আলজেরিয়াতে ফ্রান্স সেনারা গনহত্যা। জানুন বিস্তারিত
রাজেশ রায়:– বর্তমানে বিশ্বে একটিই সুপার পাওয়ার দেশ রয়েছে তা হচ্ছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আমেরিকার সুপার পাওয়ার হওয়ার ইতিহাস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বা প্রায় একশো বছর আগের। কিন্তু তারও আগে বিশেষকরে সতেরো, আঠারো শতকে বিশ্বে দুটি সুপার পাওয়ার দেশ ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স। প্রায় পুরো বিশ্বজুড়ে এই দুই দেশের উপনিবেশ ছিল, ভারতেও ছিল। ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর, প্রত্যেকটি বিজয়গাথার পেছনে রয়েছে নৃশংস যুদ্ধ ও নারকীয় অত্যাচার। আফ্রিকার একটি দেশ হচ্ছে আলজেরিয়া। এই দেশটি ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল কিন্তু এই দেশটিতে অন্যান্য ঔপনিবেশিক শক্তির মতোই ফ্রান্স ভয়াবহ অত্যাচার করেছিল। ফ্রান্স থেকেই বিশ্বে গনতন্ত্র ছড়িয়ে পড়েছিল কিন্তু আলজেরিয়া যে গনহত্যা ফ্রান্স করেছিল তা সত্যিই মানব ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। আলজেরিয়া প্রায় সমস্ত ট্রাইবকে শেষ করে দিয়েছিল ফ্রান্স। ফ্রান্স কীভাবে আলজেরিয়াকে দখল করল, আলজেরিয়ার একটু ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
আফ্রিকা মহাদেশ এশিয়ার পর আয়তনে বিশ্বের দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় মহাদেশ। উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত আলজেরিয়া আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় দেশ। তবে ২০১১ সালের পর আলজেরিয়া আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় দেশ হয়, এর আগে সুদান ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ। ২০১১ সালে সুদান ও দক্ষিন সুদান আলাদা দেশ হয়ে যায়। আলজেরিয়ার রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম। এত বড় দেশ হয়েও আলজেরিয়ার জনসংখ্যা মাত্র চার কোটি। এর মধ্যে আবার সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা আলজেরিয়ার উত্তর উপকূলে বাস করে। আলজেরিয়ার রাজধানী আলজেরিস সহ দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ওরান, কনস্টানস্টিনও এই উত্তর উপকূলে অবস্থিত। ব্যাবসা বানিজ্যের জন্য উপকূলেই বেশী লোক বাস করে। আলজেরিয়ার দক্ষিনাংশে কোন জনসংখ্যা নেই এর কারন হচ্ছে এই অংশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মরুভূমি সাহারা অবস্থিত। সাহারা মরুভূমি আলজেরিয়ার ৮০ শতাংশ জায়গা জুড়ে অবস্থিত যার জন্য এই অংশে জনবসতি সম্ভব নয়। আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া, মৌরিতানায়া, লিবিয়া ও মরোক্ক এই পাঁচটি দেশকে একত্রে মার্গরেব অঞ্চল বলা হয়। আলজেরিয়ার ওরান ও কনস্টানস্টিন এই দুটি শহরকেই ফ্রান্স দখল করে প্রথমে, এই দুটি শহর দখলের জন্যই গনহত্যা হয়। এসবের সূত্রপাত হয় দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথমত ১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীন হয় এবং ১৭৮৯ সালে বিখ্যাত ফরাসী বিপ্লব ঘটে। ইউরোপে আগে রাজাদের রাজত্ব ছিল, পরে খ্রীষ্টান ধর্মের উদ্ভবের পর চার্চ সবকিছু নিয়ন্ত্রন করত। কিন্তু যখন রাজারা দেখল তারা চার্চের হাতের পুতুল হয়ে গেছে তখন আবার রাজারা চার্চের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়।
ফ্রান্স একটা সময় আলজেরিয়া থেকে গম কিনত। কিন্তু ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে ফরাসী বিপ্লবের সূচনা হয় যার মূল লক্ষ ছিল রাজার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সাধারন মানুষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা অর্থাৎ জনগনই সব কিছুর মালিক হবে যাকে গনতন্ত্র বলা হয়। ১৭৯৯ সালে বিদ্রোহের শেষে নেপোলিয়ান ক্ষমতায় আসে ফ্রান্সের, ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের পরে আবারও ফ্রান্সের ক্ষমতা রাজারা দখলের চেষ্টা করে কিন্তু যে জনগন একবার স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে গেছে তাদের উপর পুনরায় নিয়ন্ত্রন করা খুব কঠিন। যখনই কোন দেশে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয় তখনই আন্দোলন থেকে মানুষের মনকে সরিয়ে দিতে অন্য কোন ঘটনা তৈরি করা হয়। ঠিক এইসময় ফ্রান্স জনগনের মন ঘোরাতে আলজেরিয়াকে আক্রমন করে। ১৮৩০-১৯০৩ প্রায় ৭৩ বছর লাগে ফ্রান্সের পুরো আলজেরিয়া দখল করতে। ফ্রান্সের এই যুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ আলজেরিয়ানের মৃত্যু হয়। ১৯৬২ অবধি আলজেরিয়াতে শাসন করেছিল ফ্রান্স। