ভারত

চীনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে ভারতবর্ষ। জানুন বিস্তারিত

রাজেশ রায়: ২০২২ সালের হিসাবে বিশ্বের সমস্ত দেশ মিলিয়ে শক্তিশালী এয়ারফোর্সের রেঙ্কিং প্রকাশ করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে এই রেঙ্কিং এ দেখা যাচ্ছে ভারতীয় বায়ুসেনা চীনের বায়ুসেনার থেকে এক ধাপ এগিয়ে আছে। এই রেঙ্কিং প্রকাশ করেছো ডব্লিউ ডি এম এম এ বা ওয়ার্ল্ড ডাইরেক্টরি অফ মর্ডান মিলিটারি এয়ারক্রাফট নামক সংস্থা। বিশ্ব জুড়ে ৯৮ টি দেশের ১২৪ টি এয়ার সার্ভিসের উপর বিচার করে তাদের শক্তি, দুর্বলতা সবকিছু বিচার করে এই রেঙ্কিং প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে এয়ার সার্ভিসের কথা বলা হয়েছে, দেখুন এয়ারফোর্স এয়ার সার্ভিসের মধ্যেই পড়ছে। এই সংস্থাটি কতটা গভীর বিশ্লেষন করে তার একটা তথ্য দিই, সংস্থাটি বিশ্ব জুড়ে ৪৭,৮৪০ টি বিমানকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করেছে রেঙ্কিং তৈরির জন্য। এবার দেখা যাক ২০২২ এর হিসাবে কোন দেশের কত গুলি এয়ার সার্ভিস প্রথম দশে রয়েছে। প্রথমেই রয়েছে আমেরিকার বায়ুসেনা, দ্বিতীয় স্থানে আমেরিকার নেভির এয়ার সার্ভিস, তৃতীয় স্থানে রাশিয়ান বায়ুসেনা, চতুর্থ স্থানে আমেরিকার স্থলবাহিনীর এয়ার সার্ভিস, পঞ্চম স্থানে আমেরিকার মেরিন সেনার এয়ার সার্ভিস, ষষ্ঠ স্থানে ভারতীয় বায়ুসেনা, সপ্তম স্থানে চীনের বায়ুসেনা, অষ্টম স্থানে জাপানের বায়ুসেনা, নবম স্থানে ইসরায়েলের বায়ুসেনা এবং দশম স্থানে ফ্রান্সের বায়ুসেনা স্থান পেয়েছে।

ভারতের অন্যতম শত্রু দেশ পাকিস্তান রয়েছে ১৮ নম্বর স্থানে। যদি লিস্টটা দেখেন হিসাব মত ভারত তৃতীয় স্থানে আছে দেশ হিসাবে কারন প্রথম পাচ স্থানের চারটিই আমেরিকার অধীনে রয়েছে। এই রিপোর্ট পাবার পর থেকেই চীনের সামাজিক মাধ্যম সহ সরকারি কর্মকর্তারা পর্যন্ত ক্ষেপে গেছে কারন তারা বিশ্বাসই করতে পারছে না ভারতের তুলনায় চীনের বায়ুসেনার আয়তন বড়, চীনের আধুনিক যুদ্ধ বিমানের সংখ্যাও বেশী ভারতের তুলনায় কিন্তু তার পরেও ভারতের তুলনায় চীনের পিছিয়ে। গত ২১ মে ইউরেশিয়ান টাইমস এই রিপোর্ট প্রকাশ করে চীনা নেটিজনরা এই রিপোর্টের উপরই প্রশ্ন চিহ্ন লাগিয়ে দিয়েছে, তাদের দাবি চীনা এয়ারফোর্স সম্পর্কে সঠিক তথ্য বাকী বিশ্বের কাছে নেই। তাদের এটাও দাবি যখন চীন জে-১০ পোগ্রাম লঞ্চ করে তখন ভারতও তেজস পোগ্রাম লঞ্চ করে। যখন জে- ১০ টেস্টিং স্টেজে ছিল তখন তেজসও টেস্টিং স্টেজে ছিল, যখন জে-১০ চাইনিজ বিমানবাহিনীতে যুক্ত হয় তখনও তেজস টেস্টিং ফেজে ছিল, এমনকী জে-১০ এর আপগ্রেডেড ভার্সন ও আরও উন্নত পঞ্চম প্রজন্মের জে-২০ স্টেলথ বিমান চীন তৈরি করার পরও তেজস টেস্টিং ফেজেই ছিল তাহলে কী করে ভারত চীনের থেকে এগিয়ে এটাই চীন বিশ্বাস করতে পারছে না।

