চীনকে চাপে রাখতে অরুনাচল প্রদেশে কি প্ল্যান মোদী সরকারের?
অরুনাচল প্রদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন অঞ্চল তাওয়াং জেলা যার সাথে চীনের সীমান্ত রয়েছে। তাওয়াং এর একদিকে রয়েছে ভুুটান এবং অন্যদিকে রয়েছে চীন অধিকৃত তিব্বত। তাওয়াং অঞ্চল স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভারতের জন্য। ভারত ও চীনের মধ্যে সীমানা এলএসি বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল আমেরিকা মেক্সিকো সীমান্তের থেকে সামান্য কিছুটা বেশী দীর্ঘ। অরুনাচল প্রদেশের তাওয়াং এই এলএসির পূর্ব বিভাগের অংশ। ভারতের সাথে চীনের ৪,০৫৭ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে যাকে এলএসি বলা হয়। এই এলএ সি তিন ভাগে বিভক্ত। পশ্চিম ভাগ যেখানে লাদাখ ও কাশ্মীরে ইন্দো-চীন সীমান্ত রয়েছে, মধ্যভাগ যেখানে উত্তরাখন্ড, হিমাচল প্রদেশে ইন্দোচীন সীমান্ত রয়েছে এবং পূর্বভাগ যেখানে সিকিম ও অরুনাচল প্রদেশে ইন্দোচীন সীমান্ত রয়েছে।
বৌদ্ধ ধর্মের জন্য তাওয়াং অত্যন্ত পবিত্র স্থান। এখানে গুরুত্বপূর্ন বৌদ্ধ গুম্ফা রয়েছে। বলা হয় ১৮৬৩ সালে ষষ্ঠ দলাই লামার জন্ম হয়েছিল তাওয়াং এর বৌদ্ধ গুম্ফাতে। চীন ১৯৫০ সালের পর থেকেই তিব্বতের রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করে এবং পরবর্তী দলাই লামার পরিচয়ও খুঁজছে চীন যার জন্য তাওয়াং এর উপর চীনের বরাবরই নজর রয়েছে। চীন বহুকাল ধরেই অরুনাচল প্রদেশকে তাদের অংশ বলে দাবী করে আসছে। চীন অরুনাচল প্রদেশকে দক্ষিন তিব্বত বা জাংনান বলে। কিন্ত অরুনাচল প্রদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য চীন কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনা।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে তাওয়াং এর কাছে এলএসিতে ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। এর আগে ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকাতে ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। ২০১৭ সালে ভুটানের ডোকলামে চীনের অবৈধ রাস্তা নির্মানকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও চীনের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। সুতরাং ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতি হলে প্রথমেই দরকার যাতে খুব সহজেই ভারতীয় সেনাবাহিনী, সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাঙ্ক ইন্দো চীন সীমান্তে পৌঁছাতে পারে। এর জন্য দরকার আধুনিক সড়ক ব্যবস্থা, কিন্তু এতদিন পর্যন্ত তাওয়াংএ পৌঁছানোই ছিল সমস্যার ব্যাপার। সড়কপথে তাওয়াং যেতে হলে আসামের পশ্চিম কামেং জেলা হয়ে সেলা পাস হয়ে যেতে হয়। কিন্তু এই সেলা পাস ১৪,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত, এখানে তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে যায়। এত বেশী ঠান্ডার কারনে কখনও কখনও গাড়ির ডিজেলও জমে যায়। সেলা পাসে অত্যাধিক তুষারপাতের কারনে এখানে অনেক সময়ই রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সেকারনে সবসময় তাওয়াং পৌঁছানো সবসময় হয়না। এই সমস্যা সমাধানের জন্যই এখানে সেলা