৩০০ বছর স্বাধীন। কিভাবে ভারতে যোগ দিয়েছিল সিকিম?
রাজেশ রায়:- উত্তর পূর্ব ভারতের একটি ছোট্ট রাজ্য হচ্ছে সিকিম যার রাজধানী গ্যাংটক। অসাধারন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারনে ভারতের পর্যটন কেন্দ্রিক শৈলশহর হিসাবে সিকিম সর্বদা প্রথমসারিতে থাকে। তবে জানেন কী সিকিম সবসময় ভারতের অংশ ছিল না। প্রাচীন সাম্রাজ্য হিসাবে সিকিম ৩০০ বছর স্বাধীন থাকার পর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। সিকিমের ইতিহাস ও ভারতে যোগদানের ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
হিমালয়ের কোলে অবস্থিত সিকিমের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ন। সিকিমের উত্তরে তিব্বত, দক্ষিনে শিলিগুড়ি, পূর্বে ভুটান এবং পশ্চিমে নেপাল। সুতরাং অতীতে সিকিম চারদিকে চারটি আলাদা আলাদা দেশ দ্বারা ঘেরা ছিল কারন অতীতে তিব্বত ও আলাদা সাম্রাজ্য ছিল। সিকিমের সংস্কৃতির সাথে নেপাল ও তিব্বতের প্রচুর মিল আছে কারন অতীতে সিকিম, নেপালে তিব্বত সাম্রাজ্যের প্রভাব ছিল। যার জন্য নেপাল, তিব্বত, ভুটান, সিকিমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য রয়েছে। ১৬৪২ থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি সিকিম একটি স্বাধীন সাম্রাজ্য ছিল। সিকিমে ষোলো শতকে নামগিয়াল সাম্রাজ্যের রাজত্ব শুরু হয় যা পশ্চিম তিব্বতেরই ভাগ ছিল। এখানের রাজাকে চুগিয়াল বলা হত। আঠারো শতকে নেপালের গোর্খারা আক্রমন করে সিকিমকে এবং ৪০ বছর নেপালি শাসন চলে সিকিমে। সিকিমের আদি অধিবাসী ছিল লেপচা, ভুটিয়ারা যাদের ধর্ম আলাদা ছিল। নেপালী আক্রমনের পর নেপালীরা সিকিমে এসে বসবাস শুরু করে এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার হয়। যার জন্য আজও সিকিমের মোট জনসংখ্যার ৫৮ শতাংশই নেপালী বংশদ্ভূত। এরপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া সরকারের সাথে অ্যাংলো নেপাল যুদ্ধ হয় এবং নেপাল পরাজিত হয়। ফলে নেপাল ও ব্রিটিশদের মধ্যে সুগৌলির চুক্তি হয়। এই চুক্তিরই অংশ হিসাবে ১৮১৭ সালে সিকিম ও ব্রিটিশদের মধ্যে টিটালিয়া চুক্তি হয় যার মাধ্যমে সিকিমকে তার জায়গা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সেসময় ব্রিটিশদের সাথে সিকিমের খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই বন্ধুত্ব বেশীদিন যায় নি। দার্জিলিংকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশদের সাথে সিকিমের ঝামেলা শুরু হয়। দার্জিলিং চায়ের জন্য বিখ্যাত যার জন্য ব্রিটিশরা দার্জিলিং চায় সিকিমের কাছে। সিকিমের রাজা বার্ষিক ৬০০০ টাকার বিনিময়ে ব্রিটিশদের দার্জিলিং দেয়। কিন্তু কিছু সময় পর ব্রিটিশরা টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলে সিকিমের রাজা দার্জিলিংএ আক্রমন করতে থাকে। অবস্থা এতটাই খারাপ হতে শুরু করে যে ১৮৫০ ও ১৮৬২ তে দুবার ব্রিটিশসেনা সিকিমে আসে। তবে শেষপর্যন্ত ব্রিটেন আবার টাকা দেওয়া শুরু করে এবং টাকা বাড়িয়ে বার্ষিক ১২০০০ করে দেয়। তবে ব্রিটিশরা ভারতের বাকী প্রিন্সলি ষ্টেট মত সিকিমকেও তাদের অংশ হিসাবে ঘোষনা করে। অর্থাৎ সিকিমের রাজা স্বাধীন ছিল কিন্তু সব বড় সিদ্ধান্ত ব্রিটিশরাই নিত। ১৮৯০ সালে ব্রিটেন ও চীনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী চাইনিজরা সিকিমে আসবে না, তারা তিব্বত অবধিই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং ব্রিটিশরাও তিব্বতে যাবেনা।