ভারত

১৯৭১ এ হিন্দুরা বাংলাদেশ ছেড়ে কেন পালিয়ে গেছিল?

সোহিনী সরকারঃ কর্নেল অনিল এ আথালে উল্লেখ করেছেন- ভারতের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় হাজার বাঁধা বিপত্তি সত্ত্বেও ভারত কিন্তু ঠিকই জোড়া হুমকির সম্মুখীন হলে বিজ্ঞতার সাথে সঠিক মিত্র নির্বাচন করতে সফল হয়।

৯ আগস্ট দিনটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ১৯৪২ সালের ঠিক এই দিনটিতেই মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন।

এর ২৯ বছর পর আবার ঠিক এই একই দিনে ভারত তিন মাস ধরে সংঘটিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবময় বিজয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে একটি ‘শান্তি ও বন্ধুত্ব’ এর চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দলে দলে বাংলাদেশী হিন্দু পাকিস্তানী সেনার অত্যাচারে জেরবার হয়ে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। স্বাভাবিক ভাবেই এই দেশকে তখন সম্মুখীন হতে হয় এক উদ্বেগজনক উদ্বাস্তু সমস্যার। ভয়াবহ এই পরিস্থিতে ভারতের পাশে থাকার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও চীন উল্টে পক্ষ নেয় পাকিস্তানের। আত্মরক্ষার স্বার্থে ভারতের সামনে খোলা ছিলো একটি মাত্র পথ – তা হলো যে কোনো প্রকারে অপর বিশ্বশক্তি এবং আমেরিকার শত্রু দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিজের পক্ষে আনা।

দুই দেশের কূটনীতিকদের মধ্যে হওয়া শান্তি ও বন্ধুত্বের প্রতীক এই ভারত-ইউএসএসআর চুক্তি নিশ্চিত করে যে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে হারিয়ে ভারতের লক্ষ্য অর্জনে যাবতীয় সাহায্য করবে রাশিয়া। প্রয়োজনে সামরিক সাহায্য পাঠাতেও দ্বিধাবোধ করবে না তারা।।

ভারত সরকারের তরফে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার স্বরণ সিং এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের তরফ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমাইকো দিল্লিতে চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির ফলে ভারত নিশ্চিন্ত হতে পারে যে ভবিষ্যতে পাকিস্তান আমেরিকা বা চীনের সাথে জোট বাঁধলে ভারত পাশে পাবে অন্তত রাশিয়াকে। 

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটঘাঁটি থাকলে হয়তো জানবেন আমেরিকা এবং ব্রিটেন যুদ্ধ চলাকালীন বঙ্গোপসাগরে নিজেদের নৌবাহিনী পাঠালে(যথাক্রমে টাস্ক ফোর্স 74 এবং টাস্ক ফোর্স ঈগল)সোভিয়েত নৌবাহিনী কথা রাখে এবং মুখোমুখি হয় এই দুই দেশের।

আমেরিকান নৌবহরের মনে ত্রাস সৃষ্টি করতে অ্যাডমিরাল ভি ক্রুগ্লিয়াকভের অধীনে, সোভিয়েত নৌবাহিনী সেই সময় ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের পারমাণবিক সাবমেরিনগুলিকে আমেরিকান স্যাটেলাইট এর সামনে প্রকাশিত করে।

অ্যাডমিরাল ক্রুগ্লিয়াকভরের বাহিনী অপেক্ষাকৃত ছোটো হওয়ায় তাকে সাহায্যের জন্য টাস্কফোর্স ৪০-এর অধীনে সোভিয়েতরা ক্রুজার এবং ডেস্ট্রয়ার সমন্বিত একটি ফ্লোটিলাও সংগঠিত করেছিল।

এই জোড়া হুমকির সম্মুখীন হয়ে, মার্কিন এবং ব্রিটিশ টাস্ক ফোর্স বঙ্গোপসাগর থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। উল্লেখ্য, শুধুমাত্র এই একটি কারণের জন্যই কিন্তু তারা সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ এখনকার বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর অভিযানে হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।

তবে, শুধু ব্রিটেন বা আমেরিকা নয়! ১৯৭১ সালে, ভারত চীনের তরফ থেকেও সীমান্তের হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। আসলে পাকিস্তান আশা করেছিলো যে ভারত – চিন সীমান্তে চিন অশান্তি শুরু করলে সেই সুযোগে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে।   

সেই সময়ের অনেক পাকিস্তানি সেনাদের কথোপকথনে ঠিক এই ভরসার কথাই ফুটে উঠেছিল। উত্তর থেকে বন্ধুরা ঠিক সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে- এই ছিলো তাদের বিশ্বাস।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সফল অভিযান পরিচালনার জন্য দুই দেশের মাটিতে সম্মুখ যুদ্ধের পরিস্থিতি এড়ানো ছিলো ভারতের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ, চিন সীমান্তে প্রহরায় থাকা ভারতীয় সেনাদের অবিলম্বে পাকিস্তান সীমান্তে পাঠানো হয়ে উঠেছিলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ঠিক এখানেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য কাজে লেগেছিলো ভারতের।

এর মাত্র দুই বছর আগেই, অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে, উসুরি নদীর দামানস্কি দ্বীপের কাছে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনা সৈন্যরা। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের মধ্যে ঝামেলার প্রথম সূত্রপাত ১৯৬৮ সালে। কিন্তু, চিনের পরিকল্পিত ভাবে রাশিয়ার দিকে আগ্রাসনের ফলে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে ঘটে সশস্ত্র সংঘর্ষটি।

