স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার নারীদের ভূমিকা জানেন?
স্বাধীনতা সংগ্রাম এই সংগ্রাম ছিল সারা দেশের মানুষের সংগ্রাম। তাই এই সংগ্রামে পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরাও লড়ে গিয়েছিলেন তাদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। এই অগ্নিকন্যাদের মধ্যে অন্যতম হলে কমলা দাশগুপ্ত। যিনি একজন বিপ্লবী হওয়ার পাশাপাশি লেখিকাও। তারই লেখা গ্রন্থ ‘ স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার নারী’ মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছিলেন ভারতের মহীয়সী নারীদের আত্মত্যাগের কাহিনী।
১৯০৭ সালে ঢাকার বিক্রমপুরে এক বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কমলা দাশগুপ্ত। তিনি লেখিকা হওয়ার পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী তথা জাতীয় কংগ্রেসের নেত্রীও ছিলেন। তিনি ১৯২৪ সালে ঢাকার ব্রাহ্মবালিকা শিক্ষালয় থেকে প্রবেশিকা পাশ করার পর তার পরিবার চলে আসে কলকাতায়। এরপর তিনি ভর্তি হন কলকাতার বেথুন কলেজে। ১৯২৮ সালে তিনি বেথুন কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রি অর্জন করে ইতিহাস বিষয়ে এম এ করতে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তৎকালীন সময়ে কলকাতার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের। এই প্রভাবে তিনিও প্রভাবিত হয়েছিলেন। আর ঠিক সে সময় তাঁর সাথে বেশ আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে উঠে যুগান্তর দল এর গোটা কয়েক সদস্যের সাথে। এরপর তিনি শুরু করে বিপ্লবী দীনেশ মজুমদারের কাছে লাঠিখেলার শিক্ষা নিতে। গান্ধীর অহিংসবাদ বিশ্বাসী কমলা দেবী সেই পথ ত্যাগ করে ১৯২৯ সালে যুগান্তর দলের নেতা রসিকলাল দাসের অনুপ্রেরণায় যোগ দেন সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য যুগান্তর দলে সাথে। আর এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায়।
দলের নির্দেশে তিনি ১৯৩০ সালে নিজের বাড়ি ত্যাগ করেন। এরপর গড়পার রোডের এক মহিলা হোস্টেলে ম্যানেজারের চাকরিতে নিযুক্ত হন। সেখানে বিপ্লবীদের জন্য বোমা ও অস্ত্র লুকিয়ে রাখাই ছিল তাঁর মূল কাজ। সেই মতোই চলছিল তাঁর এই কাজ। এরই মধ্যে বোমা হামলার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়ে তবে প্রমাণের অভাবে তাঁকে মুক্তিও পেয়ে যান বারবার। তবে ডালহৌসি স্কোয়ার ষড়যন্ত্র মামলায় দায়ে তাঁকে ২১ দিনের জন্য কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল।
যার জন্য তাঁর হোস্টেলের চাকরি চলে যায়। তবে তিনি তো আর থেমে থাকার মেয়ে নয়। ১৯৩২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে এক বিস্ময়কর ঘটনা। সেই সমাবর্তন উৎসবে ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন বিপ্লবী বীণা দাস। আর বীণা দাস সেই রিভলবার সরবরাহ করেছিলেন কমলা দেবী। যার কারনে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করেছিলেন ব্রিটিশ পুলিশ। তবে প্রমাণের অভাবে তিনি আবারও মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলেন। বারবার প্রমানের অভাবে মুক্তি পেলেও ১৯৩৩ সালে তাঁকে প্রমাণসহ গ্রেফতার করে পুলিশবাহিনী। প্রথমে তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠায় তারপর স্থানান্তরিত করে মেদিনীপুরের হিজলি জেলে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে রাজবন্দী হিসেবে বেশ কিছু দিন কাটাতে হয়েছিল। এরপর ১৯৩৬ সালের মুক্তি লাভ করেন। মুক্তি লাভের পর গৃহবন্দী হিসাবে কাটিয়ে ছিলেন বেশ কিছু বছর।
এরপর তার জীবনে আসে এক নতুন অধ্যায়। যিনি এতদিন দেশের জন্য সরাসরি লড়ায় করে গিয়েছিলেন তিনি ঠিক করেন যে এবার তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে মানুষের মনে জাগিয়ে তুলবেন দেশপ্রেম। শুরু করেন তিনি লেখা লেখির কাজ। ১৯৩৮ সালে মহিলাদের পত্রিকা মন্দিরা সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৪১ সালে বঙ্গীয় প্রদেশ মহিলা কংগ্রেসের সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন তিনি। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় তাঁকে পুনরায় প্রায় চার বছরের জন্য কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল। এরপর রিলিফ কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হন তিনি। মূলত বার্মিজ রিফিউজিদের জন্য এই রিলিফ কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে জড়িত ছিলেন। গান্ধীর নির্দেশে ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সময়ে নোয়াখালীতে রিলিফ ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব পান তিনি। এরপর তিনি কলকাতার আদর্শ হিন্দি হাই স্কুলে ১৯৪৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছিলেন। দলীয় কাজের পাশাপাশি তিনি লেখালেখির কাজও করতেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির কাজ করতেন। ১৯৫৪ সালে তাঁর আত্মজীবনী রক্তের অক্ষরে নামের একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। এরপর ১৯৬৩ সালে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী নামে আরেকটি গ্রন্থ লিখেন।
২০০০ সালের ১৯ শে জুলাই কমলা দাশগুপ্ত মৃত্যুবরন করেন।