ইউক্রেনে কত লাখ রাশিয়ান সেনা এখনও মোতায়েন রয়েছে জানেন?
ইউক্রেনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাশিয়া। এখনও পর্যন্ত যুদ্ধে ইউক্রেনের বেশ কিছু শহরের পতন হয়েছে। যুদ্ধের ময়দান থেকে যা খবর আসছে তার সত্যতা সম্পর্কে যাচাই করার উপায় নেই। ইউক্রেন দাবি করেছে তারা ইতিমধ্যে ৩০,০০০ জন রাশিয়ান সেনাকে হত্যা করেছে, তাছাড়া ইউক্রেনের দাবি অনুযায়ী তারা ৭ টি রাশিয়ান যুদ্ধবিমান, ৬ টি হেলিকপ্টার, ১৩০ টি আর্মড ভ্যেইকল, ৩০ এর বেশী ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছে। আবার যথারীতি রাশিয়া এই দাবি অস্বীকার করেছে। বর্তমানে ইউক্রেন জুড়ে প্রায় ২ লাখ রাশিয়ান সেনা রয়েছে। ইউক্রেনের এই পরিস্থিতির জন্য ইউক্রেন নিজে তো দায়ী বটেই সাথে আমেরিকা ও ন্যাটোও সমান দায়ী।
রাশিয়া হঠাৎ করেই ইউক্রেন আক্রমণ করে নি এর পেছনে বহু কারন ছিল, গত নভেম্বর মাস থেকে ইউক্রেন আক্রমনের পটভূমি রচনা হয়। এক এক করে ঘটনা গুলো শুনুন। নভেম্বরে রাশিয়া তার প্রায় এক লক্ষ সৈন্য, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, ভারী অস্ত্র সহ সাঁজোয়া গাড়ি সব ইউক্রেন বর্ডারে মোতায়েন করে যা ধরা পড়ে স্যাটেলাইট চিত্রে। ডিসেম্বর মাসে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন রাশিয়া কে হুমকী দেয় ইউক্রেন আক্রমন করলে অর্থনৈতিক অবরোধ দেওয়ার। ডিসেম্বরেই রাশিয়া ন্যাটো কে সিকিউরিটির জন্য বলে, যার ফলে ন্যাটো ইউক্রেন সহ পূর্ব ইউরোপে সমস্ত অ্যাক্টিভিটি বন্ধ করে দেয়। রাশিয়া এটাও বলে পুরোনো সোভিয়েত কোন দেশকে ন্যাটোতে যেন অন্তর্ভুক্ত করা না হয়।
জানুয়ারি মাসে জো বাইডেন ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি কে আশ্বাস দেয় রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে আমেরিকা তৎক্ষণাক চলে আসবে। জানুয়ারিতেই জেনেভা তে রাশিয়া ও আমেরিকার কুটনৈতিকবীদ দের বৈঠক হয় যেখানে রাশিয়া দাবি করে ইউক্রেন সহ সোভিয়েত কোন দেশকে ন্যাটোতো না নিতে কিন্তু আমেরিকা রাজি হয় না। ৬ ফেব্রুয়ারী রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য ৭০ শতাংশ মিলটারি স্থাপনা করে ইউক্রেন বর্ডারে। এই সময়ই ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোন ও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আবার বৈঠক হয় কিন্তু সমস্যা কিছুই সুরাহা হয় না। এরপর পুতিন পূর্ব ইউক্রেনের ডোনেটস্ক এবং লুনহানস্ক কে স্বাধীন ঘোষনা করেন। ঠিক তার পরেই জো বাইডেন রাশিয়ার উপ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, এর পরেই রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করে। এই রক্তাক্ত যুদ্ধের জন্য আমেরিকা ও পশ্চিমাদেশ গুলো ব্যাপক দায়ী। আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন যদি একবার বিবৃতি দিত যে ইউক্রেনকে ন্যাটোর অংশ করা হবে না তাহলে এত রক্তপাত, খুনো খুনি তো দূর যুদ্ধই হত না।
আমেরিকা বিগত ১২-১৪ বছর ধরে রাশিয়ার উপর বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্যাংশন লাগিয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার বারবার অনুরোধ সত্বেও আমেরিকা ও ন্যাটো কোন কথা না শুনে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করবার জন্য উদ্যোগ নেয়। আমেরিকা রাশিয়ার অস্ত্র ব্যাবসার উপরও স্যাংশন দেয়। রাশিয়ার থেকে অস্ত্র কেনা দেশ গুলোর উপর ক্রমাগত অস্ত্র না কেনার জন্য চাপ দিতে থাকে। কফিনে শেষ পেড়েকটা পড়ে তখন যখন আমেরিকা রাশিয়ার অর্থনীতির অন্যতম উৎস নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপ লাইন তৈরি করেছে যে কোম্পানি তার উপর স্যাংশান দেয়। এই পাইপলাইন বাল্টিক সাগর হয়ে জার্মানি গেছে এর থেকে প্রতিবছর রাশিয়া প্রচুর অর্থ পেত। দিন দিন ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি ও আমেরিকার স্যাংশানের চাপে ইউক্রেনে অ্যাটাক করা ছাড়া রাশিয়ার আর কোনও উপায় ছিল না। রাশিয়া আক্রমণ না করলে ন্যাটো ইউক্রেনে চলে আসত রাশিয়ার ঘাড়ের কাছে তখন আরও খারাপ পরিস্থিতি হত।