চীনের আকস্মিক অগ্রসনে প্রথমে রাশিয়া ঘাবড়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত টানা সাত মাস সংঘর্ষর পর রাশিয়া দামানস্কি দ্বীপে চীনা অবস্থান ধ্বংস করতে গ্র্যাড বিএম-২১ রকেট দিয়ে বিধ্বংসী আর্টিলারি বোমাবর্ষণ করে। চিন হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সোভিয়েত এবং চীনা নেতারা হ্যানয়ে উত্তর ভিয়েতনামের নেতা হো চি মিন-এর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে মিলিত হলে অবশেষে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি সম্পন্ন হয়।সত্যি বলতে, রাশিয়া এবং চিন, এই দুই কমিউনিস্ট জায়ান্টদের মধ্যে মধ্যস্থতায় বড়ো ভূমিকা রয়েছে ভিয়েতনামের। আসলে তাদের উদ্বেগ ছিলো যে শক্তিশালী এই দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ খারাপ রূপ নিলে তা আমেরিকানদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের যুদ্ধকে  বিপাকে ফেলবে।

এমন এক রাজনৈতিক পটভূমিতে সোভিয়েতরা ভারতের পাশে থাকায় ভারত – পাকিস্তান যুদ্ধে চীনা প্রভাব যথাসম্ভব সীমিত করা সম্ভব হয়েছিলো।

৩-৪ স্বাভাবিক ডিভিশন স্থাপনার জায়গায়, সোভিয়েতরা চীন-সোভিয়েত সীমান্তে ৪৪ টি মোটরচালিত ডিভিশন মোতায়েন করলে স্থলভূমিতে চীনের সামনে তা এক বড়সড় হুমকির সৃষ্টি করে। এই গোটা ঘটনাটি লন্ডনের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের দ্বারা সুন্দরভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছিলো।

রাশিয়ানদের এই পদক্ষেপটিই ভারত-চীন সীমান্তে চীনাদের হস্থক্ষেপ রোধ করতে সহায়তা করে। যার ফলে ভারত সীমান্ত থেকে সৈন্য মোতায়েন কমিয়ে সেই সৈন্যদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়।১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সাফল্যে ভারত-সোভিয়েত চুক্তি একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল বললে অত্যুক্তি হয় না।

আমাদের সৌভাগ্য যে সেই সময়, চীন-মার্কিন জোট একেবারেই এক প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল এবং সীমান্তে অ্যাংলো-আমেরিকান বাহিনীর নৌ চালনা এবং স্থলে চীনা পদক্ষেপের মধ্যে সমন্বয় ছিলো খুবই কম।

ইন্দিরা গান্ধী সেই সময় যে কূটনীতির খেলাটা খুব ভালোভাবেই খেলেছেন একথা অনস্বীকার্য। উল্লেখ্য, বেশিরভাগ ন্যাটো দেশের সমর্থনও তখন পেয়েছিলো ভারত।

ন্যাটো সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ে খুব একটা খুশি না হলেও ওই মুহুর্তে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ন্যাটোর নেওয়া যেকোন পদক্ষেপ ভারতকে সোভিয়েত সাহায্য পাওয়া থেকে বাধাপ্রাপ্ত করতে পারে বলে তারা সেই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত হয়। 

তাহলে ভারতের এই কূটনৈতিক জয়কে ইতিহাসের পাতা থেকে সাধারণত বাদ কেনো দেওয়া হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় ‘নন অ্যালাইনমেন্ট’-এর বিলুপ্ত ধারণার প্রতি নয়াদিল্লি-ভিত্তিক ক্যাবলের কিশোর সংযুক্তি থেকে।

তবে, সেই সময় সোভিয়েতের বন্ধু হয়ে ওঠাটা সত্যিই আলাদা করে কৃতিত্বের দাবি করে ইতিহাসের পাতায়। একই সাথে এটি একটি সময়োপযোগী অনুস্মারক যে ভারত যতবারই যুগ্ম হুমকির সম্মুখীন হয়েছে ততবারই সঠিক ভাবে নিজের মিত্রদের বেছে নিতে সক্ষম হয়েছে। কোয়াডের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলিকেও তাই ওই একই আলোকে দেখা প্রয়োজন। কূটনৈতিক সত্য হলো ভূ-রাজনৈতিক ভাবে কোনো একটি দেশ অপর দেশের সাথে সবসময় বন্ধুত্ব বা শত্রুতা বজায় রাখবে তার কোনো মনে নেই। তাই, রাশিয়া এবং চিন এখন নির্বিবাদে বন্ধুত্ব বজায় রাখছে মানে ভবিষ্যতেও তারা কখনো আবার পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা শত্রুতায় ফিরে আসবে না তা ভাবার কারণ নেই। বরং ইতিহাস সাক্ষী যে পুরোনো শত্রুতা ফিরে আসার সম্ভাবনাটাই অনেকটা বেশি। 

কারণ, রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলিতে বহুকাল ধরেই রয়েছে চীনের নজর, অথচ কোনো ভাবে ওই অঞ্চলগুলো যদি রাশিয়ার হাত ছাড়া হয়ে যায় তবে মধ্যম ইউরোপীয় শক্তি হিসাবে ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পাবে রাশিয়ার। যার সাথে সাথে, রাশিয়া নিয়ে ভ্লাদিমির পুতিনের মহান শক্তি সম্পন্ন এক দেশ গড়ে তোলার স্বপ্নও ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published.