অ্যামেরিকা

নগ্ন হয়ে অর্ধেক জ্বলে রাস্তায় ছুটে বেড়াচ্ছিল ভিয়েতনামের বাচ্চারা। কি করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র?

রাজেশ রায়:  ইতিহাসের অন্যতম লজ্জাজনক অধ্যায় হচ্ছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। যদি ইন্টারনেটে ভিয়েতনাম যুদ্ধ লিখে সার্চ করেন তাহলে এমন এমন ছবি সামনে আসবে যে মানুষ হিসাবে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসবে। সেসময় আমেরিকার হাত থেকে নিজের দেশকে রক্ষা করতে ছোট ছোট বাচ্চারাও হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। যে বয়সে হাতে পেন নিয়ে পরীক্ষা দেবার কথা সে বয়সে হাতে গ্রেনেড তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল তারা। পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপ্ত ভিয়েতনাম যুদ্ধের এমনই এক ছবি রয়েছে ইন্টারনেটে যেখানে দেখা যাচ্ছে এক বাচ্চা নগ্ন হয়ে অর্ধেক জ্বলে যাওয়া অবস্থায় রাস্তায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আসলে ওই বাচ্চাটির গ্রামে রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হামলা করেছিল আমেরিকা যাতে ওই বাচ্চাটির পড়ার কাপড় পর্যন্ত জ্বলে গেছিল এবং বাচ্চাটির শরীরের চামড়াও অনেকাংশে জ্বলে গেছিল। এই ছবি দেখে তৎকালীন সময়ে আমেরিকান সরকারের রাতের ঘুম উড়ে গেছিল। এই জন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধকে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস যুদ্ধ বলা হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধ কেন হয়েছিল, এর ফল কী হয়েছিল, বিশ্বে এর প্রভাব কেমন পড়েছিল, আমেরিকা কেন এই যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে গেছিল আজ এসব বিষয়েই পুরো বিস্তারিত আলোচনা করব। 

প্রথমেই ভিয়েতনামের ইতিহাস সম্পর্কে একটু জানা যাক। আজকের যে ভিয়েতনাম কে আমরা দেখি তা আগে আরও বড় ছিল। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস নিয়ে পুরো ভিয়েতনাম দেশ ছিল। ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এখানে সব ঠিক ঠাক ছিল। কিন্তু এই সময় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পর্তুগাল সহ ইউরোপীয়ান দেশ গুলো এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রতিযোগীতা শুরু করে। ১৮৫৮ সালে ভিয়েতনাম পৌঁছায় ফ্রান্স এবং ১৮৮৭ এর মধ্যে পুরো ভিয়েতনাম ফ্রান্সের অধীনে চলে আসে। ফ্রান্স এর নতুন নাম দেয় ইন্দো চায়না। ১৮৮৭ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত ভিয়েতনাম ফ্রান্সের অধীনে ছিল। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যাতে জাপান ভিয়েতনামের অনেক অংশ দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকালীন সময়ে জাপান এশিয়াতে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ছিল। দক্ষিণ পূর্বের একের পর এক দেশ দখল করতে থাকে জাপান। ভিয়েতনামের অর্ধেক জাপান ও বাকী অর্ধেক ফ্রান্স দখল করে। এইসময় ভিয়েতনামে হো চি মিন নামে একজন রাষ্ট্রনেতার উদ্ভব হয়। হো চি মিন ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট দল তৈরি করে।