এটা ছাড়াও রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ঐতিহাসিক কারনও আছে। আমেরিকা ও পশ্চিমা মিডিয়ার কথা শুনলে মনে করবেন রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বোধহয় শয়তান এবং আমেরিকা রক্ষাকর্তা কিন্ত পুরো ঘটনা জানলে আপনিও ধারনা বদলাতে বাধ্য হবেন। এই বিষয়ে জানতে হলে প্রথমে আর একটা ঘটনা জানতে হবে তা হচ্ছে কিউবান মিসাইল সংকট।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রধান নিকিতা খুরশেভ ও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির মধ্যে একটি বৈঠক হয়। যার প্রধান কারন ছিল আমেরিকার দোরগোড়ায় কিউবা তে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিসাইল মোতায়েন। কেনেডি নিকিতাকে বলে কিউবা থেকে মিসাইল সরিয়ে ফেলতে বদলে নিকিতা খুরশেভ কেনেডি কে বলে তাহলে আমেরিকাকেও সোভিয়েত ইউনিয়নের দোরগড়া অর্থাৎ তুরস্ক থেকে মিসাইল সরিয়ে ফেলবে। এরপর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই নিজেদের মিসাইল সরিয়ে নেয়। জন এফ কেনেডির মৃত্যুর পর এই ঘটনা জন সমক্ষে আসে। এরপরে শেষ সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ এবং তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ সিনিয়রের সেক্রেটারি অফ স্টেট জেমস বেকারের মধ্যে জার্মানি কে নিয়ে একটি বৈঠক হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের সময় জার্মানি দুটো ভাগে ভাগ ছিল একটি হচ্ছে পূর্ব জার্মানি যাকে নিয়ন্ত্রণ করত সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আরেকটি হচ্ছে পশ্চিম জার্মানি যাকে নিয়ন্ত্রণ করত আমেরিকা। উভয়ের মাঝে বর্ডার হিসানে বার্লিন ওয়াল ছিল।
জেমস বেকার মিখাইল গর্বাচেভ কে প্রস্তাব দেয় বার্লিন ওয়াল ভেঙ্গে ফেলার জন্য বদলে ন্যাটো (যা তৈরি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এর বিরুদ্ধে ইউরোপকে রক্ষা করার জন্য।) সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে অগ্রসর হবে না অর্থাৎ সোভিয়েতের কাছাকাছি আর কোনও দেশকে ন্যাটো তাদের সদস্য করবে না। মিখাইল গর্বাচেভ এরপর বার্লিন ওয়াল ভাঙ্গার নির্দেশ দেয়। কিন্তু আমেরিকা তার কথা রাখে নি। এখনও আপনি যদি পশ্চিমা মিডিয়া গুলোর কথা শোনেন দেখবেন ওরা এই সর্বদা এই রকম কোন চুক্তির কথা অস্বীকার করে। কিন্তু ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭ সালে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি কিছু গোপন ফাইল প্রকাশ করে যাতে স্পষ্ট হয়ে যায় জেমস বেকার এই প্রস্তাব দিয়েছিল মিখাইল গর্বাচেভ কে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ন্যাটো তার কথা রাখে নি। ন্যাটো তার সদস্য বাড়াতেই থাকে। ১৯৯৬ সালে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি ন্যাটোতে যুক্ত হয়। ঠিক এই কারনেই ভ্লাদিমির পুতিন আমেরিকা ও ন্যাটোকে বিশ্বাস করতে পারছিল না প্রথম থেকেই। আগুনে ঘি ঢালে ২০০৮ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে হওয়া ন্যাটো সম্মেলন। এই সম্মেলনে আমেরিকার চাপে ন্যাটো জানায় ইউক্রেনকে ন্যাটোর অংশ করতে চায় তারা, এমনকি জর্জিয়াকেও ন্যাটোর সদস্য করবার প্রস্তাব দেওয়া হয় যার জন্য রাশিয়া ২০০৮ সালে জর্জিয়ার সাথে যুদ্ধ করে জর্জিয়ার সদস্যপদ আটকায়।