউসের বিশাল মূর্তিকে রাজ সিংহাসনে বসানো দেখানো হয়েছে। ৪২ ফুট উঁচু এই মূ্র্তি ফডিয়াস নামক এক গ্রীক শিল্পী তৈরি করেছে খ্রীস্টপূর্ব ৪৩৫ সালে। এই মূর্তিতে জিউসের এক হাতে একটি দেবী মূর্তি রয়েছে যিনি বিজয়ের প্রতীক এবং অন্য হাতে একটি লম্বা লাঠি রয়েছে যার মাথায় একটি ইগলের মূর্তি রয়েছে। জিউসের এই মূর্তি নির্মানে সোনা সহ অনেক মূল্যবান ধাতু ব্যবহার করা হয়েছিল এবং অসংখ্য রত্ন দ্বারা সুসজ্জিত ছিল এই মূর্তি। প্রাচীন গ্রীস অলিম্পিয়ার এই মন্দির গ্রীকদের জন্য তীর্থস্থল ছিল। বলা হয় পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান আক্রমনে এই অলিম্পিয়ার মন্দির ও জিউসের মূর্তি ধ্বংস হয়ে যায় এবং মূল্যবান সমস্ত রত্ন চুরি হয়ে যায়। 

২) ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান:— বর্তমান ইরাকেই অবস্থিত ছিল অতীতের ব্যাবিলন। খ্রীস্টপূর্ব ৬০০ সালে ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর তীরে তৈরি এই ঝুলন্ত উদ্যান তৎকালীন সময়ের কারিগরি বিদ্যার অসাধারন নিদর্শন। ব্যাবিলনের রাজা নেবুচাদনেজার দ্বিতীয় তার স্ত্রী অ্যামিটিসের কথায় এই উদ্যান নির্মান করান। মেডেসের রাজকুমারী অ্যামিটিসেট তার নিজের প্রদেশের সুন্দর পার্বত্য এলাকা ও মোনোরম উদ্যানগুলির কথা বারবার মনে পড়ছিলো ব্যাবিলনে সেজন্য রাজা নেবুচাদনেজার দ্বিতীয় এই উদ্যান নির্মান করান। মাটি থেকে আশি ফুট উচ্চতায় এই উদ্যান নির্মান করতে চার হাজার শ্রমিক কাজ করেছিলো। পাঁচ থেকে ছয় হাজার ফুলের গাছ ছিল এই বাগানে। বলা হয় এক হাজার জনের বেশী মালী এই বাগানে ফুলের পরিচর্যার দায়িত্বে ছিল। এই সুন্দর উদ্যান ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনেও দুটি মতবাদ আছে, প্রথম মতবাদ অনুযায়ী ভূমিকম্পে এই উদ্যান ধ্বংস হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় মতবাদ অনুযায়ী ৫১৪ সালে পারস্যের সাথে যুদ্ধে এই বাগান ধ্বংস হয়ে যায়। 

৩) আর্মেটিসের মন্দির:— প্রাচীন এই গ্রীক মন্দির দেবী আর্মেটিসের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল। গ্রীক পুরানে আর্টেমিসকে শিকার, বন্য প্রানী, প্রকৃতি, গাছপালা, সন্তান জন্মদান, শিশুদের যত্নের দেবী বলা হয়েছে। এই মন্দির ডায়নার মন্দির নামেও পরিচিত ছিল। খ্রীস্টপূর্ব ৫৫০ সালে এই মন্দির তৈরি করা হয়েছিল  এফিয়াস অঞ্চলে যা বর্তমান তুরস্কের সেলকাক শহরের কাছে। কোনও কোনও জায়গায় এই মন্দিরকে প্রাচীন গ্রীসের সবচেয়ে বড় মন্দির বলা হয়েছে। গ্রীসে সর্বত্র আর্মেটিসের মন্দির ছিল অতীতে। ১১৩ মিটার লম্বা ও ৪৫ মিটার চওড়া এই মন্দির নির্মানে দশ বছর সময় লেগেছিল। এই মন্দিরে ১২৭টি স্তম্ভ ছিল। মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি এই মন্দিরের দেওয়ালে অসংখ্য মূল্যবান রত্ন ছিল। আর্মেটিসের মন্দির প্রাচীন গ্রীসের স্থাপত্যকার্যের এক অসাধারন নিদর্শন ছিল। গ্রীসের অন্যান্য ধার্মিক স্থানের মতো এই মন্দিরও তীর্থস্থান ছিল গ্রীসের মানুষদের কাছে। বলা হয় ৩৫৬ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে এই মন্দির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। তুরস্কে এখনও এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। বলা হয় যেদিন এই মন্দিরে অগ্নিকান্ড হয় সেদিন গ্রীসে এক বাচ্চার জন্ম হয় যে পরবর্তী কালে গ্রীসের মহান সম্রাট আলেকজান্ডার দি গ্রেট নামে পরিচিত হয়। আলেকজান্ডার এই মন্দিরের পুননির্মান করেন, তবে কালের পরিবর্তনে এই মন্দির আবারও ধ্বংস হয়ে যায়। 

