ভুটানে কেন ভারতবর্ষের সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে জানেন?
রাজেশ রায়:- ভারতের যত প্রতিবেশী আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক আছে একমাত্র ভুটানের সাথে। বাকী মায়ানমার, নেপাল, বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের সাথে অতীতে না হয় বর্তমানে কিছু না কিছু ঝামেলা আছেই ভারতের। একমাত্র ভুটান অনন্য। বলা হয় দক্ষিন এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এমন উদাহারন খুব কমই আছে। ভৌগলিক ভাবে ভুটানের অবস্থান এমনই যে ভারত ও চীন উভয়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ ভুটান। ভুটান ও ভারতের সম্পর্কে লাভ কার বেশী ভুটান নাকী ভারতের। সময়ের সাথে সাথে ভুটানে, ভারতে এবং দক্ষিন এশিয়াতেও রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে, এমনকী বিশ্ব রাজনীতিতেও অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে এর প্রভাব ভারত ও ভুটানের সম্পর্কে কীভাবে পড়েছে! এসম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
ভারত ভুটান সম্পর্কের জন্য চীনের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। চীনের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মাও জে ডং এর নীতি অনুযায়ী সিকিম, নেপাল, ভুটান, তিব্বত, অরুনাচল প্রদেশ চীনেরই অংশ। তিব্বত ইতিমধ্যেই চীন দখল করে নিয়েছে সুতরাং ভুটানেও চীন আক্রমন করতে পারে এমন সম্ভবনা থেকেই যায়। এবার আপনারা ভাববেন ব্রিটিশরা ভারতে রাজত্ব করত তাহলে ভুটান কেন দখল করলনা! ব্রিটিশরা ভুটানেও গেছিল কিন্তু উচ্চ পার্বত্যঞ্চলে অবস্থিত হবার কারনে এখান থেকে ব্রিটিশদের কোন লাভ হতনা তেমন সেজন্য ভুটানকে বাফার স্টেট হিসাবে ঘোষনা করে ব্রিটেন। দুটো বড় দেশের মধ্যবর্তী ছোট দেশকে বাফারদেশ বলে। ভারত ও ভুটানের ইতিহাস বলা হলে প্রথমেই আসে বৌদ্ধ ধর্মের কথা। ভুটানের ৭৫ শতাংশ লোক বৌদ্ধ ধর্মের। ভুটানের প্রধান ভাষা জংফা। ভুটানিরা বিশ্বাস করে ভারত থেকে তারা সবচেয়ে বড় উপহার পেয়েছে বৌদ্ধধর্ম। আট শতকে গুরু পদ্মসম্ভাব ভুটানে গেছিল বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতে। তবে বলা হয় ভারত ও ভুটান দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বৌদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করে যতটা দরকার ততটা সুবিধা এখনও নিতে পারেনি। বিশ্বের সমস্ত বৌদ্ধধর্মালম্বী ভারতবর্ষকে তাদের কেন্দ্র মানে। তবে আজকের যে ভুটান তা কিন্ত সতেরো শতকে ছিলনা। সতেরো শতকে উত্তর পূর্ব ভারত, নেপাল, সিকিম এবং কোচবিহার জেলাগে ভুটানের প্রভাব ছিল। এরপর ব্রিটিশরা চীনে প্রবেশের জন্য সিকিম সহ উত্তর পূর্ব ভারতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং ১৮৬৪-৬৫ সালে অ্যাংলো ভুটান যুদ্ধ হয় যাতে ভুটান পরাজিত হয়। এরপর ভুটান ও ব্রিটিশদের মধ্যে সিনচুলার চুক্তি হয়।
চুক্তি অনুযায়ী ভুটান তার কিছু অংশ ব্রিটেনকে দিয়ে দেয় বদলে ব্রিটিশরা ৫০,০০০ টাকা দেয়। এই চুক্তিতে আরও বলা হয় ভুটানের আভ্যন্তরীন কোন ব্যাপারে ব্রিটিশরা হস্তক্ষেপ করবেনা কিন্তু ভুটানের বিদেশনীতি ব্রিটিশরা দেখবে এবং ভুটানের নিরাপত্তাও ব্রিটিশরা দেখবে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারতকে স্বীকৃতি দেয় ভুটান। সেই থেকেই ভারত ও ভুটানের সম্পর্কের শুরু। ১৯৪৯ সালে ভারত ও ভুটানের মধ্যে বন্ধুত্বের চুক্তি হয় মূলত ১৮৬৫ সালের ব্রিটিশ ভুটান চুক্তির মতই এই চুক্তি অনুযায়ী ভুটানের নিরাপত্তা ও বিদেশনীতি ভারতই দেখে। ভুটানের সিভিল সার্ভিস অফিসারদের ভারতের আমলাদের মতই মুসৌরির লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতেই প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। ভারতের প্রতি ভুটানের দৃষ্টিকোনকে তিনভাগে ভাগ করা যায় :– ১) আভ্যন্তরীন ২) আন্তর্জাতিক ৩) অর্থনৈতিক। প্রথমে আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে জানা যাক। ভুটান সংশয়ে ছিল ভারত তাদের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে কীনা কারন ভুটানে রাজবংশ আছে। সিকিমেও এমন ছিল পরে সিকিম ভারতের অংশ হয় তাই ভুটান একটু সংশয়ে ছিল প্রথমে যদিও ১৯৪৯ এর চুক্তিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে ভুটানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করবে কীনা। এছাড়া ভুটানে নেপালী বংশদ্ভূত লোক অনেক বাস করে ভুটান এটা এখনও চিন্তা করে অতিরিক্ত নোপালী জনসংখ্যা বেড়ে গেলে হয়ত গ্রেটার নেপাল গঠন হবে কিংবা কীছু জায়গা স্বায়ত্তশাসন চাইবে যেমন পশ্চিমবঙ্গে গোর্খাল্যান্ডের দাবি ওঠে।
এবার যদি আন্তর্জাতিক কথা বলা হয় তাহলে ভুটান দীর্ঘদিন একটি বিচ্ছিন্ন দেশ হিসাবে ছিল। গোটা বিশ্ব যখন আর্থিক উন্নতি, শিল্প প্রতিষ্ঠান, জিডিপির পেছনে ছুটছে তখন আজও ভুটান বাকী বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ভুটানিরা তাদের সংস্কৃতি ও পরিবেশের ব্যাপারেই বেশী আগ্রহী। বাকী বিশ্বের প্রভাব যাতে ভুটানে না পড়ে সেজন্য ভুটান দীর্ঘদিন নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছিল তবে ভুটান জানত বেশীদিন এটা সম্ভব হবে না। কারন তিব্বত চীন দখল করে নিয়েছে এবং ভুটানেরও সেই হাল হতে পারে সেজন্য ভুটান শক্তিশালী বন্ধু হিসাবে ভারতকে বেছে নেয়।
১৯৭০ এর দিকে ভারত জাতিসংঘে স্বাধীন দেশ হিসাবে ভুটানের অন্তর্ভুক্তিতে সাহায্য করে। সার্ক, বিমস্টেকের মতন গ্রুপে ভারত ভুটানকে যুক্ত করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত ভুটানকে প্রচুর সাহায্য করেছে। ভুটান পুরোপুরি একটি ল্যান্ডলকড দেশ যার জন্য বানিজ্যের কারনে পুরোপুরি ভারতের উপর নির্ভরশীল। ১৯৪৭ সালের পর ভুটানের প্রথম দুটি পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনাতে ভারত পুরো অর্থায়ন করেছিল। ভুটানের প্রায় সব জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ভারত নিজের অর্থে তৈরি করেছে। ১৯৬১ সালে ভারতের বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন অপারেশন দন্তক শুরু করে যাতে ভুটানে ব্যাপক ইনফ্রাস্ট্রাকচার, রাস্তা নির্মান করে ভারত। ১৯৭২ সালে ভুটানের সাথে ভারতের বানিজ্যিক চুক্তি হয় যাতে বলা হয় ভারতের মাটি ব্যবহার করে ভুটানের বানিজ্যে ভারত কোন কর নেবে না। উঁচু পার্বত্য অঞ্চল এবং অগনিত নদীর কারনে ভুটানে সবচেয়ে বেশী সম্ভবনা আছে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের। ভুটানের জিডিপির ৪০ শতাংশই আসে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। সেজন্য ২০০৭ সালে ভারত ও ভুটানের মধ্যে চুক্তি হয়। ভারত ১০,০০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার লক্ষ্য নিয়েছে ভুটানে যাতে ভুটানের পাশাপাশি আসাম ও পশ্চিমবঙ্গেও বিদ্যুৎ আসে।
