আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে প্রাকৃতিক এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কেন বলা হয়?
রাজেশ রায়:— বিশ্বের সমস্ত দেশের মধ্যে সামরিক দিক দিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। যার জন্য আমেরিকাকে সুপার পাওয়ার দেশ বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আমেরিকার এই সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয়। কোন দেশ যে সামরিক দিক দিয়ে সুপার পাওয়ার তার মাপদন্ড কী? এর উত্তর হবে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। এই মহূর্তে আমেরিকার কাছে ১১ টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আছে যা বিশ্বের কোন দেশের কাছে নেই। এই ১১ টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের মধ্যে ১০ টি নিমিতজ ক্লাস ক্যারিয়ার ও ১ টি জেরাল্ড আর ফোর্ড ক্লাস ক্যারিয়ার। যদি বিশ্বের বাকী দেশ গুলোর কথা বলা হয় তাহলে ভারতের দুটো, চীনের তিনটে, রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের একটি করে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে। আমেরিকার ১১ টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারই পরমানু শক্তি চালিত যেখানে বাকী দেশ গুলোর মধ্যে একমাত্র ফ্রান্সের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার পরমানু শক্তি চালিত। আমেরিকার এক একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে প্রায় ৮০ টি করে যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থাকতে পারে যেখানে বাকী দেশ গুলোর ক্যারিয়ারে মোটামুটি ৪০-৫০ টি করে যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থাকতে পারে। সুতরাং এতক্ষন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কেন আমেরিকাকে সুপার পাওয়ার বলা হয়? যে দেশের নেভির কাছে যত বেশী এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে সেই দেশ তত বেশী শক্তিশালী। কিন্তু একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার পরিচালনা করতে অনেক খরচ, শক্তিশালী অর্থনীতি না থাকলে সেই দেশের পক্ষে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার পরিচালনা করা অনেকটা সাদা হাতি পোষার মতন। ভারতের কাছে এই মহূর্তে দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে। তবে জানেনকী আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে ভারতের প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বলা হয়!! এর সাথে লাক্ষাদ্বীপও গুরুত্বপূর্ন। এব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
সম্প্রতি ভারত কেরালার কোচিন শিপইয়ার্ডে তৈরি তার নিজস্ব তৈরি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আইএনএস বিক্রান্ত লঞ্চ করেছে। ভারতের দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে আইএনএস বিক্রমাদিত্য যা রাশিয়া থেকে ক্রয় করা হয়েছিল এবং আইএনএস বিক্রান্ত যা ভারত নিজেই তৈরি করেছে। বিক্রান্তের গতি ১৮ নট। ১ নট= ১.৮ কিলোমিটার প্রায় অর্থাৎ ১৮ নট মানে ৩৩ কিলোমিটার। আইএনএস বিক্রান্তে ৩৪ টি যুদ্ধবিমান বা হেলিকপ্টার থাকতে পারবে। যুদ্ধবিমান হিসাবে মিগ-২৯ কে, কামোভ -৩১ হেলিকপ্টার, এম এইচ ৬০ রোমিও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হবে এতে। এই পুরো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারটি তৈরি করতে ২০,০০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এটি ২৬২ মিটার লম্বা ও ৫০ মিটার উঁচু বা ১৮ তলা বাড়ির সমান উঁচু। এর আগেও ১৯৬১ সালে ভারতের আইএনএস বিক্রান্ত নামে একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ছিল তা ২০১৪ সালে অবসরে যায়। তারই সম্মানে এই নতুন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি করা হয়। মূলত শত্রুর নেভির উপর আক্রমন করতে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের কোন বিকল্প নেই। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বেশীরভাগ সময়েই আন্তর্জাতিক জলসীমায় থাকে। যদি ভারত মহাসাগরের কোন স্থানে ভারত তার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দাঁড় করে দেয় তাহলে চীন অন্তত দশ বার ভাববে আক্রমন করতে। কারন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার শুধু একা থাকে না এর সাথে থাকে যুদ্ধবিমান, ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট, সাবমেরিন, সাবমেরিন হান্টার হেলিকপ্টার অর্থাৎ সবমিলিয়ে একটি ডেডিকেটেড ক্যারিয়ার ব্যাটেল গ্রুপ থাকে।