১৯২৩ থেকে ১৯২৫ অবধি সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকা হো চি মিন কমিউনিজম আদর্শে অনুপ্রানিত হয় যার জন্য ভিয়েতনামেও কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন তিনি। হো চি মিনের লক্ষ্য ছিল ভিয়েতনাম থেকে জাপান ও ফ্রান্সকে হটিয়ে কমিউনিস্ট ভিয়েতনাম তৈরি করা। যার জন্য ১৯৩০ থেকে কাজ শুরু হয়। তবে একসাথে শক্তিশালী জাপান ও ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ করা মুখের কথা নয়। এজন্য ১৯৪১ সালের ১৯ মে হো চি মিন ভিয়েত মিন সংগঠন তৈরি করে। প্রথমে তাদের লক্ষ্য ছিল জাপানকে হারানো। এরজন্য আমেরিকা ও চীনের কাছে সাহায্য চায় হো চি মিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা ও চীনের বন্ধুত্ব ছিল। আমেরিকা ও চীনের সমর্থনে ভিয়েত মিন জাপানকে ব্যাপক টক্কর দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে যাওয়ায় জাপানি সেনা চীন ছেড়ে চলে যায়। এবারই শুরু হয় আসল ঘটনা। আগেই বলেছি ইন্দো চায়না বা ভিয়েতনামে জাপানের আগে ফ্রান্সের অধিকার ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই ফ্রান্স এই এলাকা নিজেদের বলে দাবি করতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ফ্রান্সের অবস্থা খারাপ করে দিয়েছিল, এজন্য ফ্রান্স সরাসরি ভিয়েতনামে না এসে তাদের প্রতিনিধিকে ভিয়েতনামের শাসক করতে চাইছিল। 

১৯৪৬ সালে ফ্রান্স ভিয়েতনামের গুইন রাজবংশের ১৩ তম শাসক বাও ডাইকে ভিয়েতনামের শাসক করতে চাইছিল, কারন বাও ডাই ফ্রান্সে পড়াশোনা করেছে তাই তার উপর ফ্রান্সের প্রভাব ছিল। কিন্তু হো চি মিন চাইছিল না ফ্রান্স আবার ভিয়েতনামে আসুক সেজন্য ১৯৪৬ সালে ভিয়েতমিন সংগঠন ও বাও ডাইয়ের অনুগামীদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় যাকে প্রথম ইন্দো-চীন যুদ্ধ বলা হয়। ভিয়েতনামের উত্তর অংশ যার একটা অংশ আজ লাওস এখানে হো চি মিনের সমর্থক বেশী ছিল। অন্যদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ায় ফ্রান্সের সমর্থক বেশী ছিল। ১৯৪৯ এর মধ্যে উত্তর ভিয়েতনামকে পুরোপুরি ফ্রান্স ও বাও ডাইয়ের হাত থেকে মুক্ত করে হো চি মিন কে উত্তর ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি করা হয়। অন্যদিকে বাও ডাই দক্ষিন ভিয়েতনামের প্রধান হন। বাও ডাই ও হো চি মিন দুজনেই চাইত গোটা ভিয়েতনামের পুনর্গঠন কিন্তু হো চি মিন ছিল কমিউনিস্ট নেতা এবং বাও ডাই পশ্চিমা গনতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল। এইসময় আরও একটি ঘটনা ঘটে ১৯৪৯ সালে চীনে গৃহযুদ্ধ শেষ হয় এবং মাও জেডং এর কমিউনিস্ট দল জয় লাভ করতে থাকে।

চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর ভিয়েতনামকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে থাকে। এদিকে ১৯৫০ সাল থেকে আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনাম কে সাহায্য করতে থাকে। কারন সেসময় গোটা বিশ্ব দুভাগে ভাগ হয়ে যায় আমেরিকা বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের কারনে। ১৯৫৪ সালে উত্তর ভিয়েতনাম দক্ষিণ ভিয়েতনাম কে পরাস্ত করে, যার ফলে ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনাম তৈরি হয়। কারন উত্তর ভিয়েতনাম ক্রমান্বয়ে সাহায্য পেতে থাকে রাশিয়া ও চীন থেকে। ভিয়েত মিন সংগঠনের সেনারা গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী ছিল। তাছাড়া গোটা উত্তর ভিয়েতনামের বাচ্চা থেকে শুরু করে মহিলা সবাই হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। এরপর বাধ্য হয়ে ফ্রান্সকে ভিয়েতনামের সাথে শান্তি চুক্তি করতে হয়। ১৯৫৪ সালের ২৬ এপ্রিল ফ্রান্স ও ভিয়েতনামের মধ্যে যে শান্তি চুক্তি হয় তার নাম জেনেভা চুক্তি। ভিয়েতনামে যুদ্ধ থামাতে হওয়া এই জেনেভা চুক্তিতে বলা হয় উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিন ভিয়েতনাম নামে দুটি দেশ তৈরি হবে। এই দুই দেশ ঐক্যবদ্ধ বদ্ধ হবার জন্য ১৯৫৬ সালে ভোট হবে। তবে এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার ফ্রান্স ১৯৪৯ সালে ভিয়েতনামের মূল ভূখন্ড বা ইন্দো চীনকে ভেঙে লাওস এবং ১৯৫৩ সালে কম্বোডিয়া নামে দুটি দেশ তৈরি করে। এবার মনে করা হয়েছিল সব বোধহয় ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু এটা ছিল শুধু শুরু। ১৯৫৫ সালে বাও ডাই কে সরিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের নতুন রাষ্ট্রপতি হয় নাও ড্যান ডিয়াম। আমেরিকা তাকে সাহায্য করে। এবার আপনাদের মনে হতেই পারে দক্ষিণ ভিয়েতনামে পশ্চিমা সমর্থিত বাও ডাই তো ক্ষমতায় ছিলই হঠাৎ তাকে পরিবর্তনের কী দরকার পড়ল?

