হিন্দু চিকিৎসক সুশ্রুত কে সার্জারির জনক কেন বলা হয়?
রাজেশ রায়: আজ আমরা ভারতের এমন এক মহান ব্যাক্তির সম্পর্কে আলোচনা করব যিনি গোটা বিশ্বের সামনে ভারতের সম্মান কয়েকশোগুন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে যখন আধুনিক চিকিৎসা ব্যাবস্থা বলতে কিছুই ছিলনা সেসময় এই ব্যক্তিটি বেনারসে প্রাকটিস করতেন। ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন শহর, দেবভূমি বলা হয় বেনারসকেই। মার্ক টোয়েনও বলেছেন বেনারস ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন শহর। আজ আমরা সবাই অন্ধের মতন পশ্চিমা সংস্কৃতি, শিক্ষার পেছনে ছুটছি। কিন্তু একবার যদি আমরা আমাদের সোনালী ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখি দেখব বিজ্ঞান, টেকনোলজির বহু সেক্টরের উদ্ভব ভারত থেকেই হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত হয় মোটামুটি ১৬ শতকে কিন্তু তারও কয়েক হাজার বছর আগে থেকে ভারতে আরও উন্নত সভ্যতা ছিল। সনাতন ধর্মের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ বেদ যাকে বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় গ্রন্থও বলা হয়। ভারতের জ্যোতিরিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্রর খ্যাতি সেই পৌরাণিক কাল থেকে চলে আসছে। সত্যি বলতে কী অনেকেই মানেন ভারতের উন্নতির জন্য প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতির দরকার কিন্তু কাজের বেলায় কেউই করে না। প্রাচীন ভারতীয় যোগকে যখন বর্তমানে শুরু করা হয়, গোটা বিশ্ব তাকে অনুসরন করতে থাকে। আজ বিশ্ব জানে যোগ কী? যাইহোক প্রাচীন ভারত সম্পর্কে না হয় অন্য কোনওদিন আলোচনা করব। আজ আলোচনা করব প্রাচীন ভারতের এক মহান চিকিৎসক সম্পর্কে যার নাম সুশ্রুত। যদিও ওনার জীবনি সম্পর্কে বিশেষ তেমন কীছু তথ্য পাওয়া যায় না তবু ওনার কাজের জন্য উনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। সুশ্রুত কে বলা হয় সার্জারির জনক। গোটা বিশ্ব ওনাকে অনুসরন করেন। ওনার সম্পর্কে একটি বিখ্যাত বই আছে সুশ্রুত সংহিতা। তবে এই বই উনি লেখেননি। আসলে বলা হয় সুশ্রুত হচ্ছেন বিখ্যাত মুনি বিশ্বামিত্রের ছেলে। বিশ্বামিত্র নিজে একজন ব্রহ্ম মুনি ছিলেন, স্বয়ং ভগবান শ্রী রাম ওনার ছাত্র ছিলেন, গায়ত্রী মন্ত্র তিনিই লেখেন। সুশ্রুত এর পর ওনার অনেক ছাত্র একসাথে সুশ্রত সংহিতা বইটি লেখেন।
বলা হয় সুশ্রুত আজ থেকে প্রায় ২৬০০ সাল পূর্বে বেনারসে গঙ্গাতীরে থাকতেন এবং প্রতিদিন অজস্র মানুষের চিকিৎসা করতেন। তখনকার দিনে মানুষের জীবনযাপন খুবই সুন্দর ছিল, খাবারে কোনও ভেজাল ছিল না। বর্তমানে আমরা যাই খাই ফাস্ট ফুড তাতে অধিকাংশ ভেজাল, সত্যি কথা বলতে কী আমরা মনের আনন্দে বিষ খাই। সুশ্রুত বলতেন প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করা দরকার এবং শুদ্ধ খবার খাওয়া দরকার। ওনার মত ছিল রোগ হবার আগে রোগের কারন গুলো থেকেই দূরে থাকা। সুশ্রত শুধু চিকিৎসক ছিলেন না তিনি একজন নিপুন সার্জেন ছিলেন। তখনকার