দেখুন চাইনিজ নেটিজনদের বক্তব্য ঠিক কিন্তু শুধু প্রচুর বিমান তৈরি করলেই রেঙ্কিং এ আগে এগোনো যায় না, এই রিপোর্ট তৈরি করতে অনেক ছোট ছোট প্যারামিটার বিশ্লেষন করা হয়। এই রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে কোন দেশের বায়ুসেনাকে তার টোটাল ফাইটিং ক্ষমতা দিয়ে বিচার করা হয়, তার উপর বিশ্লেষন করে টিভিআর বা ট্রু ভ্যালু রেটিং বার করা হয়। যার সবচেয়ে বড় উদাহারন আমেরিকার বায়ুসেনা যার টিভিআর ২৪২.৯, যেখানে রাশিয়ান বায়ুসেনার ১১৪.২ যা আমেরিকার অর্ধেকেরও কম। ভারত, চীন তো এর আশেপাশেও নেই৷ ভারতীয় বায়ুসেনার টিভিআর ৬৯.৪, চীনের ৬৩.৮. কোন দেশের বায়ুসেনাতে কত ধরনের বিমান আছে, যুদ্ধ বিমান, স্ট্রাটেজিক বোম্বার, ট্রান্সপোর্ট বিমান, বিশেষ অপারেশন বিমান, ইনটেলিজেন্স বিমান, ট্রেনিং বিমান সহ হেলিকপ্টারের সংখ্যা সব দেখা হয়, তার সাথে দেশটির বিমান তৈরির ইনফ্রাস্ট্রাকচার, এয়ার ট্রেনিং ফেসিলিটি, অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি সব কীছু বিশ্লেষন করে তবেই এই টিভিআর প্রকাশ করা হয়। এসব ক্ষেত্রে আমেরিকা সবার থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে। এবার এটা দেখা যাক ভারত কেন এই রেঙ্কিং এ চীনের থেকে এগিয়ে গেল টিভিআর বিচারে।

প্রথমেই বলি ভারতীয় বায়ুসেনার মোট বিমানের সংখ্যা ১৬৪৫ যার মধ্যে ৬৩২ টি বিমান আক্রমনের জন্য, ৭০৯ টি সাপোর্টের জন্য,  ৩০৪ টি ট্রেনিং এর জন্য এবং ভবিষ্যতে ৬৮৯ টি বিমান যুক্ত হবে। এই হিসাবে ভারতীয় বায়ুসেনায় মোট ৩৮.৪ শতাংশ যুদ্ধ বিমান, ২৬.৬ শতাংশ হেলিকপ্টার, ১৫.২ শতাংশ ট্রান্সপোর্ট বিমান, ১৮.৫ শতাংশ ট্রেনিং বিমান এবং কিছু ট্যাংকার ও বিশেষ মিশনের জন্য বিমান রয়েছে। এখানে একটা কথা বলে রাখি ১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধ ভারত চীনের সাথে ততটা সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু জানলে অবাক হয়ে যাবেন সেসময় চীনের তুলনায় ভরতের বায়ুসেনা শক্তিশালী ছিল কিন্তু তাও অজানা কারনে ভারতীয় বায়ুসেনাকে সেসময় ব্যবহার করা হয় নি, যদি করা হত তাহলে সেসময় যুদ্ধে আমরাই জিততাম। আচ্ছা এবার একটা জিনিস বলি কোন দেশের বায়ুসেনায় থাকা যুদ্ধবিমানের মধ্যে কতগুলি সাথে সাথে যুদ্ধে যেতে প্রস্তত তাকে সেই দেশটির এয়ারক্রাফট অ্যাভেলেবিলিটি রেট বা রেডিনেস রেট বলে। যেমন ভারতের ১৬৪৫ টি বিমান রয়েছে এর ৫০ শতাংশ মানে ৮২৩ টি বিমান যদি সবসময় প্রস্তত থাকে বিলো রেডিনেস রেট বলে, যদি ৭০ শতাংশ বিমান প্রস্তত থাকে তাকে অ্যাভারেজ রেডিনেস রেট বলে যদি ৭৫ শতাংশ বিমান প্রস্তত থাকে তাকে এভাব অ্যাভারেজ এবং যদি ৮০ শতাংশ বিমান প্রস্তত থাকে তাকে এক্সিলেন্ট রেট বলে। এই রেট বিশ্লেষন করে দেশটির বায়ুসেনাকে পয়েন্ট দেওয়া হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় বায়ুসেনাতে ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩১৬ টি বিমান সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তত রয়েছে। 