দেখুন এই সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন যেসব দেশে কমিউনিস্ট সরকার তৈরি করছিল আমেরিকা সেইসব সরকার ভেঙে দেবার চেষ্টা করছিল। ১৯৫৬ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হবার ভোট ছিল। আমেরিকার আশঙ্কা ছিল যদি এমন হয় তাহলে হয়ত গোটা ভিয়েতনামই কমিউনিস্ট দেশ হয়ে যাবে। সেজন্য আমেরিকা তাদের সমর্থিত ড্যান ডিয়ামকে রাষ্ট্রপতি করে। ১৯৫৫ থেকে আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনাম কে অস্ত্র ও অর্থ দিতে থাকে। এমনকী আমেরিকা ভিয়েতনামে তাদের সেনা ও মিলিটারি এক্সপার্টদের ও পাঠায়। ড্যান দিয়াম ছিল ক্যাথলিক খ্রীষ্টান। এদিকে ভিয়েতনামের অধিকাংশ বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। যার জন্য ড্যান ডিয়াম নিজের দেশবাসীদের উপরই অত্যাচার করতে থাকে। সাথে সাথে ভিয়েতমিনের সদস্যদের গ্রেফতার করে। প্রায় এক লক্ষ লোককে গ্রেফতার করা হয়। বৌদ্ধদের উপর এতটাই অত্যাচার করা হয় কীছু বৌদ্ধ ভিক্ষুক প্রকাশ্য রাজপথে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার পরেও অত্যাচার চলতেই থাকে। ১৯৫৬ সালে হতে চলা ভোটও ড্যান ডিয়াম বন্ধ করে দেয়। হো চি মিন এতদিন চুপচাপ ছিল কিন্তু ভোট বন্ধ করে দেওয়ায় এবার তিনিও সিদ্ধান্ত নেন এবার যুদ্ধ করবার। উত্তর ভিয়েতনাম সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সাহায্যে লাওসের মাধ্যমে গোপনে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ভিয়েত মিনের সদস্যদের অস্ত্র পাঠাতে থাকে। এই সব গোপন পথ গুলোকে হো চি মিন ট্রায়াল বলা হত। শুরু জয় ভিয়েত মিন ও ড্যান ডিয়ামের সরকারের মধ্যে গেরিলা যুদ্ধ।