টানেল তৈরি করা হয়েছে। সবরকম আবহাওয়াতেই এই টানেল কার্যকর থাকবে যার কারনে আসামের গৌহাটি থেকে অরুনাচল প্রদেশের তাওয়াং সারাবছর যেকোনও সময়েই যাতায়াত করতে পারবে ভারতীয় সেনাবাহিনী। গত ৯ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১৩,৭০০ ফুট উচ্চতায় স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই সেলা টানেলের উদ্ভোদন করেছেন যা অরুনাচল প্রদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করবে।
১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়ওয়াল রাইফেলসের এক বীর সদস্য যশবন্ত সিং রাওয়াত এই সেলা পাসে দুটি স্থানীয় উপজাতি মেয়ে সেলা এবং নুরার সাহায্যে চীনের সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। পরে চাইনিজ সেনা সেলাকে হত্যা করে এবং নোরাকে বন্দী করে। যশবন্ত সিং রাওয়াত ৭২ ঘন্টা ধরে একা চাইনিজ সেনার সামনে দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আসলে চাইনিজ সেনা ভাবছিলো সমানে হয়ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেক সেনা রয়েছে কিন্তু আদতে সেখানে
যশবন্ত সিং রাওয়াত একাই ছিলেন। তিনদিন পর এক স্থানীয় ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে চীনের সেনা জানতে পারে সামনে শুধুমাত্র একজন ভারতীয় সেনা রয়েছে তখন চীনের সেনা আক্রমন করে এবং যশবন্ত সিং রাওয়াত বীরগতি প্রাপ্ত হন। এই অসাধারন বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কারনে যশবন্ত সিং রাওয়াতকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান মহা বীর চক্র সম্মানে সম্মানিত করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী তার সম্মানে সেলা পাসে যেখানে তিনি বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই জায়গায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটির নাম রেখেছে যশবন্ত গড় পোস্ট এবং এখানে যশবন্ত গড় ওয়ার মেমোরিয়ালও তৈরি করা হয়েছে। সেলাকে সম্মান জানাতে এখানে টানেল, জলাশয়, পাসের নাম সেলা রাখা হয়েছে এবং সেলা টানেলের উত্তরে একটি জলপ্রপাতের নাম নুরার সম্মানে রাখা হয়েছে নুরানাং জলপ্রপাত। এই সেলা পাসের ৪০০ ফুট নীচে অন্য একটা রাস্তায় এই টানেল বা সূড়ঙ্গ করা হয়েছে। ১৩,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম বাই লেন টানেল এই সেলা টানেল। সেলা পাসের নীচ দিয়ে ১২.৪ কিলোমিটার একটি নতুন রাস্তা তৈরি করা হয়েছে এই সূড়ঙ্গ নির্মানের মাধ্যমে যা জাতীয় সড়ক ১৩তে যুক্ত হয়েছে। এই সূড়ঙ্গ নির্মানের ফলে আসামের পশ্চিম কামেং জেলার দিরাং ও তাওয়াং এর মধ্যে দূরত্ব দশ কিলোমিটার কমে গেছে ফলে তাওয়াং পৌঁছাতে আরও নব্বই মিনিট সময় কম লাগবে। সেলা টানেল একটানা কোনও সূড়ঙ্গ নয় বরং এটি দুটি বা তিনটি টানেলের সমষ্টি। সেলা টানেলের ছোট টানেলটির দৈর্ঘ্য ১০০৩.৩৪ মিটার এবং বড় টানেলটির দৈর্ঘ্য ১৫৯৪.