ইংরেজদের ঘুম কেড়েছিল ইংরেজদেরই মেয়ে। এডিথ অ্যালেন গ্রে
নিউজ ডেস্কঃ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন স্বদেশী নারীরা দেশের পাশে দাড়িয়ে ছিলেন ঠিক তেমন এই দেশের পাশে দাড়িয়ে ছিলেন অনেক বিদেশী নারীরাও। তারা দেশীয় সংগ্রামীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। এই বিদেশী নারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন নেলী সেনগুপ্ত ওরফে এডিথ অ্যালেন গ্রে। নেলী সেনগুপ্ত নামে পরিচিত হলেও তিনি যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের স্ত্রী হিসেবেই বেশি পরিচিত। মুক্তি সংগ্রামে তাঁর অবদান তাঁকে অমর করে রেখেছে দেশবাসীর মনে।
নেলী সেনগুপ্ত ১২ জানুয়ারি ১৮৮৪ সালে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে জন্মগ্রহণ করেন। নেলী সেনগুপ্ত নাম পরিচিত হলেও তাঁর আসল নাম ছিল এডিথ অ্যালেন গ্রে। তাঁর বাবা ছিলেন ফ্রেডরিক উইলিয়াম গ্রে। তিনি কেমব্রিজের একটি ক্লাবে কাজ করতেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল এডিথ হেনরিয়েটা গ্রে। তিনি ছিলেন তাঁর মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে পড়াশোনা করেছিলেন নেলী। ১৯০৪ সালে নেলী সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। ১৯০৬ সালে ভারতের অন্যতম বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যারিস্টারি অধ্যয়নের জন্য এসেছিলেন এবং সেখান থেকেই তাঁর সাথে পরিচয় হয় নেলী গ্রে- র সাথে। তাদের সেই পরিচয় ভালোবাসাই পরিনত হয়েছিল। তবে তাদের এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি তার বাবা-মা। কিন্তু নেলী তাঁর বাবা মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে ১৯০৯ সালের ১ আগস্ট যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে বিবাহ করেন। বিবাহের পর তাঁর স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। এই দম্পতির দুই সন্তান ছিল। তাদের নাম ছিল শিশির এবং অনিল।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। তাই তিনি তাঁর স্বামীকে অনুসরন করে তিনিও যোগ দান করেন মুক্তি সংগ্রামে। তৎকালীন সময়ে একের পর এক ঘটনা ঘটছিল ভারতের রাজনৈতিক অধ্যায়ে। সেই সময় শ্রমিক নেতা হিসাবে পরিচিতি অর্জন করেন যতীন্দ্রমোহন। এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। এবার প্রশ্ন উঠে যে বাংলার যুব সমাজের নেতা কে হবে? তখন দেশবন্ধুর স্থানে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে নির্বাচিত করা হয়। কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হিসাবে পরপর পাঁচবার নির্বাচিত হন যতীন্দ্রমোহন।
১৯১০ সালে কলকাতায় কংগ্রেস রাজনীতিতে যোগ দেন যতীন্দ্রমোহন ও নেলী সেনগুপ্ত। ১৯২১ সালে গান্ধীজী পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনের যোগ দান করেছিলেন নেলী সেনগুপ্ত। এরপর আসাম বেঙ্গল রেলওয়েম্যানদের ধর্মঘটের সময় কারারুদ্ধ হন যতীন্দ্রমোহন। যেই ঘটনার তীব্র বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন নেলী এবং জেলা কর্তৃপক্ষের সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। গণসভায় ভাষণ দেন এবং গ্রেপ্তারীর বিচারের জন্য তিনি আদালতে যান। তিনি আইন অমান্য আন্দোলনে সাথে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রামে খদ্দর বিক্রয় করার সময় তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। ১৯৩০ সালে দ্বিতীয় অসহযোগ আন্দোলনের কাজ করার জন্য দিল্লি, অমৃতসর প্রভৃতি জায়গায় নেলী তাঁর স্বামী যতীন্দ্রমোহনের সাথে যান। ১৯৩১ সালে এক সভায় বক্তব্য রাখার সময় গ্রেফতার হন তিনি। চার মাসের জন্য দিল্লিতে কারারুদ্ধ ছিলেন তিনি। ওই চার মাস জেলে থাকাকালীন সময়ে নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর বলে জেলটিকে পরিচয় দেন তিনি। ১৯৩৩ সালের ২৩ জুলাই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত কারারুদ্ধ অবস্থায় রাঁচির জেলে মৃত্যুবরণ করেন। ওই সময় তাঁর সঙ্গেই ছিলেন তাঁর স্ত্রী নেলী। স্বামীর মৃত্যুতে তিনি থেমে যাননি। পুনরায় তিনি কাজ শুরু করেন স্বাধীনতা সংগ্রামের। স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দেশের মানুষকে অনুরোধ করেন ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের জন্য। লবণ সত্যাগ্রহ চলাকালীন সময়ে তৎকালীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের (INC) সভাপতি পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য সহ আরও বহু নেতা কারাবন্দী হওয়ায়, তাঁর উপর ওই সময় বেশ বড় একটা দায়িত্ব এসে পড়ে। ১৯৩৩ সালে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন তিনি। এর ফলে তৃতীয় মহিলা এবং দ্বিতীয় ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত মহিলা কংগ্রেস সভাপতি হয়ে ওঠেন তিনি । ১৯৩৩ এবং ১৯৩৬ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের একজন অল্ডারম্যান ছিলেন নেলী সেনগুপ্ত। এরপরে ১৯৪০ এবং ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় আইনসভা কংগ্রেসের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। দেশ বিভাজনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। মহাত্মা গান্ধীর পরামর্শে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তাঁর স্বামীর পৈতৃক স্থানে অর্থাৎ চট্টগ্রামে চলে আসেন নেলী সেনগুপ্ত। এখানেও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭০ সালে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। ১৯৭৩ সালের ২৩ অক্টোবর কলকাতায় নেলী সেনগুপ্ত মৃত্যুবরণ করেন। দেশের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করা নেলী সেনগুপ্তের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন তাঁকে। বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতায় দেশপ্রিয় পার্কের ভিতরে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের পাশে একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে তাঁর স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তের।