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হবার পরও অনেক প্রিন্সলি ষ্টেট ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়নি তার মধ্যে সিকিমও একটি। ২০১১ এর তথ্য অনুযায়ী সিকিমে ৮৮ শতাংশ হিন্দু, ২৩ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মের লোক রয়েছে। ১৯৪৭ সালে সিকিমের মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশই নেপালী ছিল। ১৯৪০ এর দশকে গোটা ভারতে যখন স্বাধীনতা আন্দোলন চলছিল সিকিমেও তার প্রভাব পড়েছিল। সিকিমের মানুষ সংবিধানের দাবিতে বিক্ষোভ করত। এরপর ভারত স্বাধীন হবার পর ১৯৫০ সালে সিকিমের রাজা স্যার তাশি নামগিয়াল ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর মধ্যে একটি চুক্তি হয় যাতে বলা হয় সিকিমের রাজা স্বাধীন থাকবে কিন্তু সিকিমের সব বড় সিদ্ধান্ত ভারত সরকার নেবে অর্থাৎ ব্রিটিশদের পরিবর্তে ভারত আসে সিকিমের দায়িত্বে। এছাড়াও তখন সিকিমে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন করা হয় যাতে সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয় সিকিম কংগ্রেসের কাজি লেনদুপ দর্জি। তাশি নামগিয়াল ও জহরলাল নেহেরু খুব ভাল বন্ধু ছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যে তাশি নামগিয়াল প্রায়ই বিদেশ সফরে যেতেন সেখানে তিনি সিকিমকে আলাদা দেশ হিসাবে পরিচয় দিতেন, সিকিমের জন্য আলাদা পতাকা নিয়ে যেতে, এই ব্যাপারটা ভারত সরকার মানতে পারেনি। ১৯৬৩ সালে তাশি নামগিয়াল এবং ১৯৬৪ সালে জহরলাল নেহেরুর মৃত্যু হয়। এরপর সিকিমের নতুন রাজা হয় তাশি নামগিয়ালের ছেলে প্যালডেন থনডুপ নামগিয়াল, তিনি দুটো বিয়ে করেছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন একজন তিব্বতি মহিলা এবং দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন একজন আমেরিকান যার নাম হোপ কুক। বলা হয় হোপ কুক আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএর সদস্য ছিলেন৷ সিআইএ তাকে সিকিমের দায়িত্ব দিয়েছিল। কারন সেই সময় ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ছিল। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের কারনে আমেরিকার আশঙ্কা ছিল ভারত সিকিম দখল করে নেবে। সেজন্য হোপ কুকের সাথে প্যালডেন নামগিয়ালের পরিচয় করানো হয় যদিও ১৯৬৩-৭৩ দশ বছর তাদের বিয়ে টিকেছিল। তবে এই কবছরেই হোক কুক সিকিম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক স্তরে এমন সব প্রতিবেদন লিখেছিল যা ভারত সরকারের বিরোধী ছিল।
১৯৫৭ থেকে ১৯৭২ অবধি সিকিমের আশেপাশে বেশ কিছু রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়। আগেই বলা হয়েছে সিকিমের চারদিকে তিব্বত, নেপাল, ভুটান ও পশ্চিমবঙ্গ আছে। এইসময়ে নেপাল ও পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিজম বৃদ্ধি পাচ্ছিল যা নক্সালবাদও বলা হয়। যার প্রভাবে সিকিমের সংখ্যা গরিষ্ঠ নেপালি জনসংখ্যার মধ্যে বিদ্রোহের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছিল। আবার ১৯৫৯ সালে চীন তিব্বত দখল করে নেয়। ১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধে ভারত হেরে যায়। এরপরই ভারত সরকারের আশঙ্কা হয় চীন হয়ত তিব্বত হয়ে সিকিম দখল করে নেবে। চীন তাই করারা চেষ্টা করেছিল। ১৯৬৭ সালে চোলা পাস হয়ে চীন সিকিমে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল কিন্তু দশ দিনের সংঘর্ষের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী চাইনিজ সেনাকে পিছু হটতে বাধ্য করে। সেসময় সিকিমের রাজা একটু চীন ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। ১৯৭৩ সাল থেকে সিকিমের মানুষ রাজার বিদ্রোহ ঘোষনা করে। রাজার প্যালেসের সামনে এত বিদ্রোহ হয় যে রাজ নিরাপত্তারক্ষীরা তা সামলাতে পারছিলনা। বলা হয় সিকিমে এইসব বিদ্রোহে ভারত সরকারের সমর্থনেই হচ্ছিল। এরজন্য ১৯৬৭ সালের আইপিএস ব্যাচ অজিত দোভালকে ভারতীয় ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর তরফে পাঠানো হয়েছিল সিকিমে যাতে এই বিদ্রোহ আরও বাড়ে যাতে