ভিক্রমাদিত্যে ক্রয় করতে গিয়ে নৌবাহিনীর অফিসারদের ভয় দেখিয়েছিল সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতারা
নিউজ ডেস্কঃ বর্তমানে ভারতের হাতে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা যুদ্ধজাহাজ কতগুলি? ২ টি একটিভ রয়েছে। আই এন এস ভিক্রামাদিত্য। বর্তমানে নৌসেনাকে সার্ভিস দিছে। তবে এই আই এন এস ভিক্রমাদিত্যকে নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। বিশেষ করে একটি ডিফেন্সের ইক্যুইপমেন্ট ভারতে আসতে যে এতো সময় কেন লাগে? তা হয়ত নেভাল অফিসাররা ভালো করে জানেন। ভারতের রাজনৈতিক কারনে কতোটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।
আই এন এস ভিক্রমাদিত্য। সার্ভিসে আসে ২০১৪ সালের জুন মাসে। আর অর্ডার করা হয় ২০০৪ সালে। অর্থাৎ পুরনো একটি জাহাজ কিনতে নাকি ১০ বছর লেগে গেল। তা এই জাহাজ ক্রয় করতে ১০ বছর কেন লাগল? বা এই জাহাজ কত বছর পুরনো মানে বয়সে কত?
১৯৮৭ সালে সার্ভিসে আসে অ্যাডমিরাল গরস্কোভ (বর্তমানে আই এন এস ভিক্রামাদিত্য)। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ডি একটিভেট করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ কোল্ড ওয়ার বা ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার আর ক্ষমতা ছিলনা এই বিধ্বংসী এবং ভারী জাহাজটিকে চালানোর মতো। বিশেষ করে জাহাজটির এতো খরচ হওয়ার কারনে জাহাজটি আর চালাতে সক্ষম হচ্ছিলনা তারা। আর সেই কারনে ভারতবর্ষের নজর কেড়েছিল এই জাহাজ। বিশেষ করে আই এন এস ভিরাটের অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিল যে ভারতের একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের দরকার হয়ে পরে।
২০০৪ সালে অর্থাৎ জাহাজটির ডিএকটিভেট করে দেওয়ার ৮ বছর পর চুক্তি সম্পন্ন হয় যে রাশিয়ার থেকে ভারত এই জাহাজ ক্রয় করবে বিনামুল্যে। শুধু ভারতকে ৮০০ মিলিয়ন খরচ করতে হবে জাহাজটির মেরামতি এবং আপগ্রেড করার জন্য। পাশাপাশি ১ বিলিয়ন খরচ করতে হবে জাহাজটির অস্ত্র এবং যুদ্ধবিমানের জন্য।
চুক্তিটি সই করা হয় যার মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে বিভিন্ন অস্ত্র ক্রয় করবে ভারত। ১২ টি সিঙ্গল সিট মিগ ২৯, ১৪ টি ডুয়েল সিট মিগ ২৯, সার্চ এবং হামলা চালানো, অ্যান্টি সাবমেরিন ৬ টি কামভ হেলিকপ্টার পাশাপাশি টর্পেডো টিউব, মিসাইল সিস্টেম, আর্টিলারি ইউনিটস। শুধু তাই নয় ট্রেনিং, পার্টস এবং মেইটেনেন্স ইন্ডিয়ান নেভির। ২০০৪ সালে এই চুক্তিটি সাক্ষরিত হয়।
২০০৮ এ সার্ভিসে আসার কথা এই ভিক্রামাদিত্যর কিন্তু সেইসময়য় আই এন এস ভিরাট হাতে থাকার কারনে ঝুলে থাকে ব্যাপারটি। এবং বিরাটকে ২০১০-১২ তে অবসর করার কথা চিন্তা করা হয়। আর সেই মতো আই এন ভিক্রামাদিত্যের চুক্তি ঝুলিয়ে রাখা হয়।
দীর্ঘদিন ধরে সব ঝুলে থাকার কারনে পাশাপাশি দাম বৃদ্ধির কারনে অতিরিক্ত ১.২ বিলিয়ন ডলার বেশি চেয়ে বসে রাশিয়া এবং সেইমত ভারত দিতে রাজি হয়ে যায়। সেইসময় ভারতের প্রথম দেশীয় যুদ্ধজাহাজ তৈরি হচ্ছে আই এন এস ভিক্রান্ত। আর সেই কারনে ভিক্রান্তের অনুমোদন ও এক বছর পিছিয়ে যায়। এবার আরও দাম বেশি চেয়ে বসে রাশিয়া, অর্থাৎ জিনিসের দাম বৃদ্ধির কারনে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের মেরামতি যা খরচ পরবে ২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন।