ব্রিটিশরা ভুটানকে চীনে প্রবেশের জন্য বানিজ্য পথ হিসাবে ব্যবহার করত। এখান দিয়ে ব্রিটিশরা আফিম রপ্তানি করত চীনে। এই ঘটনার পরই চীন ভুটানকে নিজেদের বলে দাবি করে জানায় এখানে বানিজ্য পথ করতে তাদের অনুমতি লাগবে, কিন্তু ব্রিটিশরা চীনের কথা শোনেনি৷ ভুটানের অবস্থান স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভারতের জন্য। ভারতের শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন নেকের মাধ্যমে উত্তর পূর্ব ভারতে সংযোগ বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভুটান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য চীন ভুটান দখল করলে চিকেন নেককে আলাদা করে দিতে পারে। সেজন্য জহরলাল নেহেরু সংসদে ঘোষনা করে ভুটানকে আক্রমন করার অর্থ ভারতকে আক্রমন করা। সেজন্য ভারত নিজের স্বার্থে ভুটানে প্রচুর বিনিয়োগ করে যাতে উত্তর পূর্ব ভারতকে রক্ষা করা যায়। জহরলাল নেহেরু এজন্য ঘোষনা করেছিল ভুটানকে রক্ষা করার জন্য যা যা দরকার ভারত সব করবে।
১৯৬২ সালের ভারত চীন যুদ্ধে ভারত পরাজিত হয় এর জন্য ভুটান ভারতের উপর থেকে খানিকটা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। ভুটানের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল ভারতের উপর কিন্তু ভারতই হেরে যেতে ভুটানের ভারতের সক্ষমতার উপর সন্দেহ এসে যায় এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে মাত্র ১৪ দিনে পাকিস্তানকে পরাজিত করে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে বাংলাদেশ গঠন করে ভারত। এতে ভুটান আবার বিশ্বাস ফিরে পায় ভারতের ব্যপারে। তবে এই হার শুধু পাকিস্তানের নয় সেসময় বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল। পাকিস্তানের সমর্থনে আমেরিকা, চীন, অনেক ইউরোপীয়ান দেশ ছিল তা সত্বেও পাকিস্তান হেরে যেতে ভুটানের ভারতের সক্ষমতা সম্পর্কে আর কোন চিন্তাই থাকেনা।
ভারতই হচ্ছে ভুটানের সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক পার্টনার। ভুটান তাদের রপ্তানির ৯৮ শতাংশ ভারতে করে এবং ৯০ শতাংশ আমদানি ভারত থেকেই করে। সুতরাং ভারতকে ছেড়ে চীনকে সমর্থন ভুটানের পক্ষে সম্ভব নয়। ভুটানের পন্যের উপর ভারত কোন কর বসায় না যাতে ভুটানের আর্থিক বিকাশ ঘটে। মূলত বিদ্যুৎ, লোহা এবং সিমেন্ট ভারতে রপ্তানি করে ভুটান তবে এছাড়াও অন্যান্য জিনিস আছে তবে এই তিনটিই প্রধান।
ভুটানে সিমেন্ট শিল্প গড়ে উঠেছে ভারতেরই সাহায্যে। ভুটানের মোট পর্যটকের ৬৫ শতাংশই ভারত থেকে আসে। ভুটান ও ভারতের মধ্যে যেতে আসতে কোন ভিসা লাগে না, আগে ভুটানে ভারতীয় পর্যটকদের জন্য কোন টাকা লাগত না কিন্তু এখন প্রতিদিন ১২০০ টাকা করে লাগে ভারতীয় পর্যটকদের জন্য। এটা শুনতে অবাক লাগলেও ভারত, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ছাড়া অন্য কোন দেশ থেকে পর্যটক ভুটানে গেলে ২৫০ ডলার দিনপ্রতি লাগে। এবার শুনে মনে হতে পারে ভুটান এত পয়সা কেন নেয়, পর্যটক এলে তো আর্থিক লাভ ভুটানেরই হবে। আসলে ভুটান চায়ই না তাদের দেশে বেশী পর্যটক আসে। প্রকৃিতির ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ভুটানের লক্ষ্য পর্যটন শিল্পের কারনে যেন তাদের সংস্কৃতি ও প্রকৃতি নষ্ট না হয়। ভারতের চারটি রাজ্য আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম ও অরুনাচল প্রদেশের সাথে ভুটানের সীমানা আছে। ভুটানের চুম্বী উপত্যকার ডোকলামকে নিয়ে ভুটান ও চীনের মধ্যে ঝামেলা আছে। চীন এই জায়গার দখল নিতে চায় যার জন্য ২০১৭ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে এখানে ঝামেলা হয় কারন ডোকলাম থেকে চীন শিলিগুড়ি করিডরের উপর নজর রাখবে সেজন্য এই জায়গা ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতি ও নেবারহুড ফাস্ট নীতি উভয়তেই ভুটান আছে। পশ্চিম ভুটানে স্থায়ী ভাবে ২০০০ ভারতীয় সেনাকে পাঠানো হয়েছে যারা রয়েল ভুটান সেনাকে প্রশিক্ষন দেয়। বহুসংখ্যক ভুটনাী শিক্ষার্থীকে ভারত স্কলারশিপ দেয় এবং ভুটানের সায়েন্স, টেকনোলজি সেক্টরে ভারত সাহায্য করছে। ইসরো ভুটানে একটি গ্রাউন্ড স্টেশনও তৈরি করছে।