আমেরিকা ১৯৫৪ সাল থেকেই দক্ষিণ ভিয়েতনামে তাদের সেনা পাঠাতে শুরু করে। তখন প্রায় ৮০০ আমেরিকান সেনা দক্ষিন ভিয়েতনামে ছিল। ১৯৫৯ আসতে আসতে এই সংখ্যাটা বেড়ে দাড়ায় প্রায় ৯০০০. আমেরিকান রাষ্ট্রপতি আইসেনআওয়ার একবার ভিয়েতনাম সম্পর্কে বলেছিলেন ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট হলে তা ডোমেইন এফেক্ট করবে। এই ডোমেইন এফেক্ট কী জিনিস বলি, যদি কোন দেশে গনতন্ত্রের পতন হয়ে কমিউনিস্ট শাসন আসে তাহলে তার দেখা দেখি বাকী দেশ গুলোতেও কমিউনিস্ট সরকার আসবে ক্ষমতায়। সেজন্য আমেরিকা যেন তেন প্রকারে ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট শাসন বন্ধ করতে চেষ্টা করছিল। দক্ষিণ ভিয়েতনামে নিযুক্ত আমেরিকান এক্সপার্টরা উত্তর ভিয়েতনামের জঙ্গলে এজেন্ট অরেঞ্জ কেমিক্যাল দিয়ে আক্রমন করে, একে অপারেশন রেড হান্ট বলা হয়। কারন ভিয়েতনাম জঙ্গল, নদীতে পরিপূর্ণ। ভিয়েত মিনরা এই জঙ্গলে লুকিয়ে যুদ্ধ করত যার জন্য ফ্রান্সও বাধ্য হয়ে হেরে যায়, তাই আমেরিকা জঙ্গল জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য রাসায়নিক হামলা করতে থাকে। ১৯৬২ সালে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির নেতৃত্বে এই অপারেশন করা হয়। এরপর আমেরিকাতে জন এফ কেনেডির হত্যার পর নতুম আমেরিকান রাষ্ট্রপতি হন লিন্ডন বি জনসন। তবে এর আগে দক্ষিন ভিয়েতনামের অত্যাচারী রাষ্ট্রপতি ড্যান ডিয়াম ও তার ভাইকে আমেরিকাই হত্যা করে কারন ততদিনে দক্ষিণ ভিয়েতনামের মানুষই ড্যান ডিয়ামের বিরোধীতা করছিল। 

আমেরিকা ভিয়েতনামে সরাসরি আক্রমন করতে পারছিল না কারন তাহলে গোটা বিশ্বের কাছে আমেরিকার নামে বদনাম হবে। সেজন্য আমেরিকা একটি পরিকল্পনা করল, ১৯৬৪ সালের ২ আগস্ট উত্তর ভিয়েতনামের কাছে গল্ফ অফ টংকেনে আমেরিকার নৌবাহিনীর একটি জাহাজে কীছু ভিয়েতমিন আক্রমণ করে যাতে কীছু আমেরিকান সেনা মারা যায় যারপর আমেরিকান রাষ্ট্রপতি লিন্ডেন বি জনসন সরাসরি উত্তর ভিয়েতনাম আক্রমনের নির্দেশ দেয়। আসলে গল্ফ অফ টংকেন পুরোপুরি আমেরিকার সাজানো নাটক ছিল বলে মত সামরিক বিশেষজ্ঞদের যাতে ভিয়েতনাম আক্রমন করা যায়। তবে গোটা উত্তর ভিয়েতনাম জুড়ে ভিয়েত মিনরা প্রচুর সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিল যাতে লুকিয়ে থাকত তারা, এখানেই রান্না করত, এখানেই তাদের অস্ত্রের গুদাম ছিল। এখান থেকে বেড়িয়ে অতর্কিতে আক্রমন করত আমেরিকার সেনার উপর। আমেরিকা ১৯৬৫ এর মধ্যে তাদের প্রায় ৫০,০০০ সেনা ভিয়েতনামে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমেরিকাকে দেখে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন আরও বেশী করে সাহায্য করতে শুরু করে উত্তর ভিয়েতনামকে। ১৯৬৫ সালে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি লিন্ডেন বি জনসন অপারেশন রোলিং থান্ডারের নির্দেশ দেয় যাতে তিন বছর ধরে উত্তর ভিয়েতনামের উপর বোম্বিং করা হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের উপর আমেরিকা যা বোম্বিং করেছিল তার চারগুন বোম্বিং ভিয়েতনামে করেছিল, তাও ভিয়েতনামকে হারাতে পারে নি আমেরিকা। ভিয়েতনামের সেনারা জঙ্গলে লুকিয়ে হামলা করত সেজন্য আমেরিকা রাসায়নিক হামলা শুরু করে। নেপাম কেমিক্যাল ও এজেন্ট অরেঞ্জ কেমিক্যাল আমেরিকার বিমান ভিয়েতনামের জঙ্গলে ফেলত।