৪) আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর:— গ্রীসের রাজা আলেকজান্ডার দি গ্রেট অনেক বিখ্যাত শহর তৈরি করেছিলেন যার মধ্যে একটি হল মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া। অতীতে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত বন্দর শহর ছিল ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এই আলেকজান্দ্রিয়া শহর। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার একজন সেনাপতি টলেমি নিজেকে মিশরের শাসক হিসাবে ঘোষনা করে। তখন থেকেই মিশরে টলেমাইক রাজবংশের শাসন শুরু হয়। মিশরের শাসক দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফাসের শাসনকালে প্রায় ১১৮ মিটার উচ্চ একটি বাতিঘর নির্মান করা হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়াতে। তৎকালীন সময়ে এত উচ্চ স্থাপত্য খুব কমই ছিল। মিশরে এই বাতিঘরকে আলেকজান্দ্রিয়ার ফারোস নামেও ডাকা হত।

১৩২৩ সাল পর্যন্ত তিনবার ভূমিকম্প এই বাতিঘরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যা পুননির্মান করা হয় পরে। তবে শেষপর্যন্ত ১৪৮০ সালে এই বাতিঘরটি সম্পূর্নভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে একটি ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক দল এই বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়। 

৫) হ্যালিকারনাসাসের সমাধি:— প্রাচীনকালে সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে সবচেয়ে কম জনপ্রিয় এই হ্যালিকারনাসাসের সমাধিক্ষেত্র। ৩৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পারস্যের আচেমেনিড সাম্রাজ্যের একজন গভর্নর মোসোলাস হ্যালিকারনাসাস শহরে এই সমাধিক্ষেত্র তৈরির আদেশ দেয়। বর্তমানে এই হ্যালিকারনাসাস শহর তুরস্কের বোদরাম শহরের অংশ। আচেমেনিড সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ন শাসকদের মৃতদেহ সমাধির জন্য এই সমাধিক্ষেত্র নির্মান করা হয়। মোসোলাসের মৃত্যুর পর তার পত্নি আর্টিমিসিয়া দ্বিতীয় এই সমাধিক্ষেত্র তৈরি করান। এই সমাধিক্ষেত্র তৈরি করেছিল কাঠামোটি গ্রীক স্থপতি স্যাটিরোস এবং পিথিয়াস অফ প্রিন। ১৪৮ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মার্বেল পাথরে তৈরি এই সমাধিক্ষেত্র তিনটি স্তরে বিভক্ত ছিল। সমাধিক্ষেত্রটিট মাথায় পিরামিডাকৃতির ৫০ ফুট উচ্চ বিশাল গম্বুজ ছিল। এই সমাধিক্ষেত্রটির ধ্বংস হওয়া নিয়ে বিতর্ক আছে। একটি মতবাদ অনুযায়ী গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার দি গ্রেট তুরস্ক আক্রমনের সময় এটি ধ্বংস করে দেয়। আবার আরেকটি মতবাদ অনুযায়ী ভূমিকম্পে এটি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং এর ধ্বংসাবশেষ দিয়ে স্থানীয় মানুষজন বাড়ি তৈরি করেছে। যার কারনে হ্যালিকারনাসাসের সমাধিক্ষেত্রের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়নি তেমন।