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন খুবই রক্তাক্ত ছিল। ১৮৩০ এ ফ্রান্সের আলজেরিয়া আক্রমনের আগে আলজেরিয়া তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তবে আলজেরিয়াতে স্বয়ত্তশাসন ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যে ১৫১৫ থেকে ১৮৩০ অবধি আলজেরিয়ায় ছিল। অটোমানদের অধীনে স্থানীয় আলজেরিয়ান লিডারই দেশ শাসন করত। ১৮৩০ সালে ৩৪,০০০ সেনা নিয়ে পশ্চিম আলজেরিয়াতে আক্রমন করে ফ্রান্স এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আলজেরিয়ার একের পর এক শহর দখল করতে থাকে ফ্রান্স। অটোমান সেনাকে পরাজিত করে ফ্রান্স কারন ফ্রান্সের অস্ত্র অনেক আধুনিক ছিল। ফ্রান্সের আলজেরিয়া আক্রমনের আরও একটি কারন ছিল ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে যখন ফরাসী বিপ্লব হয় তখন আলজেরিয়া থেকে ধারে গম সহ অনেক খাদ্যশস্য নিয়েছিল ফ্রান্স, কিন্ত যতদিন যায় ফ্রান্স কোন পয়সা শোধও করেনি। তাই সেই পয়সা যাতে দিতে না হয় তার থেকে বাঁচতে আলজেরিয়া আক্রমন করে ফ্রান্স।
একটা সময় আফ্রিকার মানুষদের ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করত ইউরোপীয়ানরা সেটা নিশ্চয় শুনেই থাকবেন কিন্তু আলজেরিয়াতে ইউরোপীয়ানদের ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করা হত। আলজেরিয়াতে বারবার নামে একটি গোষ্ঠী ছিল এরা জলদস্যু ছিল, মূলত ভূমধ্যসাগর এলাকা থেকে এরা ইউরোপীয়ানদের ধরে এনে ক্রীতদাস বাজারে বিক্রি করত। ফ্রান্স আলজেরিয়া দখল করে এই ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ করে। ফ্রান্স প্রথমেই আলজেরিয়ার সমস্ত ট্রাইবদের নেতাদের হত্যা করে। তখন আলজেরিয়ার সমস্ত জনগোষ্ঠী এক হয়ে আব্দুল কাদির নামে একজনকে তাদের লিডার নির্বাচন করে যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ফ্রান্সকে তাদের ভূমি থেকে হটানোর। কিন্তু ফ্রান্সের পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম। ফ্রান্স একবারে পুরো মরোক্ক আক্রমন করেনি, কারন একবারে যুদ্ধ করলে ওতো সেনা তাদের ছিলনা। ফ্রান্স করল কি ১৮৩৫ সালে আব্দুল কাদিরের সাথে একটি চুক্তি করে যাতে বলা হয় ওরান প্রদেশের স্বাধীন শাসক হবে আব্দুল কাদির ও আলজেরিয়ান বাসী নিজের স্বাধীনতায় বসবাস করবে কিন্তু এসবই ছিল লোক দেখানো, আসলে ফ্রান্স নিজেদের গুছিয়ে নিতে একটু সময় চাইছিল। ১৮৪০ আসতে আসতে আলজেরিয়াতে নারকীয় ধ্বংসলীলা চালানো হয় যাতে ঘরবাড়ি, উপাসনালয় জ্বালিয়ে দেওয়া, প্রচুর নীরিহ মানুষকে হত্যা করা হয়। আব্দুল কাদির ভয়ে মরোক্ক পালিয়ে যায় ১৮৪২ সালে। তারপরেও আলজেরিয়ানরা গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কিন্তু ফ্রান্স কঠোর হাতে এই বিদ্রোহ দমন করে এবং ৫০০০ আলজেরিয়ান বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে। আব্দুল কাদিরকে ফিরিয়ে দেবার জন্য মরোক্ক চাপ দিতে থাকে ফ্রান্স কিন্তু মরোক্ক রাজি হয়নি, যার জন্য মরোক্কর সাথে ফ্রান্সের যুদ্ধ হয় এবং মরোক্ক পরাজিত হয়। আব্দুল কাদির ১৮৪৭ সালে ফ্রান্সের কাছে আত্মসমর্পন করে এবং শর্ত হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে যায়। ১৮৮১ সালে মৃত্যু হয় আব্দুল কাদিরের। ফ্রান্স এরপর কয়েক ধাপে আলজেরিয়ার বিভিন্ন জাতির উপর আক্রমন করে। ১৮৫৭ সালে কাবাইলা, ১৮৭১ সালে এল মকরানি, ১৮৮১-১৯০২ অবধি পুরো সাহারা এবং সবশেষে ১৯০৩ সালে দক্ষিন ওরনেস প্রদেশ নিয়ে পুরো আলজেরিয়া বিজয় সম্পন্ন হয় ফ্রান্সের।
কাবাইলা ট্রাইবে একজন মহিলা লিডার ছিল যিনি অসাধারন লড়াই করেছিলেন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করে জেলে ভরে দেওয়া হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। একবার ইল উফিয়া নামে একটি ট্রাইবের সাথে যুদ্ধ হচ্ছিল ফ্রান্সের। প্রান বাঁচাতে এই ট্রাইবের ৫০০-৭০০ জন লোক যার মধ্যে বাচ্চা এবং মহিলারা ছিল তারা একটি গুহায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু ফ্রান্সের সেনা পুরো গুহায় আগুন লাগিয়ে দেয় যাতে সবাই অত্যন্ত করুনভাবে মারা যায়। আসলে ইতিহাসে সমস্ত ঔপনিবেশিক শক্তিই ক্ষমতার লোভে গনহত্যা করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবারও ফ্রান্স আলজেরিয়ার উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬২ অবধি আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছিল যা অত্যন্ত হিংস্র ছিল। ১৯৬২ সালে শেষ অবধি স্বাধীনতা পায় আলজেরিয়া। তবে আজও আলজেরিয়াতে গনতন্ত্র নেই, সেখানে একনায়কতন্ত্র রয়েছে, একটাই দল ক্ষমতায় আছে।