ভারত

ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় থাকা স্পেশাল প্রটেকশন গ্রুপ কম্যান্ডোদের ট্রেনিং সম্পর্কে জানা আছে!

রাজেশ রায়: ভারতের এমন এক কম্যান্ডো ফোর্স সম্পর্কে আলোচনা করব আজ যাদের সামনে জেমস বন্ড, এথান হান্ট ও নিশ্চিত ভাবে টিকতে পারবে না। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় থাকা এসপিজি বা স্পেশাল প্রটেকশন গ্রুপ কম্যান্ডো ফোর্স।

সবার প্রথমে জানা দরকার এসপিজি কী?? কারা এসপিজি? স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ একটি বিশেষ কম্যান্ডো ফোর্স যারা প্রধানমন্ত্রী সহ তার পরিবারের সুরক্ষা দেয় দেশে এবং বিদেশেও। কারন একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখবেন যে ইতিহাসে প্রায় বড় বড় দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির উপরই প্রধান আক্রমণ হয়েছে। এর উদাহারন ভারতেই আছে রাজীব গান্ধী। ১৯৮৯ এর আগে পর্যন্ত নিয়ম ছিল শুধু প্রধানমন্ত্রীকেই এই বিশেষ সিকিউরিটি দেওয়া হত। ১৯৮৯ এর পর রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না ফলে তার বিশেষ সুরক্ষা ছিল না, ১৯৯১ সালে মে মাসে রাজীব গান্ধী শ্রীলঙ্কা যান সেখানে তাকে বোম্ব দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং এসপিজির গুরুত্ব এখানেই। এরপর নতুন নিয়ম হয় ১৯৯১ সাল থেকে যে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বিপক্ষ দলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকেও এই সিকিউরিটি দেওয়া হত। ২০১৯ এর পর নতুন আইন তৈরি হয় এবং নিয়ম হয় শুধু প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারকেই এই সুরক্ষা দেওয়া হবে। 

সুতরাং ১৯৯১ এর পর থেকে এই সিকিউরিটি ব্যবহার করে আসা গান্ধী পরিবারের সুরক্ষার দায়িত্ব থেকে এসপিজি কে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং বদলে ওয়াই ও জেড ক্যাটেগরির সুরক্ষা দেওয়া হয়। এই নিয়ে তখন কংগ্রেস সরকার ঝামেলাও করেছিল। এসপিজির তে কাউকে নিযুক্ত করবার আগে দুটো দিক দেখা হয় “জিরো এরর” অর্থাৎ কোন ভুল নয় কারন একটি ভুল প্রধানমন্ত্রীর জীবন সংকটে ফেলতে পারে এবং কালচার অফ এক্সসিলেন্স অর্থাৎ এসপিজি তে যাদের নিযুক্ত করা হয় তারা বিভিন্ন ফোর্স থেকে আসে যেমন বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ,  ইন্দো টিবেটিয়ান বর্ডার পুলিশ বা আইটিবিপি, এই সব ফোর্সের সবচেয়ে উত্তম ব্যাক্তিকেই এসপিজি কম্যান্ডো হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। এদের অত্যন্ত কঠিন কম্যান্ডো ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে উঠে আসতে হয় যেমন ৩৬-৪০ ঘন্টায় মাত্র ২ ঘন্টা ঘুম, এই সময়ে কোন খাবার পর্যন্ত না,এরকম প্রচুর কঠিন ট্রেনিং দেওয়া হয় আসল যুদ্ধের ময়দানের পরিস্থিতি অনুযায়ী। 

এসপিজি কম্যান্ডো যে হয় তার নিজের পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হয়, সে কোন সোশ্যাল মিডিয়া সহ পাবলিকলি কোন বক্তব্য রাখতে পারবে না। এর নিজেদের পরিচয় এতটাই গোপন রাখে যে পাশের ব্যাক্তিটিও টের পায় না। সাধারণত শীতকালে এসপিজি কম্যান্ডোদের ড্রেস কোড হয় কালো ব্লেজার সুট এবং গ্রীষ্মকালে সাফারি সুট।

এবার জানা যাক এসপিজির গঠন কখন হয়? ১৯৮৪ সালের আগে এই দায়িত্ব পালন করত দিল্লি পুলিশ কিন্তু ১৯৮৪ সালে অপারেশন ব্লু স্টারের পর ইন্দিরা গান্ধী কে হত্যা করার পর পুরো ঘটনা বদলে যায়। কারন ইন্দিরা গান্ধী সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তাকে তারই সিকিউরিটি অফিসাররা হত্যা করে। এরপর বীরবল কমিটির সুপারিশে ১৯৮৫ সালে এসপিজি গঠন করা হয়, ১৯৮৮ সালে এসপিজি কে অ্যাক্টিভ করা হয়। তখন শুধু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকেই এই সুরক্ষা দেওয়া হত তবে ২০১৯ সালে এই নিয়ম পরিবর্তন হয়। 

