রাশিয়াকে ছেড়ে কোন দেশ থেকে যুদ্ধবিমান ক্রয় করতে পারে ভারতবর্ষ?
নিজস্ব সংবাদদাতা:আমেরিকা ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশ যদি এই মুহূর্তে বিশ্বের সামরিক অস্ত্র বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখে থাকে তবে তা হল রাশিয়া। তবে বর্তমানে দিন ভালো যাচ্ছে না রাশিয়ার। ঠিক মত বাজার পাচ্ছে না রাশিয়ার মিগ-৩৫ জেট ফাইটার। এই মিগ-৩৫ ফুলক্রাম-এফ সেই দেশের মিকোয়ান কর্পোরেশনের তৈরি চতুর্থ প্রজন্মের এক মাল্টিরোল সুপার ম্যানুভার যুক্ত এয়ার সুপিউরিটি যুদ্ধ বিমান। পূর্বে রাশিয়ার তৈরি মিগ-২৯কে/কেইউবি বা মিগ-২৯এম/এম২ বিশ্বের সামরিক বাজারে ভালো সাড়া ফেলেছিল। আর তাই পুনরায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বড় মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে পূর্বের জেট ফাইটারগুলোর ওপর ভিত্তি করেই নতুন প্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক ডিজাইনের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় মিগ-৩৫। কিন্তু, এখনো অব্দি যা পরিস্থিতি তাতে ব্যবসায়িক ভাবে এই যুদ্ধবিমানের সফলতা প্রাপ্তির হার খুব কম বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাশিয়ার মিকোয়ান কর্পোরেশন আদপে ২০০৭ সাল থেকে মিগ-৩৫ এডভান্স যুদ্ধবিমান তৈরির কাজ শুরু করলেও বিশাল মাত্রায় প্রডাকশন শুরু হয়েছিলো ২০১৯ সাল থেকে। অবশ্য তার আগেই ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি রাশিয়ার মিকোয়ান কর্পোরেশন প্রথম বারের মতো মিগ-৩৫ এর সফল উড্ডয়নে সফল হয়। এই সাফল্য ছিলো এতোটাই বড় যে ঠিক এর পরের দিনই আবার সেই খুশিতে মস্কোতে এক বড়ো প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। তার পর কেটে গেছে বেশ বছর কয়েক। খবর অনুযায়ী ২০২০ এর নভেম্বর পর্যন্ত ৬টি প্রটোটাইপ কপি এবং ৪টি সিরিয়াল প্রডাকশন সহ মোট ১০টি এই ধরণের যুদ্ধবিমান এখনো অব্দি সেনাবাহিনীর সার্ভিসে আনা সম্ভব হয়েছে।
মিকোয়ান কর্পোরেশন মিগ-৩৫ ফুলক্রাম-এফ মাল্টিরোল বিমান তৈরির সময় লক্ষ্য রেখেছিল মূলত দুটি বিষয়ের ওপর। প্রথমত যাতে এটি ভয়ঙ্কর আক্রমন হানতে সক্ষম হয় এবং দ্বিতীয়ত দীর্ঘক্ষণ যাতে আকাশে উড্ডয়ন ক্ষমতা থাকে এর। আর তা সুনিশ্চিত করতেই মিগ-৩৫ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে দুটি শক্তিশালী আরডি-৩৩এমকেবিএস হাইলী থ্রাস্ট ভেক্টরিং কন্ট্রোল সিস্টেম (টিভিসি) আফটার টার্বোফ্যান ইঞ্জিন।
রাশিয়ার মূল লক্ষ্য ছিলো সুখোই সিরিজের জেট ফাইটারগুলোর তুলনায় মিগ-৩৫ এর পরিচালনা ও মেন্ট্যানেন্স কস্ট যতটা সম্ভব কম রাখা এবং এই গোটা প্রক্রিয়াটাকে যতটা সম্ভব সহজসাধ্য করে তোলা। এখনো পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এই বিমানের প্রতি ইউনিট কস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫৫-৬০ মিলিয়ন ডলার।