২০০৮ এর নভেম্বর মাসে ভারত ৪০০ মিলিয়ন ডলার দেয় রাশিয়াকে কিন্তু রাশিয়া হুমকি দেয় যে অর্থ না বাড়ালে তারা দেরি চুক্তি ভেঙ্গে দেবে। সেইসময় ভারতের আধিকারিকরা তরিঘরি শুরু করে যুদ্ধজাহাজটি কে ক্রয় করার জন্য। এবং সেইসময় CAG সমালোচনা করে এই যুদ্ধজাহাজকে নিয়ে। কারন একটি পুরনো যুদ্ধজাহাজকে নিতে এতো পরিমাণ অর্থ, বিশেষ করে পর্যাপ্ত সময় ব্যবহার করার পাশাপাশি ৬০ শতাংশ বেশি দাম পরছে একটি নতুন জুদ্ধজাহাজের থেকে এবং যেখানে রিস্ক থেকে যায় আরও দেরি করে ডেলিভারি হতে পারে।
সেইসময় ইন্ডিয়ান নেভির অফিসার সুরেশ মেহতা এর বিরোধিতা করে এতো বেশি দাম দিয়ে ক্রয় করার জন্য। তিনি জানান “ আমি ক্যাগের উপর কথা বলতে পারবো না, সেখানে সামরিক বিশেষজ্ঞরা আছেন। কিন্তু আমায় একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দিতে পারবে যার দাম ২ বিলিয়ন ডলার মধ্যে পরবে। তাহলে আমি এখনই চেক সই করে দিচ্ছি”।
এরপরেও জলঘোলা হতে থাকে। ২০০৯ সালে রাশিয়া জানায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ২০১২ তে ডেলিভারি করা হবে ভারতকে। কিন্তু তারপরেও রাশিয়ার এক সোর্স জানায় যে চুক্তি ফাইনালের পথে কিন্তু ডেলিভারির ডেট ফাইনাল নয়। সেইসময়য় ভারত ২.২ বিলিয়ন ডলার দেবে বলে জানায় কিন্তু রাশিয়া তখন দাম বাড়িয়ে ২.৯ বিলিয়ন ডলার চায়, অর্থাৎ ২০০৪ থেকে ২০০৯ এসে তিন গুন বৃদ্ধি পায় এই দাম। পরে ২.৩৪ বিলিয়নে চুক্তি সম্পূর্ণ হয়। যেখানে ভারতের নতুন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার করতে খরচ হচ্ছে ৩.১৩ বিলিয়ন, সেখানে ২০০৯ সালে প্রায় ২.৪ বিলিয়ন খরচ করে ২০ বছরের একটি পুরনো যুদ্ধজাহাজ ভারতেরে নৌসেনার হাতে আসছে।
২০১০ সালে এই কেলেঙ্কারি সকলের সামনে আসে এবং সুত্র মারফত জানা যায় যে ইন্ডিয়ান নেভি অফিসারকে ব্ল্যাকমেল করা হয় এই চুক্তিতে সই করার জন্য।
৯৩০ ফুট লম্বা যুদ্ধজাহাজটি জলের উপর একটানা ৪৫ দিন কাটাতে পারে। পাশাপাশি ১৫০০ জন নাবিক এবং ১০০ জন অফিসার মোতায়েন থাকে এই জাহাজে। ৩৩ কিমি/ঘণ্টার গতিবেগে প্রায় ২৫০০০ কিমি পথ পারি দিতে পারে। সর্বচ্চ গতি ৫৬কিমি/ঘণ্টা।
বর্তমানে এই যুদ্ধজাহাজে ২৬ টি মিগ ২৯ যুদ্ধবিমান এবং ১০ টি কামভ হেলিকপ্টার রয়েছে। পাশাপাশি বারাক ১ এবং বারাক ৮ এর মতো বিধ্বংসী মিসাইল রাখা আছে শত্রুপক্ষকে জবাব দেওয়ার জন্য।
২০ বছরের পুরনো একটি জাহাজ এই দাম দিয়ে ক্রয় করা হল। অর্থাৎ বুঝতে পারছেন যে একটি জিনিসকে তিন গুন দাম বাড়িয়ে ক্রয় করা। আর তার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য একজন নেভাল অফিসারকে হুমকি এবং ব্ল্যাকমেলের মুখে পরতে হয়েছিল। ভারতের ডিফেন্সের ক্ষেত্রে কম জালিয়াতি হয়নি বা বা সেইসময়য় ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এর যে কম ফায়দা নেয়নি তা রীতিমতো স্পষ্ট। পাশাপাশি রাশিয়া কিভাবে ভারতের থেকে অর্থ কামিয়েছে তা ও স্পষ্ট, অর্থাৎ বিশ্ব রাজনীতিতে কেউ কারও বন্ধু নয়। যে যার স্বার্থ পূরণ করতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।