ভারত

জাপান থেকে কোন শ্রেনীর ট্রেন কিনছে ভারতবর্ষ?

ভারতে বুলেট ট্রেন শুরু করতে বহুদিন ধরেই চেষ্টা করছে ভারত সরকার। লক্ষ্য ছিল ২০২২-২৩ এর মধ্যে ভারতে বুলেট ট্রেন শুরু করা কিন্তু কিছু জটিলতার কারনে তা সম্ভব হয়নি। তবে এবার জাপান থেকে বুলেট ট্রেন কিনতে চলেছে ভারত। ভারত প্রথমে জাপান থেকে ছয়টি বুলেট ট্রেন কিনবে। এই চুক্তি মার্চ মাসের মধ্যেই সম্পূর্ন হয়ে যাবে। ভারত জাপান থেকে ছয়টি ই৫ শ্রেনীর বুলেট ট্রেন কিনতে চলেছে, জাপানে এই বুলেট ট্রেনকে সিনকানসেন বলা হয়। 

ন্যাশানাল হাই স্পিড রেল কর্পোরেশন লিমিটেড বা এনএইচএসআরসিএল এসব বুলেট ট্রেন কেনা ও ভারতে বুলেট ট্রেন শুরু করার দায়িত্বে রয়েছে। যখন ভারতে বুলেট ট্রেন প্রজেক্ট শুরু হয় তখন ঠিক করা হয়েছিল ভারত জাপান থেকে আাঠারোটি বুলেট ট্রেন কিনবে। তবে বর্তমানে প্রাথমিকভাবে ছয়টি বুলেট ট্রেন কেনা হবে। এই ই৫ শ্রেনীর ট্রেনগুলোর দাম সম্পর্কে এখনও সঠিক ভাবে জানা যায়নি, তবে যখন আঠারোটি বুলেট ট্রেন কেনবার কথা হয়েছিল তখন ট্রেনের দাম সাত হাজার কোটি টাকা ঠিক করা হয়েছিল অর্থাৎ এক একটি বুলেট ট্রেনের দাম ৩৯০ কোটি টাকা ছিল।

গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের মধ্যে তৈরি হওয়া এই বুলেট ট্রেন প্রজেক্টকে সরকারি ভাবে মুম্বাই আমেদাবাদ হাইস্পিড রেল করিডর বলা হয়। ২০০৯-২০১০ সালের রেল বাজেটে মুম্বাই আহমেদাবাদ উচ্চগতির রেলপথ সহ আরও পাঁচটি উচ্চগতির রেলপথের কথা ঘোষনা করা হয়। তবে সেসময় পুনে থেকে মুম্বাই হয়ে আহমেদাবাদ পর্যন্ত ৬৫০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। রেলওয়ে কর্মকর্তারা এই প্রজেক্ট বৃদ্ধি করে ব্যাঙ্গালোর পর্যন্ত বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় রেলওয়ের সাথে ফ্রান্সের রেলওয়ের অধীনস্থ একটি সংস্থা এসএনসিএফ বা ন্যাশনাল সোসাইটি অফ ফ্রেঞ্চ রেলরোডসের একটি মৌ চুক্তি হয় মুম্বাই আমেদাবাদ উচ্চগতির রেলওয়ে প্রজেক্টের জন্য। তবে মার্চ, ২০১৩ সালে রেলওয়ে বিভাগ পুনে থেকে মুম্বাই পর্যন্ত রেলপথ নির্মানের বদলে সরাসরি মুম্বাই থেকে আহমেদাবাদ পর্যন্ত উচ্চগতির রেলপথ নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৩ সালের জাপানের সাথেও এই প্রজেক্টের জন্য মৌ চুক্তি করে ভারত। চুক্তি অনুযায়ী ঠিক হয় পরবর্তী আঠারো মাসের মধ্যে অর্থাৎ জুলাই, ২০১৫ সালের মধ্যে ভারত ও জাপান যৌথভাবে এই প্রজেক্টে রূপরেখা তৈরি করবে এবং এই পথে ট্রেনের গড় গতিবেগ হবে ৩০০ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে জাপানের প্রতিনিধিরা ভারতে আসে এবং তখনই ঠিক হয় মুম্বাইয়ের বান্দ্রা কুর্লা কমপ্লেক্স থেকে আহমেদাবাদ পর্যন্ত মুম্বাই, থানে, ভিরার, বোইসার, ভাপি, বিলিমোরা, সুরাট, ভারুচ, ভাদোদরা, আনন্দ/নদিয়াদ, আমেদাবাদ এবং সবরমতি এই বারোটি স্টেশন থাকবে যার মধ্যে আটটি স্টেশনই গুজরাটে হবে। 