আসুন এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক মিগ-৩৫ যুদ্ধবিমানের বিশেষত্বগুলি। আকাশপথে ১৬০ কিলোমিটারের মধ্যে টার্গেট এসে পড়লে তাকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি ভূমিতেও এই বিমান যাতে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে যেকোনো টার্গেটকে নিজের রেডারে লক করতে সক্ষম হয় তা সুনিশ্চিত করতে এক উন্নত একটিভ ইলেক্ট্রনিক্যাললী স্ক্যানড এ্যারি (এইএসএ) রাডার সিস্টেম ও অপটিক্যাল লোকেটিং সিস্টেম (ওএলএস)সহ ১৬০ মডিউল বিশিষ্ট ‘জুক মা’ এ্যান্টেনা সযোজন করা হয়েছে এই যুদ্ধবিমানে। চতুর্থ প্রজন্মের এই যুদ্ধবিমান একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণভাবে ৯৫০ লিটার জ্বালানী ধারণ করতে পারে তেমনই ২০০০ লিটার পর্যন্ত জ্বালানী বাড়তি ফুয়েল ড্রপ ট্যাংকে বহন করতেও সক্ষম এটি। তার ওপর রিফুয়েলিংয়ের সুবিধা থাকায় মিগ ৩৫ যুদ্ধ বিমান নিজস্ব জ্বালানি ব্যবহার করে প্রায় ৩১০০ মিলোমিটার পর্যন্ত সামরিক অপারেশন পরিচালনা করতে পারে। সেই সঙ্গে বাড়তি জ্বলিনী ব্যবহার করে ৫৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত সামরিক মিশন পরিচালনা করতেও সক্ষম এটি। ১০০০ কিলোমিটারের কমব্যাট রেডিয়াস সম্পন্ন এই জেট ফ্যাইটারের সর্বোচ্চ গতি ২.২৫ ম্যাক। এখানেই শেষ নয়। জানলে অবাক হবেন উন্নত প্রযুক্তিতে সজ্জিত ১৭৫০০ মিটার উচ্চতায় উড্ডয়নে ক্ষমতা বিশিষ্ট ১০.০০ জি ম্যানুভারিং লোড ফ্যাক্টর বিশিষ্ট এই জেট ফাইটার তার নয়টি হার্ড পয়েন্টে সর্বোচ্চ ৬,৫০০/৭,০০০ কেজি পর্যন্ত অস্ত্র ও ক্ষেপনাস্ত্র বহণ করতে সক্ষম। এন্টিশীপ সিস্টেম হিসেবে এই জেট বিমান সংযুক্ত করা হয়েছে ৮টি এয়ার টু সারফেস মিসাইল ও ৮টি এয়ার টু এয়ার মিসাইল। এছাড়া গাইডেড,আনগাইডেড বোম্ব এবং গাইডেড বা লেজার গাইডেড রকেট লোড তো থাকছেই সেই সঙ্গে ইন্টারনাল ফিকসড ইউপন্স হিসেবে ১৫০ রাউন্ডের একটি এডভান্স ৩০ এমএম জিএসএইচ-৩০-১ স্মুথবোর ক্যানন সংযুক্ত করা রয়েছে এতে । বিভিআর অর্থাৎ বিয়ন্ড ভিজিয়াল রেঞ্জ প্রযুক্তি সম্পন্ন মিসাইল এ এ-১২ এ্যাডার দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে রাশিয়ার মিগ-৩৫কে। যার বিভিআর রেঞ্জ প্রায় ১৯৩ কিলোমিটার।
উন্নত প্রযুক্তির এই যুদ্ধবিমানকে নিয়ে রাশিয়ার আশা ছিল অনেক। কিন্তু অনেক রকম বিশেষত্ব থাকা সত্বেও ২০১৯ সালে রাশিয়ার মিকোয়ান কর্পোরেশন বিমানের ম্যাসিভ প্রডাকশন শুরু করার পরেও আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতা আকর্ষণ করতে ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছে মিগ-৩৫ । শোনা যাচ্ছে অবস্থা এই রকমই থাকলে রাশিয়া তাদের নিজস্ব বিমান বাহিনীতেই প্রাথমিকভাবে ৪০টি মিগ-৩৫ জেট ফাইটার সংযোজন করবে এবং ভবিষ্যতে হয়তো সেই সংখ্যাটাকেই হয়তো পৌঁছে নিয়ে যাওয়া হবে ১৭০ এ।
মিগ-৩৫ ফুলক্রাম-এফ রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রয় করার জন্য মিশর আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতা হিসেবে আগ্রহ দেখালেও আপাতত শুধু মাত্র এসইউ-৩৫ জেট ফাইটার ক্রয়ের বিষয়টিকেই নিশ্চিত করেছে। অবস্থা বুঝে রাশিয়ার মিয়াকোন মিগ কর্পোরেশন বর্তমানে মিশর, ভারত, বাংলাদেশ, পেরু ও মায়ানমারের মতো কিছু দেশকে অল্প পরিসরে হলেও ভবিষ্যতে মিগ-৩৫ এর গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে বিবেচনা করতে আরম্ভ করেছে। ইতিমধ্যেই রাশিয়া বারংবার মিগ-৩৫ নিয়ে নানা অফার দিয়ে গেলেও অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বিবেচনা করে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এবং বিমান বাহিনী হয়ত এই জাতীয় জেট ফাইটারকে শেষমেষ সার্ভিসে আনবে না।