নেপাম কেমিক্যাল জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিত, এজেন্ট অরেঞ্জ কেমিক্যাল জঙ্গলে গাছের সমস্ত পাতা ঝড়িয়ে দিত যাতে ভিয়েতনামের সেনাদের সহজেই দেখা যায়। এতে ভিয়েতনামি সেনাদের পাশাপাশি প্রচুর সাধারন মানুষের মৃত্যু হয়। যার অসংখ্য ছবি আমেরিকান মিডিয়াতে প্রকাশ হয় যার জন্য গোটা আমেরিকা জুড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধী জন বিক্ষোভ শুরু হয় কিন্তু তবুও আমেরিকা আক্রমন করতেই থাকে ভিয়েতনামে। এরই মাঝে একটি ঘটনা ঘটে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারী মাসে উত্তর ভিয়েতনামের সেনা গোপনে এক রাতেই দক্ষিন ভিয়েতনামের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এবং আমেরিকার বিভিন্ন মিলিটারি বেসে আচমকা হামলা করে যাতে প্রায় ৫৮০ জন আমেরিকান সেনা মারা যায়, ইতিহাসে এই ঘটনা টেট অফেন্সিভ নামে পরিচিত। এরকম ১২০ বার রাতে আচমকা হামলা করা হয় আমেরিকার উপর যাতে প্রায় ১৫৮০ জন আমেরিকান সেনা মারা যায়। হতবাক আমেরিকা এই ঘটনার পর প্রায় পাঁচ লাখ সেনা ভিয়েতনামে পাঠিয়ে দেয়। আমেরিকা এর প্রতিশোধ নিতে উত্তর ভিয়েতনামের মাই লাই নামে একটি গ্রামে নরসংহার শুরু করে যাতে বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা সবাইকে হত্যা করা হয়। এক আমেরিকান পাইলট হিউজ থমসন এই ঘটনা দেখে হতভম্ব হয়ে যান তিনি তার হেলিকপ্টারে করে কিছু আহত ভিয়েতনামবাসীকে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর হিউজ থমসন কে আমেরিকা দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তার শাস্তি দেন কিন্তু আমেরিকার মানুষ হিউজ থমসনকে জাতীয় বীর মনে করত। অবস্থা এমন হয়েছিল যে আমেরিকান সেনারা ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে ভয় খাচ্ছিল। আমেরিকান সেনা নিজেদের যুদ্ধ সামগ্রী নষ্ট করতে থাকে যাতে যুদ্ধে যেতে না হয়। আমেরিকার সেনাকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও তারা জিতে গেছিল কিন্তু ভিয়েতনামের মতন যুদ্ধ কোনওদিন তারা লড়েনি। 

ভিয়েতনামের গভীর জঙ্গল, উঁচু পাহাড়, অসংখ্য নদী এবং ঘাতক ভিয়েত মিন সেনা রীতিমতো নরক দর্শন করিয়ে দিয়েছিল আমেরিকার সেনাকে৷ সেই সময় আমেরিকায় একটা নিয়ম ছিল যে দরকার পড়লে প্রত্যেক আমেরিকান যুবককে যুদ্ধে যেতে হবে তাই অনেক আমেরিকান যুবক ভয়ে কানাডা পালিয়ে গেছিল। আমেরিকার মানুষ রীতিমতো রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছিল। এই সময় আমেরিকার মিলিটারি হেডকোয়ার্টার পেন্টাগনের ভিয়েতনাম যুদ্ধ সংক্রান্ত  ৪০০ পাতার একটি গোপন নথি ফাঁস হয়ে যায় যাতে বলা হয়েছিল কী ভাবে আমেরিকান সরকার ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু করেছিল মানুষকে ভুল বুঝিয়ে। এরপর আমেরিকায় সরকার বিরোধী আন্দোলন আরও তীব্র হয়। এর সুযোগ নিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ করার কথা বলে ১৯৬৯ সালে আমেরিকার সাধারন নির্বাচনে রিচার্ড নিক্সন জয়লাভ করে। রিচার্ড নিক্সন গোপনে ১৯৭০ সালে অপারেশন মেনু শুরু করে যাতে কম্বোডিয়া ও লাওসের উপর বোম্বিং শুরু করে আমেরিকা। এসব জায়গায় গোপন হো চি মিন ট্রায়াল গুলোকে বন্ধ করার জন্য আমেরিকা এই বোম্বিং শুরু করে।