দিনেও তিনি প্লাস্টিক সার্জারি করতেন!!! শুধু একবার কল্পনা করে দেখুন। আরও একজন বিখ্যাত ভারতীয় চড়ক যিনি ঔষধের উপর কাজ করেছেন তিনি সুশ্রুত সংহিতাতে, যাকে শল্য তন্ত্রও বলা হয়, সার্জারি, আয়ুর্বেদ, প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা ব্যাবস্থা, জড়িবুটি সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। দেখুন ভারতের জঙ্গলে এমন অনেক গাছ পাওয়া যায় যা খেলে মানুষ সুস্থ হয়ে যায় সেসব মহাঔষোধি গাছ সবাই জানে না। যেমন দেখবেন যদি কাউকে সাপে কামড়ায় সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিভেনাম দেওয়া হয় কিন্তু যদি নেউল কে সাপে কামড়ায় নেউল দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে যায়, সেখানে একটা বিশেষ গাছ আছে যার পাতা খেলে সাপের বিষ নেমে যায়, যা আমরা জানি না। সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই ভারতে শাস্ত্র চর্চা হয়ে আসছে। সুশ্রুত এদেরই প্রতিনিধি। এব্যাপারে আরও স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় আয়ুর্বেদে। আয়ুর্বেদ বলতে আমরা জড়িবুটি বুঝি কিন্তু তা নয়। আয়ুর্বেদ বহু প্রাচীন ও উন্নত জ্ঞান। বেদের চারটি ভাগ ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। এই ঋগ্বেদের উপবেদ হল আয়ুর্বেদ। এতে মানুষের দেহ সম্পর্কে বলা আছে যে মানুষ সহ যেকোনও প্রাচীন শরীর পাঁচটি উপাদানে গঠিত বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী ও আকাশ। একে পঞ্চ ভূত বলা হয়েছে শাস্ত্রে। শরীরে এই পাচটি তত্বের মধ্যে সমতা নষ্ট হলেই শরীরে রোগ হয় যাকে আয়ুর্বেদে দোষ বলা হয়েছে। আয়ুর্বেদে বলা হয়েছে মানুষের শরীরে প্রধানত তিন ধরনের দোষ রয়েছে অ্যাসিড বা পিত্ত, কফ এবং গ্যাস। পিত্ত তৈরি হয় অগ্নি ও জলের সমন্বয়ে, কফ তৈরি হয় পিথবী ও জলের সমন্বয়ে এবং গ্যাস তৈরি হয় বায়ু ও আকাশের সমন্বয়ে। দেখবেন আমাদের প্রায়ই হাড়ের যন্ত্রনা, মাথার যন্ত্রনা হয় এর প্রধান কারন সেসব জায়গায় অ্যাসিড জমা হয়েছে। অ্যাসিড ও গ্যাস উৎপন্ন হয় আমাদের খাদ্যাভাসের কারনে।
অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাবার ফলে শরীরে প্রচুর অ্যাসিড ও গ্যাস উৎপন্ন হয় যা বিভিন্ন রোগের পাশাপাশি মানুষের আয়ু কমিয়ে দেয়। এখনকার দিনে একটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে চুল উঠে যাওয়া যার প্রধান কারনও ওই অ্যাসিডই। একটি গাছে অ্যাসিড দিলে যেমন গাছ নষ্ট হয়ে যায় ঠিক তেমনি চুলের গোড়ায় প্রচুর অ্যাসিড জমা হলে চুল শেষ হয়ে যায়। যার জন্য সুশ্রুত জোর দিয়েছিলেন শুদ্ধ খাবারের উপর। এজন্য ভারতীয় শাস্ত্রে নিরামিষ খাবারের কথা বলা হয়েছে যাতে মানুষ সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। সুশ্রুতর কাছে ২৬০০ বছর আগে যেসব ইকুইপমেন্ট ছিল তা সত্যিই অবাক করার মতন। বলা হয় সুশ্রুতর গুরু ছিলেন ধনবন্ত্রী, যাকে ভগবান বিষ্ণুরই অবতার বলা হয়। বলা হয় উনি দেবতাদের ঠিক করতেন। সুশ্রুত সংহিতা, চড়ক সংহিতাতে