৯০ মিটার। বড় টানেলটির সমান্তরালে আরও একটি টানেল তৈরি করা হয়েছে যাতে কখনও বড় টানেলে কোনও সমস্যা তৈরি হলে সমান্তরাল টানেলটি দিয়ে মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে আনা যায়। যদিও দুটি টানেলেই অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা, বায়ু চলাচল ব্যবস্থা ও শক্তিশালী আলো রয়েছে যাতে কোনও সমস্যা না হয়। এই দুটি টানেল দিয়ে প্রতিদিন ৩,০০০ গাড়ি ও ২,০০০ লড়ি যাতায়াত করতে সক্ষম। বিআরও এই টানেল নির্মান করেছে। সেলা টানেলকে ভারতের কারিগরি বিদ্যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলা হচ্ছে কারন বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন বা বিআরও জানিয়েছে এখনও পর্যন্ত যত পরিকাঠামো তৈরি করা হয়েছে তার মধ্যে সেলা টানেল তৈরি সবচেয়ে কঠিন ছিল। পর্বতের গুহাতে বিস্ফোরন করে এই সূড়ঙ্গ নির্মান করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার নতুন টনেল নির্মান পদ্ধতি অনুযায়ী ৫০ ইঞ্জিনিয়ার এবং ৮০০ জন শ্রমিক এই টানেল তৈরি করেছে। গতবছর জুলাই মাসেই এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেসময় হঠাৎই তীব্র বৃষ্টির কারনে এখানের রাস্তা ব্যবহার করা সম্ভব ছিলনা। গত নভেম্বর উত্তরাখন্ডের সিলকিয়ারা টানেলে বেশ কিছু শ্রমিক আটকে পড়েছিলেন, পরে অবশ্য তাদের উদ্ধার করা হয়। তবে এমন কোনও অবস্থা সেলা টানেলে হয়নি, বিআরও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন করেছে।
২০১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই সেলা টানেলের নির্মানের সূচনা করেন। ১৫ জানুয়ারি, ২০২১ সালে বিস্ফোরনের মাধ্যমে প্রথম টানেলের নির্মান শুরু হয় এবং ওই বছরই ১৪ অক্টোবর ইন্ডিয়া গেট থেকে অনলাইনে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এর উপস্থিতিতে দ্বিতীয় টানেলে বিস্ফোরনের মাধ্যমে কাজ শুরু হয়। পাঁচ বছরে সম্পূর্ন হওয়া এই সেলা টানেল নির্মানে ৮২৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তাওয়াং এর বিপরীতে তিব্বতে চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কম্যান্ড রয়েছে। তাই বিআরও এর প্রজেক্ট ভর্তকের আওতায় তৈরি এই সেলা টানেল ভারতীয় সেনাবাহিনীকে চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কম্যান্ডেট মোকাবিলা করতে আরও সহয়তা করবে। এই টানেল নির্মানের কারনে তীব্র ঠান্ডার সময়েও তেজপুর থেকে তাওয়াং যেতে পারবে ভারতীয় সেনাবাহিনী। এই টানেলের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী জোরাওয়ার লাইট ট্যাঙ্ক এলএসির কাছে নিয়ে যাবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তিনধরনের প্রধান ট্যাঙ্ক রয়েছে টি ৯০ ভীষ্ম, টি ৭২ এবং অর্জুন। তবে এলএসির পার্বত্যঅঞ্চলে এত ভারী ট্যাঙ্ক উপযুক্ত নয়। এসব এলাকায় হালকা ট্যাঙ্ক প্রয়োজন। যার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী ৫৯টি জোরাওয়ার ট্যাঙ্কের অর্ডার দিয়েছে। ডিআরডিও এর ডিজাইনকরা এই ট্যাঙ্ক তৈরি করে এলএন্ডটি। ২৫ টন ওজনের এরকম হালকা ট্যাঙ্ক অন্তত তিনশোটি দরকার এলএসিতে, তবে আপাতত ৫৯টি অর্ডার করা হয়েছে। এছাড়া বিআরও তাওয়াংএ সাঙ্গেস্টার থেকে বাম লা পাস পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন করছে যাতে জাতীয় সড়ক ১৩ দুই লেন বিশিষ্ট সড়ক হয়ে যাবে। স্ট্রাটেজিক কারন ছাড়াও সেলা টানেলের কারনে অরুনাচল প্রদেশে পর্যটনশিল্প আরও বৃদ্ধি পাবে।