১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয় কিন্তু ১৯৮৯ সালে নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যায় তখন নতুন প্রধানমন্ত্রী হয় ভিপি সিং, এরপর কে চন্দ্রশেখর প্রধানমন্ত্রী হয় এবং শেষপর্যন্ত ১৯৯১ সালে কংগ্রেস সরকার আসে এবং পি ভি নরসীমা রাও প্রধানমন্ত্রী হয়। তবে নির্বাচনের আগে একটা ঘটনা ঘটে যায়। ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধী শ্রীলঙ্কা যায় সেখানে তাকে সুইসাইড বোম্বিং এ হত্যা করা হয়। মাত্র সাত বছরের মধ্যে আমরা ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীর মতন দুটো বড় বড় নেতাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এরপরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এসপিজির আয়তন বাড়ানো হবে। 

সেন্ট্রাল আর্মড পুলিশ ফোর্স বা সিএপিএফ এর এর পরীক্ষা হয় যাতে ভারতের পাঁচ বাহিনী যুক্ত এখান থেকেই এসপিজি নিয়োগ হয়। বর্তমানে আইপিএস অরুন কুমার সিনহা এসপিজির ডিরেক্টর। শুরুতে ১৯৮৮ সালে যখন এসপিজি নিয়োগ করা হয় তখন ৯০০ জন কে নিয়োগ করা হয়েছিল। এখন ৩০০০ এসপিজি রয়েছে। সেন্ট্রাল আর্মড পুলিশ ফোর্সের পাচ বছর সবচেয়ে ভাল সার্ভিস দেওয়ার পর কাউকে এসপিজি হিসাবে নিয়োগ করা হয়। এক জন ডিজিপি র‍্যাঙ্কের আইপিএস অফিসার এসপিজি কম্যান্ড করে। 

প্রধানমন্ত্রী এয়ার ইন্ডিয়া ১ নামে বিশেষ বিমান ব্যবহার করে। প্রধানমন্ত্রী যখন এয়ারপোর্টে বা কোথাও  যান ওনার সাথে ১৫-২০ টি গাড়ির কনভয় থাকে যার সম্পূর্ণ দায়িত্ব থাকে এসপিজির উপর। প্রধানমন্ত্রী মার্সেডিজ বেঞ্জের নতুন ১১ সিরিজের দুটি মেব্যাক এডিশন ব্যাপার করে যার এক একটার দাম প্রায় ১২ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহার করা গাড়ির মত আরও দুটো ডামি গাড়ি তৈরি করা হয় যাতে বাইরের কেউ বুঝতে না পারে প্রধানমন্ত্রী কোন গাড়িতে আছেন। এই কনভয়ে ৬-৮ টি বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজ, ফরচুনার ও রেঞ্জ রোভার গাড়ি থাকে। এছাড়াও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এই কনভয় কে কভার করে। একজন এসপিজির কম্যান্ডোর চোখে বিশেষ গ্লাস থাকে, কিন্ত জানেন কী কেন থাকে? কারন যাতে রোদ এবং অন্য কিছু তাদের লক্ষ্য নষ্ট করতে না পারে। একটা জিনিস শুনে অবাক হবেন যে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের হারের অন্যতম বড় কারন ছিল এই রোদ। রোদ একদম সামনে ভিতর বিশেষ বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট থাকে এবং হাতে থাকে বেলজিয়ামের তৈরি এফ এন পি ৯০ বন্দুক, যার রেঞ্জ ২০০ মিটার এবং বেলজিয়ামের তৈরি বিশেষ এফ এন ২০০০ অ্যাসল্ট রাইফেল। এছাড়াও তাদের কাছে বেলজিয়ামের তৈরি এফ এন ৫-৭ হ্যান্ড গান থাকে যাতে ৫.৭×২৮ মিলিমিটার কার্তুজ থাকে, এর রেঞ্জ ৫০ মিটার। এসপিজি কম্যান্ডোদের জুতো, এলবো ও নিপ্যাড পর্যন্ত বুলেটপ্রুফ। এদের কানে ও হাতে বিশেষ কমিউনিকেশন ডিভাইস রয়েছে। এছাড়া এসপিজির কাছে রয়েছে বিশেষ একটি ব্যালেস্টিক শিল্ড। হঠাৎ গুলি চললে প্রধানমন্ত্রীর সামনে ফেলে দেওয়া হয় এটা, যা বুলেট গার্ড করে। ২০২১-২১ এ এসপিজির মোট বাজেট প্রায় ৫৯৩ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় প্রতিদিন প্রায় ১.৬২ কোটি টাকা খরচ হয়।

প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় এত খরচ হয় কারন প্রধানমন্ত্রী কোন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার উপর অ্যাটাক হলে পুরো দেশের বদনাম হয়, সবাই বলবে এই দেশের সিকিউরিটি ব্যবস্থা ভাল নয়। এর প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতি, বিনিয়োগে। প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশ সফরে যান তখনও এসপিজি ওনার সাথেই থাকেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.