১৯৭০ সালে রিচার্ড নিক্সন একটি পলিসি আনেন যাকে বলা হয় ভিয়েতনামি করন। এই নীতি অনুযায়ী ধীরে ধীরে ভিয়েতনাম থেকে সেনা সরিয়ে নেবে আমেরিকা এবং তার বদলে স্থানীয় দক্ষিন ভিয়েতনামি সেনারা লড়াই করবে। ১৯৭২ আসতে আসতে ভিয়েতনামে থাকা আমেরিকান সেনার সংখ্যা পাঁচ লাখ থেকে কমে ৬৯,০০০ হয়ে যায়। এসময় উত্তর ভিয়েতনামি সেনারা দক্ষিন ভিয়েতনামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তিনটি বড় আক্রমন করে বেশ কিছু জায়গা দখল করে নেয় যাকে এস্টার অফেন্সিভ বলা হয়। আমেরিকার এই হামলার অনুমান করতে পারে নি। এর জবাবে আমেরিকা ভিয়েতনামে তাদের শেষ অপারেশন শুরু করে যাকে অপারেশন লাইন ব্রেকার বলা হয়। এতে আমেরিকা উত্তর ভিয়েতনামের উপর ব্যাপক বোম্বিং করে কিন্তু তাতেও আমেরিকার কিছু লাভ হয় নি। এরপর ১৯৭৩ সালের ২৭ জানুয়ারী উত্তর ভিয়েতনাম, দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও আমেরিকার মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি হয় যাকে প্যারিস শান্তি চুক্তি বলা হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা ভিয়েতনাম থেকে তাদের বাকী সেনা সরিয়ে নেয় এবং উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে শান্তি সমঝোতা হয়। ১৯৭৫ সালের মধ্যে আমেরিকা তাদের সমস্ত সেনা ভিয়েতনাম থেকে সরিয়ে নেয়, এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে উত্তর ভিয়েতনাম কিছুমাস পরেই দক্ষিণ ভিয়েতনামের উপর আক্রমন শুরু করে। ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাইগন শহর দখল করে নেয় এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম আত্মসমর্পন করে দেয়। ভিয়েতনামের নতুন নাম হয় সোশালিস্ট রিপাবলিক অফ ভিয়েতনাম। সাইগন শহরের নতুন নাম হয় হো চি মিন। ভিয়েতনামের রাজধানী হয় হ্যানয়। কমিউনিস্ট দেশ হয় ভিয়েতনাম। 

ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার প্রায় ৫৮,০০০ সেনা মারা গেছিল যা আমেরিকার জন্য একটি লজ্জাজনক ব্যাপার ছিল। কারন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ৪৯,২০০ সেনা মারা গেছিল, ভিয়েতনাম যুদ্ধে এর থেকেও বেশী জন মারা যায়। উত্তর ভিয়েতনামের ১১ লাখ সেনা, দক্ষিণ ভিয়েতনামের ২,৫০,০০০ সেনা এই যুদ্ধে মারা যায়। উভয় ভিয়েতনামের প্রায় ২০ লাখ সাধারণ মানুষ মারা যায় এই যুদ্ধে। প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ভিয়েতনাম বাসী অন্য দেশে পালিয়ে যায়। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ এই নয় বছরে আমেরিকা প্রতি আট মিনিট অন্তর একটি করে বোম্ব ফলে ভিয়েতনামে। ভিয়েতনামে আমেরিকা প্রায় ২৬০ মিলিয়ন ক্লাস্টার বোম্ব ফেলেছিল। এই যুদ্ধে আমেরিকার প্রায় ১৬৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গেছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ গোটা বিশ্বের সামনে এটা প্রমান করেছিল শুধু আধুনিক অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ করা যায় না। ভিয়েতনাম যুদ্ধ আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম লজ্জাজনক পরাজয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.