সিকিমের রাজবংশের পতন হয়ে সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। যদিও এব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট প্রমান নেই, তবে অনেক বই ও প্রতিবেদনে এই দাবি করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে পরিস্থিতি সিকিমে এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে সিকিমের রাজা বাধ্য হয়ে ভারত সরকারের কাছে সেনা পাঠানোর অনুরোধ করে এবং এর পরিবর্তে এরপর ১৯৭৩ সালের ৮ মে ভারত সরকার ও সিকিমের রাজার মধ্যে একটি চুক্তি হয় যাতে বলা হয় ভারতের নিযুক্ত একজন সরকারি অফসারের হাতেই সিকিমের যাবতীয় প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকবে এবং সিকিমে পূর্ন ভোট হবে গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এর বিরোধীতা করেছিল সিকিমের রাজা কারন তাহলে তার আর কোন ক্ষমতা থাকবেনা কিন্তু তবুও চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল বিদ্রোহ থামানোর জন্য।
১৯৭৩ সালে সিকিমে নির্বাচনে প্রায় সব আসনে যেতে সিকিম জাতীয় কংগ্রেস যা ভারত সমর্থিত দল ছিল। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর আসতে আসতে দিল্লিতে আলোচনা হতে থাকে সিকিম এবার পুরোপুরি ভারতের অংশ হওয়া দরকার কারন সিকিমের রাজার সাথে চীনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল। সেসময় ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিল ভারতের জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো। ১৯৭৫ সালের ৯ এপ্রিল সিকিমে মিলিটারি অপারেশন শুরু করে ভারত সরকার। গ্যাংটকে সিকিমের রাজার প্রাসাদের সামনে কয়েক হাজার ভারতীয় সেনা পাঠানো হয়। সেসময় সিকিমের রাজার রক্ষী ছিল মাত্র ৩০০ জন মাত্র ৩০ মিনিটে ভারতীয় সেনা রাজার প্রাসাদ ঘিরে ফেলে রাজাকে গৃহ বন্দী করা হয়। ১০ এপ্রিলে সিকিমে সংসদস তৈরি করা হয় যাতে সিকিমে রাজার বা চোগিয়ালের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় এবং বলা হয় সিকিম ভারতের অংশ। কিন্তু বাকী বিশ্বের দেশ যাতে ভারতের দিকে আঙুল তুলতে না পারে সেজন্য পাঁচদিনের মধ্যে সিকিমে গনভোট করানো হয় যাতো ৬০,০০০ মানুষ ভোট দেয় সিকিমের ভারতে যোগদানের উপর এবং ১৪৯৬ লোক সিকিমের রাজার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। তবে সিকিমের রাজা এই ভোটের বিরোধীতা করে বলেছিল যেখানে সিকিমের এক এক অঞ্চলে পৌঁছাতেই কয়েকদিন লেগে যায় সেখানে মাত্র পাঁচদিনে ভারত সরকার কীভাবে ভোট করে, তার আরও অভিযোগ ছিল বাইরের লোকে এসে ভোট দিয়েছে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত সিকিম ভারতের অংশ হয়। ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল সংবিধানে ৩৬ তম সংশোধনী অনুযায়ী সিকিম ভারতের রাজ্য হয় এবং ২৬ এপ্রিল থেকে সরকারি ভাবে ভারতের ২২ তম রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি পায় সিকিম, তবে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ১৬ মে সিকিম ভারতের রাজ্য এতে সই করেছিল। দেখুন সিকিম ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কিন্তু তাও সিকিমকে ভারত বাধ্য হয়েছিল দখল করতে কারন সিকিমের অবস্থান স্ট্রাটেজিক্যলি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কমিউনিজমের উত্থান এবং চীনের কারনে ভারত বাধ্য হয় সিকিমকে দখল করতে কারন ভারত না করলে ভবিষ্যতে চীন সিকিমকে অবশ্যই দখল করত। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল একবার বলেছিলেন রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু হয় না, স্থায়ী জাতীয় স্বার্থ হয়। ভারতও তাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য সিকিমকে ভারতের রাজ্য করতে বাধ্য হয়েছিল।