এবার দেখা যাক চীনের বায়ুসেনার ব্যাপরে। চীনের বায়ুসেনায় বর্তমানে ২০৮৪ টি বিমান আছে যা ভারতীয় বায়ুসেনার তুলনায় ৪৩৯ টি বেশী। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশী যুদ্ধ বিমান রয়েছে প্রায় ৬৪ শতাংশ যা ভারতের আছে ৩৮.৪ শতাংশ। কিন্তু চীনের বায়ুসেনার ৭৫ শতাংশ বিমান যুদ্ধের জন্য সর্বদা প্রস্তত যেখানে ভারতের ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ভারতের রেডিনেস রেট চীনের থেকে বেশী। তবে ভারত ও চীন উভয় বায়ুসেনারই একটি সমস্যা হচ্ছে পর্যাপ্ত এরিয়াল রিফিউলার না থাকা। ভারতের সাতটি এয়ার রিফিউলার আছে, যেখানে চীনের মাত্র তিনটি। তবুও সত্যি কথা বলতে কী আধুনিক যুদ্ধ বিমানের সংখ্যা চীনের ভারতের তুলনায় অনেকটাই বেশী তা সত্বেও চীন কম পয়েন্ট পেল কীভাবে?? যার একটি বড় কারন হচ্ছে নকল। চাইনিজ বায়ুসেনার প্রায় সব বিমানই অন্য দেশ থেকে নকল করা। বেশীরভাগ চাইনিজ বিমান রাশিয়ান বিমান এবং কিছু আমেরিকান বিমানের নকল। যেমন সম্প্রতি চীনের তৈরি এইচ ২০ বোম্বার বিমান আমেরিকার বি-২ স্পিরিটের নকল। তবে এটাই একমাত্র কারন নয়। চীনের বায়ুসেনার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের বিমানের মধ্যে সমতা নেই,  যেমন ভারতের ৬৩২ টি যুদ্ধ বিমান, ৭০৯ টি সাপোর্টের জন্য, ৩০৪ টি ট্রেনিং এর জন্য এবং ভবিষ্যতে ৬৮৯ টি বিমান আসবে যা একটি পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য বজায় রাখে কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে ছবিটা একটু আলাদা।

চীনের ১৪৫৩ টি যুদ্ধ বিমান এবং সেই তুলনায় সাপোর্ট বিমান তিন গুনেরও কম মাত্র ৩৭০ টি। অর্থাৎ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চাইনিজ এয়ারফোর্স কে সাপোর্ট করবার মতন পর্যাপ্ত লজিস্টিক ও ইনটেলিজেন্স বিমান চীনের নেই। ভারতীয় বায়ুসেনার সাপোর্ট বিমানের প্রশংসা স্বয়ং চীন নিজে করেছিল আজ থেকে চার বছর আগে। ২০১৮ সালে ভারতীয় বায়ুসেনা এক্সারসাইজ গমনশক্তি পরিচালনা করে যাতে ভারতীয় বায়ুসেনার ১১০০ বিমান, ১০০০০ সদস্য অংশ নিয়েছিল এবং ১১,০০০ মিশন সম্পন্ন করা হয়েছিল যা রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছিল চীন কে। ২০০৮ সালে ভারতীয় বায়ুসেনায় সুখোই ৩০ এমকেআই বিমানের রেডিনেস রেট ছিল ৫০ শতাংশেরও কম কিন্তু বর্তমানে ৯০ শতাংশ সুখোই ৩০ এমকেআই সর্বদা অ্যাক্টিভ রয়েছে। যা প্রমান করে ভারতের লজিস্টিক সাপোর্ট ও মেইটেন্যান্স সাপোর্ট কতটা উন্নত। আমেরিকান বায়ুসেনার এক সিনিয়র অফিসার বেঞ্জামিন ল্যামব্যাথ স্বয়ং এব্যাপরে ভারতের প্রশংসা করেছেন। বেঞ্জমিন ল্যামব্যাথের যুদ্ধ বিমানের ক্ষেত্রে প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে, ৪০ বিভিন্ন রকমের যুদ্ধবিমান তিনি চালিয়েছেন। এয়ারফোর্স ম্যাগাজিনে তিনি ভারতের ব্যাপারে একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন যার নাম ” ইন্ডিয়াস এয়ারফোর্স ইভলবস” মানে কী করে ভারতীয় বায়ুসেনার পরিবর্তন হল। এখানে তিনি ২০০৮ সালে আমেরিকাতে হওয়া রেড ফ্ল্যাগ এক্সারসাইজ ও গোয়ালিয়রে হওয়া কোপ ইন্ডিয়া এক্সারসাইজের কথা বলেছেন। উভয়ক্ষেত্রেই ভারতীয় বায়ুসেনা ও আমেরিকান বায়ুসেনা যৌথভাবে অংশ নিয়েছিল। সেসময় আমেরিকান পাইলটরা ভারতীয় পাইলটদের প্রচুর প্রশংসা করেছিল। ভারতীয় বায়ুসেনার যুদ্ধ অভিজ্ঞতা চীনের থেকে অনেক বেশী। পাকিস্তানের সাথে চারটি যুদ্ধে ভারতীয় বায়ুসেনার ভূমিকা সবাই জানেন। তাছাড়া আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইসরায়েলের মতন বিশ্বের শক্তিশালী দেশ গুলোর সাথে ভারত নিয়মিত এয়ার এক্সারসাইজ করে কিন্তু চীন খুব কম দেশের সাথেই এক্সারসাইজ করে। যারজন্য কিছুটা হলেও চীন পয়েন্ট কম পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.