২০১৪ সালের মে মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রজেক্টকে সরকারি ভাবে অনুমোদন দেন। সার্ভে করে দেখা যায় এই প্রকল্পের জন্য বেসরকারি, সরকারি, বন ও রেলওয়ের জমিসহ মোট ১৪৩৪.৪ হেক্টর জমির প্রয়োজন হবে। তবে বর্তমানে এই প্রজেক্টের জন্য সম্পূর্ন জমি অধিগ্রহন হয়ে গেছে। ২০২৩ সালে এই ট্রেন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হতে পারে ২০২৬ সাল নাগাদ। ২০২৬ সালের জুন জুলাই মাসে গুজরাটে বুলেট ট্রেনের যাত্রা শুরু হতে পারে। এই বুলেট ট্রেন মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মধ্যে যাত্রা সময়কে অনেক কমিয়ে আনবে যার কাজ বর্তমানে চলছে। এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আরও বুলেট ট্রেন প্রজেক্ট শুরু করা হবে। মুম্বাই আহমেদাবাদ এই হাইস্পিড রেল প্রজেক্টে সর্বমোট ১.২৫ লাখ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এই প্রজেক্টের জন্য ৮০ শতাংশ অর্থ ভারত জাপানের জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি বা জিকা থেকে ঋন হিসাবে নিচ্ছে। জিকা ভারতকে ৮৮,০০০ কোটি টাকা মাত্র ০.১ শতাংশ সুদে ঋন দিচ্ছে। ভারত পনেরো বছর পর থেকে পরবর্তী পঞ্চাশ, ষাট বছরের মধ্যে এই ঋন শোধ করবে। 

ভারত ও জাপানের মধ্যে মজবুত কুটনৈতিক সম্পর্কের কারনে জাপান নামমাত্র সুদে ভারতকে ঋন দিচ্ছে। ভারতে এই বুলেট ট্রেন শুরু করবার জন্য জাপান নিজেও আগ্রহী কারন জাপান এর আগে আমেরিকাতে তাদের সিনকানসেন প্রজেক্ট শুরু করতে চেয়েছিল কিন্তু আমেরিকার সাথে সেই চুক্তি ভেস্তে যায়। বর্তমানে জাপানের বাইরে একমাত্র তাইওয়ানই জাপানি প্রযুক্তির বুলেট ট্রেন চলে্ সেজন্য জাপান ভারতে সফল ভাবে এই প্রজেক্ট শুরু করতে চাইছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী এই প্রজেক্টের ৪০ শতাংশ সম্পূর্ন হয়েছে যার মধ্যে গুজরাটে ৪৮.৩ শতাংশ এবং মহারাষ্ট্রে ২২.৫ শতাংশ সম্পূর্ন হয়েছে। মহারাষ্ট্রে কাজ এত কম হওয়ার প্রধান কারন পূর্বের মহারাষ্ট্র সরকারের সময়ে এই প্রজেক্টে যথেষ্ট দেরী হয়, তবে বিজেপির নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্ডে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে মহারাষ্ট্রে এই প্রজেক্টে গতি এসেছে। 

গতবছর এই সম্পূর্ন রেলপথের ২৫০ কিলোমিটার পিয়ার, ১০০ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট এবং মহারাষ্ট্রের দিকে ছয়টি সেতু নির্মান সম্পূর্ন হয়ে গেছে। বুলেট ট্রেন যাওয়ার জন্য পিলার নির্মান করে তার উপর বিশেষ রেলপথ নির্মান করা হয়, এই রেলপথকে ভায়াডাক্ট বলে এবং নীচের স্তম্ভগুলোকে পিয়ার বলে। মুম্বাই আমেদাবাদ রেলপথের গুজরাটের অংশে কুড়িটি সেতু নির্মান করা হচ্ছে যার মধ্যে সাতটি সেতু নির্মান সম্পূর্ন হয়ে গেছে। গুজরাট থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত ৫০৮ কিলোমিটার লম্বা রেলপথে দুই ধরনের বুলেট ট্রেন চালানো হবে, একটি ট্রেন সব স্টেশনে দাঁড়াবে এবং আরেকটি ট্রেন বিশেষ কিছু স্টেশনে দাঁড়াবে। আমেদাবাদ থেকে মুম্বাইয়ের মাঝে বারোটি গুরুত্বপূর্ন স্টেশন রয়েছে যেমন ভাদোদরা, ভারুচ, সুরাট, আনন্দ, থানে ইত্যাদি, এরকম অবস্থায় সব স্টেশনে দাঁড়াতে গেলে সময় অনেক বেশী লাগবে তাই দুই ধরনের ট্রেন চালানো হবে। এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হলে বিশেষ বুলেট ট্রেনে মুম্বাই থেকে আহমেদাবাদ পৌঁছাতে মাত্র দুই ঘন্টা সময় লাগবে এবং আরেক ধরনের ট্রেনে ২:৪৫ ঘন্টা সময় লাগবে। 