৬) রোডসের মূর্তি :— গ্রীসের রোডস দ্বীপে রোডস শহরে গ্রীসের সূর্যের দেবতা হেলিয়সের একটি বিশাল মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল রোডসের বিজয়ের প্রতিকৃতি হিসাবে। ম্যাসিডনের শাসক ডিমিট্রিয়াস প্রথম বিশাল নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনী নিয়ে রোডস আক্রমন করে আনুমানিক ২৯২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। মিশরের শাসক টলেমির সমর্থনে রোডসের সেনা ডিমিট্রিয়াসের বিশাল সেনাকে পরাজিত করে এবং সূর্যের দেবতা হেলিয়সের বিশাল মূর্তি তৈরি করে বিজয়ের কৃতজ্ঞতা জানাতে। চার্লস নামে এক স্থপতি বারো বছর ধরে এই মূর্তি নির্মান করেছিল। ত্রিশ মিটার লম্বা এই বিশাল মূর্তি দূর থেকেই সমুদ্রের নাবিকরা দেখতে পেত যা দেখে তারা সহজেই রোডস পৌঁছে যেত। ২২৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে একটি ভূমিকম্পে এই মূর্তি ধ্বংস হয়ে যায়। বাইজান্টিয়ান ঐতিহাসিক জন মালালাস তার বইয়ে লিখেছেন রোমান সম্রাট হ্যাডরিয়ান পরবর্তীকালে এই মূর্তি পুননির্মান করার চেষ্টা করলেও তিনি ভুল মূ্র্তি তৈরি করেছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে বেশ কয়েকবার রোডসে এই মূর্তি পুননির্মানের দাবী উঠলেও তা এখনও নির্মান করা সম্ভব হয়নি। মূর্তিটির রোডসে অতীতে ঠিক কোন জায়গায় তৈরি করা হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। 

৭) গিজার পিরামিড :— একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও মিশরের পিরামিড আজও রহস্যময় বস্তু আমাদের কাছে। মিশরে যত পিরামিড আছে তার মধ্যে গিজার পিরামিডগুলি সবচেয়ে বড়। মিশরের শাসকদের ফারাও বলা হত, এই পিরামিডে ফারাওদের মৃতদেহ মমি করে সমাধি করা হত। মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে ২৫ কিলোমিটার দক্ষিন পশ্চিমে নীলনদের তীরে গিজাতে মোট তিনটি পিরামিড রয়েছে খুফুর পিরামিড, খাফরে এর পিরামিড এবং মেনকৌরে এর পিরামিড। এদের মধ্যে খুফুর পিরামিড সবচেয়ে বড় যেটি ১৪৭ মিটার লম্বা। 

আজ থেকে প্রায় ৪,৫০০ বছর আগে এসব পিরামিড তৈরি করা হয়েছিল। খুফুর পিরামিড তৈরিতে তিন লাখ পাথরের ব্লক ব্যবহার করা হয়েছিল যার প্রতিটির ওজন ছিল দুই টন। প্রায় এক লাখ মানুষ ২০ বছর ধরে এই পিরামিড নির্মান করেছিল। আজ থেকে ৪,৫০০ বছর আগে ১৪৭ মিটার উচ্চতায় দুই টন ওজনের পাথরের ব্লক তোলা হয়েছিল যা সত্যিই তৎকালীন মিশরের কারিগরি দক্ষতার অসাধারন নিদর্শন। খুফুর পিরামিডের ঠিক সামনেই একটি মূর্তি রয়েছে যার দেহটা সিংহের মতো এবং মুখ মানুষের মতো যার নাম স্ফিংস। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মূর্তি এই স্ফিংস।

Leave a Reply

Your email address will not be published.