ভারত মহাসাগরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ও লাক্ষাদ্বীপের অবস্থান স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের মূল ভূখন্ড ও দক্ষিন এশিয়ান দেশ গুলোর পুরো মাঝে অবস্থিত এই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। বিশ্বের বেশীরভাগ বানিজ্য সমুদ্রপথেই হয়। ইন্দোনেশিয়া ও মালেশিয়ার মাঝে একটি সংকীর্ণ রাস্তা আছে যাকে মালাক্কা প্রনালী বলা হয়, প্রতিবছর এখান দিয়ে প্রায় ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয়। এছাড়া এখানে চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল ও এনার্জি পরিবহন হয়। আর ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এই মালাক্কা প্রনালীর খুব কাছে অবস্থিত যার জন্য আন্দামান স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভারতের জন্য। আন্দামানকে মালাক্কা প্রনালীর প্রবেশদ্বার বলা হয়। ভারতের মূল ভূখন্ড চেন্নাই থেকে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভারতের সবচেয়ে বড় দ্বীপপুঞ্জ এটি। গত ১৫ শতক ধরে এটি ভারতের অংশ। শুধু যে বর্তমানকাল তা নয় অতীতেও এই আন্দামান গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি কেন্দ্র ছিল ভারতের। দক্ষিন ভারতের চোল সাম্রাজ্যের সম্রাট রাজেন্দ্র চোলের সময়ে এটি গুরুত্বপূর্ণ নেভাল বেস ছিল। এখান থেকেই চোলরা ইন্দোনেশিয়ার শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আক্রমন করত। পরে ইউরোপীয়ানদের ভারত আক্রমনের প্রথমে ডেনমার্ক, তারপর পর্তুগাল এবং শেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হয় এটি। ব্রিটিশদের সময় আন্দামান কালাপানি নামে কুখ্যাত ছিল। আন্দামানের সেলুলার জেলে ভারতীয় বিপ্লবীদের বন্দি করত ব্রিটিশরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আজাদ হিন্দ ফৌজ এটি দখল করেছিল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত ১৮৬ টি দ্বীপ বিশিষ্ট আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ২২০০ বছরের পুরোনো কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে প্রায় ৩০০০০ বছর ধরে এখানে প্রস্তর যুগের মানুষ বসবাসের প্রমান আছে এখানে যার উদাহারন আন্দামানের নিষিদ্ধ দ্বীপ সেন্টিন্যাল দ্বীপ যেখানে এখনও প্রস্তর যুগের মানুষ বসবাস করে।
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ইন্দোনেশিয়া থেকে মাত্র ৯০ নটিক্যাল মাইল এবং মায়ানমার থেকে ২২ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থিত। ইন্দোনেশিয়ার এত কাছে অবস্থিত হওয়ার জন্য ১৯৬৫ সালে এটি দখল করবার চিন্তা করেছিল ইন্দোনেশিয়া যার জন্য ১৯৬৫ এর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল ইন্দোনেশিয়া। তবে বর্তমানে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। ইন্দোনেশিয়া তাদের সাবাং বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ভারতকে, যা ভারত মহাসাগরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন স্ট্রাটেজিক অবস্থান। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জন্য ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ২০০১ সালে বিশেষ আন্দামান নিকোবর কম্যান্ড তৈরি করে যা ভারতের বায়ুসনা, স্থলসেনা ও নৌসেনার মিলিত কম্যান্ড। ২০০১ সাল থেকে এখানে ১৪-১৫ টি যুদ্ধজাহাজ থাকত কিন্তু বর্তমানে এর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩০, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসাবে ২০১৪ সাল থেকে আন্দামানের ব্যাপক আধুনিকরন করা হচ্ছে। এই অঞ্চলের জন্য প্রতিবছর আলাদা প্রতিরক্ষা বাজেট থাকে। এখানে ভারতীয় বায়ুসেনার সুখোই ৩০ এমকেআই বিমান, ভারতীয় নেভির মিগ-২৯ কে যুদ্ধবিমান রয়েছে। তাছাড়া সাবমেরিন হান্টার পি-৮ আই বিমানও এখানে রয়েছে। এখানে একাধিক এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করা হয়েছে ও হচ্ছে। যার জন্য আন্দামানকে ভারতের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বলা হয় যা কোনওদিন ডুববে না।