সাধারনত আয়ুর্বেদের উল্লেখ পাওয়া যায়। সুশ্রুত সংহিতাতে ১৮৪ চ্যাপ্টার আছে যাতে ১১২০ রকম রোগ, ৭০০ ঔষধিক গাছ, ৬৪ টি ঔষধিক ধাতু ও ৫৭ রকম প্রানীজ ঔষধ উৎসের কথা বলা হয়েছে। শুধু একবার ভাবুন প্রায় ২৬০০ বছর আগে কতটা উন্নত ছিল আমাদের চিকিৎসা ব্যাবস্থা। সেসময় না ছিল ইলেকট্রিসিটি, না ছিল কম্পিউটার, কমিনিউকেশন সিস্টেম, আধুনিক যন্ত্রপাতি কীছু ছিল না তাও এত উন্নত চিকিৎসা ব্যাবস্থা ছিল তা ধারনাতীত।
বলা হয় ভারত যেদিন বেদে আবার ফিরে যাবে ভারত আবার উন্নতির চরম শিখরে উঠবে এবং সিন্ধু সভ্যতার মতন উন্নত সভ্যতা আবারও ফিরে আসবে। সুশ্রুত সংহিতা দুটি ভাগে বিভক্ত বা ছয়টি বই মিলিয়ে সুশ্রুত সংহিতা। প্রথম ভাগকে বলা হয় পূর্ব তন্ত্র যাতে পাচটি বই রয়েছে এবং ১২০ টি চ্যাপ্টার আছে। এতে মানুষের শরীর সম্পর্কে বলা আছে। আরেকটি ভাগ হচ্ছে উত্তর তন্ত্র এতে আপুদ্রভিকা সম্পর্কে বলা হয়েছে যার অর্থ শরীরে বিভিন্ন স্থানে জটিল অস্ত্র প্রচার সম্পর্কে বলা হয়েছে। সুশ্রুতের ছাত্রদের সুশ্রুতাস বলা হত। পরে এটা টাইটেল হিসাবেও ব্যবহার হত। একজন ছাত্র কে চিকিৎসা শিখবার জন্য ছয় বছর পড়তে হত, এখন এমবিবিএস শিখতেও পাঁচ বছর লাগে। সাধারনত ডাক্তারি ছাত্রদের অপারেশন শেখানো হয় মৃত মানুষের শরীরে কিন্তু সুশ্রুত অপারেশন শেখাতেন ফলের উপরে, যেমন তরমুজ, শসা ইত্যাদি ফলে অপারেশন শেখাতেন। অনেক সময় একটি চামড়ার ব্যাগ নিয়ে তাতে জল ভরে দিয়ে অপারেশন করতে বলতেন। আজকের ন্যানো টেকনোলজি ও বিশেষ ধরনের আটটি অপারেশনের কথাও সুশ্রুত সংহিতায় পাওয়া যায়।
প্লাস্টিক সার্জারি ছাড়াও রাইনোপ্লাস্টি ও ব্রেন সার্জারির মত জটিল অপারেশনও তিনি করতেন। কারও নাক কেটে গেলে গাল থেকে চামড়া কেটে নিয়ে ঠিক করতেন, একে রাইনোপ্লাস্টি বলে। তিনি করতেন কী একটি পাতা নিয়ে তাতে নাকের ক্ষতর মাপ নিতেন দিয়ে সেই মাপ অনুযায়ী মাংস গাল থেকে তুলে নিয়ে নাকে বসাতেন। প্রায় ১২১ রকমের যন্ত্র ছিল তার যেগুলো তিনি নিজেই ডিজাইন করেছেন। সেসময়ও অপারেশনের জন্য মানুষকে অজ্ঞান করতে হত, সুশ্রুত বিশেষ কয়েকটি গাছের পাতার রসের সাহায্যে মানুষকে অজ্ঞান করতেন। পার্সিয়ার খলিফা আল মনসুদ সুশ্রুতর বই কে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন যার নাম দেওয়া হয় কিতাব আল সুশ্রুতা। যখন ১৭৯২ এ ব্রিটিশ সেনার সাথে টিপু সুলতানের যুদ্ধ হয় যাকে মহীশুরের তৃতীয় যুদ্ধ বলা হয়। তখন টিপু সুলতান একজনের নাক কেটে দিয়েছিল। যাকে পাশের গ্রামে কীছু সুশ্রতাস মাথা থেকে চামড়া কেটে নিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলেন। দুজন ব্রিটিশ ডাক্তার থমাস ক্রুজো এবং জেমস ফ্রানলি নিজের চোখে এই অপারেশন দেখেছিলেন। ১৭৯৪ সালে একটি ব্রিটিশ ম্যাগাজিন দ্য জেন্টলম্যানে প্রকাশ করেছিলেন তারা এই তথ্য। তাহলে ভাবুন সেই যুগে দাড়িয়ে কতটা জিনিয়াস ছিলেন সুশ্রুত। ভারতের এই মহান চিকিৎসককে সম্মান জানাতে অস্ট্রেলিয়া মেলবোর্নের রয়েল অস্ট্রেলিয়ান কলেজ অফ সার্জনের সামনে সুশ্রুতের মূর্তি তৈরি করেছে।