বর্তমানে আহমেদাবাদ দুরন্ত এক্সপ্রেস কোন মধ্যবর্তী কোনও স্টেশনে না দাঁড়িয়ে ১৩০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিতো মুম্বাই সেন্ট্রাল থেকে সরাসরি আহমেদাবাদ পৌঁছাতে সময় নেয় ছয় ঘন্টা পনেরো মিনিট। সুতরাং বুলেট ট্রেন শুরু হয়ে গেলে মুম্বাই থেকে আহমেদাবাদ পৌছাঁতে বর্তমানের তুলনায় তিনগুন সময় কম লাগবে।

ভারত জাপান থেকে ই৫ শ্রেনীর যে সিনকানসেন ট্রেনগুলোকে কিনছে এগুলি তৈরি করেছে জাপানের হিটাচি ও কাওয়াসাকি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ। ২০০৯ সাল থেকে ই৫ শ্রেনীর ট্রেন নির্মান শুরু হয়। ২০১১ সালের ৫ মার্চ ই৫ সিনকানসেন ট্রেন চলাচল প্রথম শুরু হয় জাপানে। এখনও পর্যন্ত ৫১টি ই৫ শ্রেনীর ট্রেন তৈরি করেছে জাপান। ২৫৩ মিটার লম্বা এই ট্রেনগুলো জাপানের অসাধারন প্রযুক্তির নিদর্শন। ই৫ শ্রেনীর সিনকানসেন গুলির সর্বোচ্চ গতি ৩২০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা কিন্ত ভারতে প্রথমে ২৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিতে চালানো হতে পারে, পরে ধীরে ধীরে ট্রেনের গতি বাড়ানো হবে। ই৫ ট্রেনগুলো তার বিশেষ এরোডায়নামিক ডিজাইনের কারনে উচ্চ গতিতেও স্থিতিশীল থাকে। ই৫ সিনকানসেনে ডিরেলমেন্ট সিস্টেম রয়েছে অর্থাৎ এই ট্রেন রেলপথ ছেড়ে বেরোবেনা। ই৫ সিনকানসেনে স্বয়ংক্রিয় ব্রেকিং প্রযুক্তি রয়েছে। তাছাড়া নিরাপত্তার বিচারে জাপানি বুলেট ট্রেন প্রযুক্তি সবার উপরে। জাপানি বুলেট ট্রেনের তুলনায় চীনের বুলেট ট্রেনের দাম কম হলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিক দিয়ে জাপানি ট্রেনগুলো চীনের বুলেট ট্রেনের থেকেও শ্রেষ্ঠ। আপাতত ভারত ছয়টি ই৫ বুলেট ট্রেন কিনছে জাপান থেকে ভবিষ্যতে আরও বুলেট ট্রেন কেনা হবে। 

বুলেট ট্রেন নিয়ে ভারত ও জাপানের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী জাপান ভারতকে সিনকানসেন প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে যাতে অদূর ভবিষ্যতে ভারতেই বুলেট ট্রেন তৈরি করা সম্ভব হয়। তাছাড়া ভারতে বুলেট ট্রেনের রক্ষনাবেক্ষনেও সাহায্য করবে জাপান। ভারতকে বুলেট ট্রেন হস্তান্তরের আগে ভারতের ১০০০ ইঞ্জিনিয়ারকে প্রশিক্ষন দেবে জাপান। বলা হয় জাপান এমন একটি দেশ যেখানে ট্রেন সাধারনত নির্ধারিত সময়ের দেরীতে যায়না। জাপানে সিনকানসেনের প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ড লেট করে। ভারতে উচ্চগতির ট্রেন চালু হলে জাপানের মতো ট্রেন যাতে লেট না করে সেবিষয়েও জোর দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে দিল্লি আহমেদাবাদ হাই স্পিড রেল করিডরকে এই মুম্বাই আহমেদাবাদ হাইস্পিড রেল করিডরের সাথে যুক্ত করা হবে, তাহলে দিল্লি থেকে মুম্বাই পর্যন্ত বুলেট ট্রেন চলবে ভবিষ্যতে। দিল্লি আহমেদাবাদ হাইস্পিড রেলওয়ে করিডর ৮৮৬ কিলোমিটার লম্বা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.