আমেরিকা থেকে সাবমেরিন হান্টার ক্রয় করতে কেন এতো বেশী অর্থ খরচ করছে ভারতবর্ষ?
রাজেশ রায়:- যেকোনও দেশের নেভির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসেট বলা হয় সাবমেরিনকে। শত্রুকে নিঃশব্দে আক্রমন করার ক্ষেত্রে সাবমেরিনের জুরি মেলা ভার। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, ডেস্ট্রয়ার কিংবা শত্রুর লজিস্টিক সাপ্লাইকে ধ্বংস করতে সাবমেরিন সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। শুধু যুদ্ধেই নয় বরং শান্তির সময়ে গোয়েন্দা মিশন কিংবা নিজের জলভাগ পাহাড়া দেওয়াও সাবমেরিনের কাজ। এক স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমানের তুলনায় একটি সাবমেরিন নৌযুদ্ধের সময় অনেক কার্যকারি ভূমিকা পালন করে। সাবমেরিন থাকার অর্থ শত্রু মনস্তাত্ত্বিক ভাবে চাপে থাকবে। আরবসাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর তীরে অবস্থিত ভারতের সমুদ্রসীমা বিশাল। এর জন্য ভারতীয় নেভির জন্য অত্যাধুনিক সাবমেরিন দরকার। ইতিমধ্যেই ভারতীয় নেভিতে রাশিয়ার কিলো ক্লাস সাবমেরিন, ফ্রান্সের স্করপিয়ন ক্লাস সাবমেরিন, ভারতের নিজস্ব টেকনোলজিতে তৈরি আইএনএস আরিহান্টের মতন এসএসবিএন সাবমেরিন রয়েছে। কিন্তু এগুলোই যথেষ্ট নয়, ভারতের সমুদ্রভাগ রক্ষা করার জন্য আরও বেশী সাবমেরিন দরকার। এই জন্য ভারত সরকার পি-৭৫ আই ঘোষনা করেছে। পি মানে প্রজেক্ট এবং আই মানে ইন্ডিয়া।
পি-৭৫ আই এর জন্য ভারত সরকার ৪৩০০০ কোটি টাকা বা প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার বাজেট ঘোষনা করেছে। ভারত রাশিয়ার থেকে এস-৪০০ কিনেছে ৪০০০০ কোটি টাকায়। পি-৭৫ আই কিনতে আরও বেশী খরচ হবে। ভারত সরকারের মেক ইন ইন্ডিয়া নীতিতে ভারতেই এই সাবমেরিন গুলো তৈরি হবে। এরজন্য দুটি ভারতীয় সংস্থাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। মাঁজগাও ডক লিমিটেড এবং এল এন্ড টি। এই সংস্থাদুটি বিদেশী কোন সংস্থার সাথে যৌথভাবে সাবমেরিন ভারতেই তৈরি করবে। পি-৭৫ আই টেন্ডারে মোট ছয়টি কনভেনশনাল ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন তৈরি করা হবে। ফ্রান্সের নেভাল গ্রুপ, দক্ষিন কোরিয়ার ডিএসএমই, রাশিয়ার রোসবোরনএক্সপার্ট এবং জার্মানির টিকেএমএস প্রথমে এই প্রজেক্টের জন্য আগ্রহী ছিল। ভারতের পি-৭৫ আই সাবমেরিনে এর আগের প্রজেক্ট পি-৭৫ এর তুলনায় কীছু অতিরিক্ত সুবিধা থাকবে। পি-৭৫ আই সাবমেরিনে এপিআই সিস্টেম বা এয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রোপালশন সিস্টেম। সাবমেরিন সাধারনত দুই প্রকার নিউক্লিয়ার সাবমেরিন এবং ডিজেল ইলেকট্রিক অ্যাটাক সাবমেরিন। নিউক্লিয়ার সাবমেরিন জলের নীচেয় অনেকদিন থাকতে পারে কিন্তু কনভেনশনাল ডিজেল ইলেকট্রিক অ্যাটাক সাবমেরিন জলের নীচে বেশীদিন থাকতে পারেনা। কারন ডিজেল ইলেকট্রিক অ্যাটাক সাবমেরিনে ব্যাটারি ও ডিজেল জেনারেটর ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের সাবমেরিনকে ব্যাটারি চার্জের জন্য কীছুসময় পর পরই জলের উপর উঠতে হয়।