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ভারতের মোতায়েন করা সুখোই-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান ও ব্রাহ্মস মিসাইল শত্রুর বুকে ভয় ধরানোর জন্য যথেষ্ট। গত কয়েক বছর ধরে আন্দামানের আশেপাশে চীনের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে বিশেষ করে আন্দামানের উত্তর দিকে কোকো দ্বীপে যা মায়ানমারের নিয়ন্ত্রনে আছে সেখানে চীনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কারন মালাক্কা প্রনালী চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ চীনের ৮০ শতাংশ তেল, ৫০ শতাংশ এলএনজি এই অঞ্চল দিয়েই যায়, তাই যদি ভারত এই মালাক্কা প্রনালী ব্লক করে দেয় তাহলে চীনকে ঘুরে অন্যপথ দিয়ে যেতে হবে যাতে চীনের অন্তত ৮০ বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর অতিরিক্ত খরচ হবে। আন্দামান নিকোবরে ভারতীয় নেভির তিনটি এয়ারবেস আছে। আইএনএস উৎকর্ষ, আইএনএস বাজ এবং আইএনএস কোয়াসা। ২০১৯ সালে আইএনএস কোয়াসা তৈরি করা হয়েছে। মূলত সাদা ইগলের উপর ভিত্তি করে এই নাম রাখা হয়েছে। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলোতে এই বিখ্যাত সাদা ইগল পাওয়া যায়। নেভাল এয়ার স্টেশন শিবপুরের নাম পরিবর্তন করে আরও কিছু আধুনিকরন করে আইএনএস কোয়াসা তৈরি করা হয়েছে। আইএনএস উতকর্ষ অবস্থিত পোর্ট ব্লেয়ারে, এখানে ১০,০০০ ফুট লম্বা রানওয়ে রয়েছে, এর একদিকে রয়েছে পাহাড় যার জন্য এখানে বিমান ল্যান্ডিং একটু অসুবিধা জনক। দক্ষিন আন্দামানে ক্যাম্পবেল খাড়ির পাশে আইএনএস বাজ অবস্থিত। আইএনএস বাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারন এখান থেকে মালাক্কা প্রনালী মাত্র ১০০ নটিক্যাল মাইল বা ১৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যদি আইএনএস বাজকে ভবিষ্যতে আইএনএস বিক্রান্তের জন্য স্থায়ী বেস করে দেওয়া হয় তবে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম সামুদ্রিক পথ মালাক্কা প্রনালীকে ব্লক করে দিতে সক্ষম হবে। আইএনএস বাজে ৩০০০ ফুট লম্বা রানওয়ে আছে কিন্তু ভারতীয় নেভি ১০,০০০ ফুট লম্বা রানওয়ে তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে।
১৯৮০ সাল থেকে অনেকবার ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে আন্দমান দ্বীপপুঞ্জকে পুরোপুরি মিলিটারাইজ করবার জন্য, কিন্তু এমন করলে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ান দেশ গুলো বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে, কারন তারা ভাববে ভারত তার ক্ষমতার বলে মালাক্কা প্রনালী নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে। তাছাড়া এই অঞ্চল পুরোপুরি মিলিটারাইজ করলে বাস্ততন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে। ২০১৫ সালে ভারত সরকার আন্দামানের পর্যটন শিল্প ও বাস্তুতন্ত্রের রক্ষার জন্য ১০,০০০ কোটি টাকার প্রজেক্ট শুরু করেছে। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মতই লাক্ষাদ্বীপে ভারতীয় নেভির বেস রয়েছে আইএনএস দ্বীপরক্ষক ও কাভারত্তি দ্বীপ। কর্নাটকের কারওয়ারে ভারতীয় নৌবাহিনীর সবচেয়ে বড় নেভাল বেস তৈরির কাজ চলছে যাকে প্রজেক্ট সী বার্ড বলা হয়। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় নেভাল বেস এখানে তৈরি হচ্ছে। আইএনএস কাদম্বা বেস এখানেই রয়েছে। আইএনএস বিক্রমাদিত্য এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের হোম বেস এই কদম্বাতে। আইএনএস বিক্রান্তের হোম বেস এখনও ঠিক হয়নি, তবে সম্ভবত চেন্নাইয়ের কাঠপুতলি বন্দর হতে পারে। ভারত মহাসাগরে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক পথ আছে মালাক্কা প্রনালী, হরমুজ প্রনালী, বাব এল মান্দাব এবং মোজাম্বিক চ্যানেল, ভারতের দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আছে যদি আরও দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ভারত তৈরি করে তাহলে পুরো ভারত মহাসাগরে ভারতের প্রভাব থাকবে।