বর্তমান দিনের সবচেয়ে আধুনিক সাবমেরিন সর্বোচ্চ একসপ্তাহ জলের তলায় থাকতে পারে। কারন ব্যাটারি চার্জের জন্য আবার জলের উপরে উঠতে হয়। সাবমেরিন জলের উপরে উঠলেই শত্রু শনাক্ত করে ফেলবে সেজন্য সাবমেরিনের জন্য এপিআই সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে যাতে অপেক্ষাকৃত বেশীদিন সাবমেরিন জলের তলায় থাকতে পারবে। পি-৭৫ আই টেন্ডারে সাবমেরিনের মধ্যে ভিএলএস বা ভার্টিক্যাল লঞ্চ সিস্টেম থাকবে যার দ্বারা ব্রাহ্মস সুপার সনিক মিসাইল লঞ্চ করা সম্ভব হয়। পি-৭৫ আই সাবমেরিন স্টেলথ হবে যাতে রেডারে সহজে ধরা না পড়ে। যদি ভারতের সাবমেরিন ফ্লীটের কথা বলা হয় তাহলে ভারতের কাছে মাত্র ১৬ টি সাবমেরিন আছে। যদি চীনের কথা বলা হয় এই মহূর্তে চীনের কাছে ৭৯ টি সাবমেরিন আছে যা বিশ্বের সবচেয়ে বেশী। উত্তর কোরিয়ার কাছেও ৩৬ টি পুরোনো সাবমেরিন আছে যার জন্য ভারতও চীনের কথা মাথায় রেখে সাবমেরিন ফ্লীট বাড়ানোর দিকে লক্ষ দিয়েছে। ইতিমধ্যেই পি-৭৫ এর ছয়টি সাবমেরিন ভারতীয় নেভিতে যুক্ত হয়েছে। পি-৭৫ আইতে আরও ছয়টি সাবমেরিন ক্রয় করা হচ্ছে। এরপর পি-৭৫ আলফা প্রজেক্ট শুরু করতে চলেছে ভারত সরকার। পি-৭৫ আলফাতে ছয়টি নিউক্লিয়ার এসএসএন সাবমেরিন তৈরি করা হবে। এই প্রজেক্টের পুরো বাজেট ১.২ লাখ কোটি টাকা। আরিহান্ট ক্লাস সাবমেরিন আরও তৈরি করা হচ্ছে। সুতরাং আগামী দশকের মধ্যে বিশ্বের প্রথম পাঁচটি সাবমেরিন ফ্লীট দেশের মধ্যে ভারত চলে আসবে।
পি-৭৫ আই প্রজেক্টের সবচেয়ে ভাল ব্যাপার হচ্ছে টেকনোলজি ট্রান্সফার। টেন্ডার এর জন্য প্রথমে আরএফপি না রিকুয়েস্ট ফর প্রোপোসাল জারি করা হয় তারপর ভারতের কী কী টেকনোলজি লাগবে তা কোম্পানির কাছে পাঠানো হয়। এর উপর ভিত্তি করে জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, দক্ষিন কোরিয়া ও রাশিয়াকে এই প্রজেক্টের জন্য সম্ভাব্য প্রতিযোগী হিসাবে বেছে নেয়৷ তবে এই প্রজেক্টের জন্য ফ্রান্সের নেভাল গ্রুপই এগিয়ে ছিল এটা বলা হচ্ছিল কারন একটি সাবমেরিন তৈরির জন্য প্রথমেই দরকার ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ভারতে ইতিমধ্যে ফ্রান্সের নেভাল গ্রুপের স্কপিয়ন ক্লাস সাবমেরিন তৈরি হচ্ছিল যাকে কালভেরী ক্লাসও বলা হয়। নেভাল গ্রুপই ভারতকে পি-৭৫ আই এর জন্য স্করপিয়ন ক্লাসের আপডেটেড ভার্সন সুপার স্করপিয়ন অফার করেছিল সুতরাং ভারতের কাছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরিই ছিল। অন্য সাবমেরিন নিতে গেলে নতুন করে ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করতে হত যাতে খরচ বাড়ত। আবার একই সংস্থার সাবমেরিন থাকলে লজিস্টিকে সুবিধা হবার পাশাপাশি মেইনটেন্যান্সে খরচ কম হত। তাছাড়া ফ্রান্সের সাবমেরিনের মানও বিশ্ব বিখ্যাত এবং ফ্রান্স ভারতের অনেক পুরোনো এবং পরীক্ষিত বন্ধু। স্করপিয়ন ক্লাস সাবমেরিন ছাড়াও রাফায়েল যুদ্ধ বিমান, মিরাজ ২০০০ যুদ্ধ বিমান সহ অনেক প্রতিরক্ষা সামগ্রী ভারত ফ্রান্স থেকে কেনে।
ভারতের পি-৭৫ আলফা প্রজেক্টের ছয়টি নিউক্লিয়ার এসএসএন সাবমেরিন ফ্রান্সের বারকুডা ক্লাস সাবমেরিনের উপর নির্ভর করে তৈরি হবার কথা। কাশ্মীর ইস্যু হোক কিংবা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ ফ্রান্স সবসময় ভারতকে সমর্থন করেছে। নেভাল গ্রুপ ভারতের জন্য তাদের সম্পূর্ণ একটা আলাদা ওয়েবসাইটই তৈরি করে ফেলেছে সুতরাং এই প্রজেক্টটা যে ফ্রান্সই পাচ্ছে তা একপ্রকার নিশ্চিত ছিল। কিন্ত গত কয়েকমাস আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ফ্রান্স সফরের আগেই নেভাল গ্রুপ জানিয়েদেয় তারা এই প্রজেক্ট থেকে সরে যাচ্ছে। জার্মানিও জানিয়ে দিয়েছে তারা এই প্রজেক্টে নেই। এদিকে রাশিয়াও জানিয়েছে তারাও এই প্রজেক্ট থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। এই মহূর্তে পি-৭৫ আই প্রজেক্টে আছে শুধু স্পেন ও দক্ষিন কোরিয়া। একের পর এক বড় দেশ কেনইবা এই প্রজেক্ট থেকে সরে গেল?
বিশেষ করে ফ্রান্সের সরে দাঁড়ানোটা ভারতের জন্য একটা বড় ধাক্কা। জার্মানি সরে যাবার কারন হিসাবে জানিয়েছে ভারত যে আরএফপি জারি করেছিল তাতে বলা হয়েছে যে সাবমেরিন তৈরি হবে তাতে বেশীরভাগ জিনিস ভারতীয় হওয়া চাই এবং সাবমেরিনে ভবিষ্যতে কোন সমস্যা হলে তার দায়িত্ব সেই সংস্থার। যেকোন জিনিস কিনলে তার একটা নির্দিষ্ট ওয়ারেন্টি সময় থাকে কিন্তু জার্মানি বলছে ভারত কোন নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয় নি, সেই জন্য তারা সরে যাচ্ছে। ফ্রান্সের নেভাল গ্রুপের বক্তব্য হচ্ছে ভারত দাবী করেছে সী প্রুফ এআইপি সিস্টেমের মানে সমুদ্রের জলে যে নুন থাকে তার থেকে যেনো সমস্যা না হয় কিন্তু ফ্রান্সের নিজের কাছেই এত উন্নত এআইপি সিস্টেম নেই সেজন্য ফ্রান্স সরে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া ফ্রান্সের মত ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু। ভারত রাশিয়া থেকেই সবচেয়ে বেশী অস্ত্র কেনে। রাশিয়া পি-৭৫ আই এর জন্য তাদের আপডেটেড কিলোক্লাস সাবমেরিন অফার করেছে। ভারতীয় নেভি কিলোক্লাস সাবমেরিন আগে থেকেই ব্যবহার করে যাকে সিন্ধুঘোষ ক্লাস সাবমেরিনও বলা হয়। কিন্তু রাশিয়া জানিয়েছে ভারত আরএফপিতে বলেছে সাবমেরিন তৈরির জন্য নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে তার থেকে দেরী হলে কোম্পানিকে ক্ষতিপূরন দিতে হবে কিন্তু সাবমেরিন তৈরির উপর বিদেশী কোম্পানির কোন হাত থাকবে না।
রাশিয়ার দাবি যদি সাবমেরিন তৈরিই না করবে তারা তাহলে ক্ষতিপূরন দেবে না। এছাড়া আধুনিক এআইপি সিস্টেম একমাত্র দক্ষিন কোরিয়া ও জার্মানির আছে। সেজন্য রাশিয়া এই প্রজেক্ট থেকে সরে গেছে। এছাড়া টেকনোলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে অনেক দেশেই তাদের জটিল প্রযুক্তি পুরো দিতে চাইছে না। এই মহূর্তে যতদূর সম্ভব ভারত পি-৭৫ আই সাবমেরিন দক্ষিন কোরিয়া থেকে কিনতে পারে। ইতিমধ্যেই এই প্রজেক্টে অনেক দেরী হয়ে গেছে। এখনও কোন কোম্পানির সাবমেরিন হবো সেটাই নির্দিষ্ট হয়নি এরপর ট্রায়াল হয়ে তৈরি হতে অনেক সময় লাগবে। ভারতের প্রধান দুই শত্রু দেশ চীন সাবমেরিনে অনেক এগিয়ে গেছে। পাকিস্তান ও চীন থেকে আটটি সাবমেরিন কিনছে সুতরাং খুব দ্রুতই ভারত সরকারকে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।